বাল্য বিয়ে সামাজিক অভিশাপ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১০ মে ২০২৩, ৫:১৫:২১ অপরাহ্ন

দুলাল শর্মা চৌধুরী
বাল্য বিয়েকে অভিশাপ হিসেবেই মনে করে আমাদের বর্তমান সমাজ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এর পরেও দক্ষিণ এশিয়ার বাল্য বিয়েতে বাংলাদেশ শীর্ষে। ইউনিসেফের জরিপে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। বাংলাদেশের বাল্য বিয়ে পরিস্থিতি বিষয়ে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিশ্বে বাল্য বিয়ে প্রবণ শীর্ষ দশটি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বাল্য বিয়ের হার এখন ৪৯ শতাংশে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫২ শতাংশ বাল্য বিবাহের শিকার হতো। কিন্তু ২০১৮ সালে হার বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯ শতাংশে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বাল্য বিয়ের প্রবণতা ১৯৭০ সালের তুলনায় ৯০ শতাংশেরও বেশি কমেছে, তা সত্ত্বেও এখনো এই হার অনেক বেশি। বর্তমানে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের ৫১ শতাংশের বিয়ে হয়েছে তারা শিশু থাকা অবস্থায়ই। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাল্য বিয়ের শিকার শিশুদের বেশির ভাগ দরিদ্র পরিবারের ও গ্রামে বাস করে। বাল্য বিয়ের শিকার মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার অবিবাহিত মেয়ে শিক্ষার্থীদের তুলনায় চারগুণ বেশি। কোভিড এর মহামারীতে বাল্য বিয়ের হার অনেক বেড়ে গিয়েছে। কোভিডের কারণে বাল্য বিয়ের অগ্রগতিকে আবারও পিছনের দিকে ঠেলে দেওয়ার হুমকিতে ফেলেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার দিকে তাকালে দেখা যাবে, স্বাধীনতা পরবর্তী চার দশকে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই ঈর্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। এমনকি শিশুদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। অপুষ্টির শিকার হার কমেছে। টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। শিশু শিক্ষার বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার মান আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কিন্তু বাল্য বিয়ের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারছে না কেন? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাল্য বিয়ে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগেও যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। শুধু আইন করে এ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না, এর জন্য প্রয়োজন হবে ব্যাপক জনসচেতনতাও। তার জন্য প্রাথমিক স্কুল থেকে শুরু করে হাইস্কুল পর্যন্ত বাল্য বিয়ের কুফল নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্ত আলোচনা করে তাদের সচেতন করে গড়ে তোলা।
ইদানিং অনেক স্কুলে মেয়েরা বাল্য বিয়ে নিয়ে সোচ্চার হয়েছে এবং অনেক বাল্য বিয়ে প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। সেসব খবর টেলিভিশন পত্র-পত্রিকায় মেয়েদের সাহসী কাজের প্রশংসা করে নিউজ করছে। এইসব খবর প্রচারে অভিভাবক ও মেয়েরাও ঘরে বসে টেলিভিশন দেখে পত্রিকা পড়ে সহজে তা জানতে পারছে। এতে সমাজে বাল্য বিয়ের কুফলতা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সমাজের চারিদিকে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারের মাধ্যমে বাল্য বিয়ে একটি মেয়ের জীবন কিভাবে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে, তাও জানাতে হবে মেয়ে শিশু অভিভাবকদের। জাতিসংঘ শিশু তহবিল সম্প্রতি এক গবেষণায় বলেছে, যে সব বাবা-মা মেয়ে শিশুদের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তাদের সবার থেকে বেশি জানতে হবে এতে মেয়ের শিক্ষা জীবন- তার সুন্দর বয়:সন্ধিকাল অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে, তলিয়ে যাবে তার গোটা জীবন করুণ অন্ধকারে। অল্প বয়সে শিশুদের বিয়ে দেওয়া যৌন নির্যাতনের অপরাধ বলে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন অনেক দূর এগিয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে তবু নারী শিশুদের নিরাপত্তা কিছুতেই নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। নারী ও শিশু অধিকার সুরক্ষায় ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ সবখানেই সচেতনতার মাত্রা বাড়াতে হবে। কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বাস করি, মানুষ সচেতন হলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা বাহিনী সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে নারী, শিশুসহ সবার নিরাপত্তা বাড়বে এবং সমাজ থেকে বাল্য বিয়ের হার কমে গিয়ে একদিন বাংলাদেশ বাল্য বিয়ের অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে।
লেখক : কবি।