বায়জিদ বোস্তামির মাজারে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মে ২০২২, ৫:২৩:৫১ অপরাহ্ন

চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী
আজ ১৮ মার্চ ২০২১ সাল। বসন্তকালের উজ্জ্বল আলোয় ঝলমলে চট্টগ্রাম। আমাদের আজকের ভ্রমণসূচি তৈরি। স্বল্প সময়টাকে যথাযত ব্যবহার করে যতটুকু দেখা যায়। সকালে নির্ধারিত সময়ের আগেই ড্রাইভার আব্দুল মতিন এসে হাজির। আমাদের গাড়ি ছুটে গেল নাসিমন ভবন, বিএনপি অফিস, চট্টগ্রাম। প্রায় দুইশত বছর আগে একজন ধনী সওদাগর প্রায় তিন একর মূল্যবান জায়গা জনসেবার জন্য ওয়াকফ দলিলের মাধ্যমে দান করে যান। এই জায়গায় বৃটিশ আমলে নির্মিত দুইটি বিশাল ভবন রয়েছে, একটি ভবনে চট্টগ্রাম ওয়াকফ সরকারি কার্যালয় এবং অন্য ভবনটি দখল করে নিয়েছে বিএনপি চট্টগ্রাম। বৃটিশ ঐতিহ্যে নির্মিত উঁচু ছাদের ওয়াকফ অফিসে ঢুকে সাদর অভ্যর্থনা পেলাম।
এই অফিস প্রধান নাসির উল্লাহ আমাদের সহসঙ্গি যীশুর চাচাত ভাই। তাঁর পদবী ওয়াকফ পরিদর্শক। তিনি দু’তলার বাসিন্দা ও নিচতলা অফিস। অফিসে তাঁর অধীনে বেশ কয়েকজন পাইক পেয়াদা ধরনের কর্মচারী কাজ করেন। ভাল নাস্তা ও কফি আসে। বিদেশে ড্রাগন ফলের স্বাদ নিলেও করোনার জন্য বিদেশ যাত্রা বন্ধ। বহুদিন পর আবার এখানে ড্রাগন ফলের স্বাদ নেই। এই অফিসে বসে কিছু অজানা বিষয় জানা হল, যা আগে আমার ধারণায় ছিলনা। আদিমকাল থেকেই কর্ণফুলি নদী ও বঙ্গপোসাগর বিধৌত চট্টগ্রাম বাংলার প্রসিদ্ধ বন্দর ও ব্যবসাকেন্দ্র। সব সময়ই এই এলাকায় ছিল সম্পদ ও টাকার ছড়াছড়ি। তাই যুগেযুগে এখানকার অনেক মহানুভব বিত্তবান মানুষ প্রচুর ধনসম্পদ ও ভূমি জনকল্যাণে ওয়াকফ করে যান। মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অসংখ্য পীরের মোকাম এসব ওয়াকফ ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত। এসব ওয়াকফ সম্পদের আয়ও কম নয়। ওয়াকফ পরিদর্শক নাসির উল্লাহ জানান, চট্টগ্রামের ওয়াকফ সম্পদ-দাতাদের অসিয়ত অনুসারে আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনা হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব তাঁদের। যে সব মাজারে আয় বেশি সে সবের দানবাক্স ওয়াকফ পরিদর্শক ও সরকারি ম্যাজিস্টটের উপস্থিতিতে খোলা হয়। অনেকটা ব্যাংকের ভল্টের মত, দানবাক্স খোলতে খাদেমদের চাবির সাথে সরকারের প্রতিনিধির চাবির দরকার হয়। মাসে একবার দুইবার সরকারি ওয়াকফ পরিদর্শক গিয়ে বাক্স খোলেন এবং সংশ্লিষ্ট হিসাবে টাকা নিয়ে যান। নাসির উল্লাহ জানালেন সরকারের এত প্রহরার পরও ওয়াকফ সম্পদ ও এইসব সম্পদের প্রচুর আয় নয়ছয় হয়ে যায়। অফিসে বসে সীমিত জনবল দিয়ে এত ওয়াকফ সম্পদ যথাযত ব্যবস্থাপনা ও পাহারা দেওয়া সম্ভব হয়না।
চট্টগ্রামে ওয়াকফকৃত প্রায় মাজারই পাকা ঢালাই ঘরের মেঝে সুসজ্জিত করে স্থাপিত। কবরের উপর ও দানবাক্সে হাজার হাজার টাকা বর্ষণ হয়। কবরের উপর ফেলা ভক্তদের দানের টাকা ও সোনা হরহামেশা চুরি হয়ে যায়। এই চুরি ঠেকাতে কিছু মাজারে চিকন গ্রিল লাগানো হয়। কিন্তু দেখা যায় লাটির আগায় আঠা লাগিয়ে খাদেমরা টাকা তুলে লোপাট করে দেয়। তারপর সরকার বাধ্য হয়ে গ্রিলের সাথে কাঁচের শক্ত আবরণ টেনে দেয়।
হজরত বায়জিদ বোস্তামির (র.) মাজার দর্শন ঃ
আমরা হজরত বায়জিদ বোস্তামির (র.) মাজারে যাব জানতে পেরে ওয়াকফ পরিদর্শক নাসির উল্লাহ বললেন, তিনিও আমাদের সাথে যাবেন। এই মাজারও একটি ওয়াকফ করা ভূসম্পদ। নাসির উল্লাহ সাহেব আমাদের সাথে থাকায় এখানেও আমরা রাজানুকল্য পেলাম। স্বয়ং দরগার মোতাওয়াল্লি মৌলভি হাবিবুর রহমান সাহেব আমাদের খেদমতে হাজির হন। তিনি ফর্সা সাদা শ্মশ্রুধারি সুদর্শন প্রৌঢ় বয়সী লোক। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি ও পাজামা পরে আমাদেরকে দুতলায় তাঁর অফিসে নাস্তায় আমন্ত্রণ জানান। আমি দুইধরনের লোকের চেহারায় প্রশান্তির আলো দেখতে পাই। একদল যারা প্রচুর পরিশ্রম করে জীবনে সফলতা পান এবং আরেকদল যারা তেমন পরিশ্রম না করেই জীবনে সবকিছু সহজে পেয়ে যান। আল্লাহ পাকের নিয়ামতরাজি হল ধন, জন, মান, সম্মান, সুখ শান্তি ইত্যাদি। মোতাওয়াল্লি হাবিব সাহেবের অভিজাত নুরানি চেহারার পানে তাকিয়ে তাঁকে আমার দ্বিতীয় দলের একজন ভাগ্যবান লোকই মনে হল। তিনি প্রায় সত্তুরটি সিঁড়ি বেয়ে আমাদেরকে পাহাড়ের উপর বায়জিদ বোস্তামির (র.) স্মৃতিসৌধে নিয়ে যান। কবরের মত সাজানো স্মৃতিকাঠামো একটি সুরম্য ভবনের ভিতরে স্থাপিত। কবরাকৃতির কাঠামোর উত্তর শিরোভাগে বড় সবুজ পাগড়ি লাগানো যেন পাগড়ি মাথায় দিয়ে কেউ মাটিতে শুয়ে আছেন। মাজার কাঠামোর চারপাশে আগর ধূনা ও মোমবাতি জ্বালিয়ে ভক্তরা বসে বসে জিকির আজকার করছেন। মোতাওয়াল্লি জানালেন কুড়ি একরের এই বিশাল দরগাহ কমপ্লেক্স হাজার বছরের পুরানো। পাহাড়ের ধাপে সিঁড়ির দু’পাশে কিছু জনকবর রয়েছে, তবে হজরত শাহজালালের (র.) মাজারের মত পরিবেষ্টিত গোরস্থান নেই। মোতাওয়াল্লি হাবিবুর রহমান মাজারটি হাজার বছরের পুরানো দাবি করলেও পরে জানলাম এই সমাধি অবয়ব ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে পাহাড়ের উপরিভাগে একটি দেয়াল ঘেরা আঙ্গিনায় আবিস্কার করা হয়। আঙ্গিনার ঠিক মাঝামাঝি একটি শবাধারের কাঠামো ছিল। পরে এখানে আধুনিক সমাধি কাঠামো ও ভবন নির্মাণ করা হয়। সমাধি পাহাড়ের পাদদেশে মোঘলরীতিতে নির্মিত একটি তিন গম্বুজ মসজিদ এবং একটি বড় পুকুর রয়েছে। স্থাপত্যশৈলী দেখে অনেকে ধারণা করেন এই মসজিদটি মোঘল সম্রাট আলমগীরের আমলে নির্মিত।
এই মাজারটি যদিও ইরানের বিখ্যাত সূফি বায়জিদ বোস্তামির (র.) নামে স্থাপিত, কিন্তু তিনি চট্টগ্রাম এলাকায় আসার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়না। প্রাচীন আমলে অনেক সূফি সাধক ও আউলিয়া চট্টগ্রাম এলাকায় ইসলাম প্রচারের সময় পাহাড়ের উপর জঙ্গলঘেরা স্থানে আবাস স্থাপন করেন। তাঁরা এসব জায়গায় মাজার কিংবা এধরনের বিভিন্ন স্মৃতি স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করেন। বায়জিদ বোস্তামির (র.) মাজারটাও মূলত উনাকে উৎসর্গ করে তাঁর ভক্তগণের প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিরূপ মাত্র।
কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া না গেলেও এলাকায় জনশ্রুতি আছে যে হজরত বায়জিদ বোস্তামি (র.) চট্টগ্রামে এসেছিলেন এবং এখানে কিছুকাল অবস্থানের পর তিনি পারস্যে ফিরে যান। ভক্তগণ তাঁকে চট্টগ্রাম থেকে যাবার অনুরোধ করলে তিনি তাঁদের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে স্বীয় আঙ্গুল কেটে কয়েক ফোটা রক্ত মাটিতে ফেলেন এবং ঐ স্থানে তাঁর নামে মাজার গড়ে তুলার কথা বলে প্রস্থান করেন।
বায়জিদ বোস্তামির (র.) কাছিম ঃ
বায়জিদ বোস্তামির (র.) মাজারের পাদদেশে একটি বিশাল দীঘি রয়েছে। এই দীঘি বায়জিদ বোস্তামির (র.) কাছিম ও গজার মাছের জন্য বিখ্যাত। মোতাওয়াল্লি সাহেব আমাদেরকে পুকুরের ঘাটে জলে ভাসা বড় অবয়বের কচ্ছপদের সামনে নিয়ে যান ও ছবি তুলেন। মোতাওয়াল্লি বললেন বায়জিদ বোস্তামির (র.) কাছিম বিশ্বে একটি বিরল ও চরম বিপন্ন প্রজাতির কচ্ছপ হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আর বললেন, বর্তমানকালে বায়জিদ বোস্তামির (র.) মাজার প্রাঙ্গণ ব্যতিত পৃথিবীর আর কোথাও এই প্রজাতির কাছিমের দেখা মেলেনা। বর্তমানে মাজারদীঘিতে দুই তিন শত কচ্ছপ রয়েছে বলে তিনি ধারণা করেন। মাজার কর্তৃপক্ষ প্রজনন মৌসুমে মূল পাহাড়ের পিছনে সংরক্ষিত বালুকাময় স্থানে এই কাছিমদেরকে ডিম পাড়ার ব্যবস্থা করে দেন।
এই মাজারের ভক্তকূলের ধারণা ও জনশ্রুতি হল, আদিকালে এই অঞ্চলে প্রচুর দুষ্ট জ্বিন ও পাপাত্মাদের পদচারণা ছিল। বায়জিদ বোস্তামি (র.) চট্টগ্রাম ভ্রমণকালে এইসব দুষ্টদেরকে কাছিমে পরিণত করে আজীবন পুকুরে বসবাসের দণ্ডাদেশ প্রদান করেন।