‘বিপজ্জনক’ সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ মার্চ ২০২১, ২:৪৬:০৭ অপরাহ্ন

সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। গত ৬ মাসে এ মহাসড়কের সিলেট থেকে ভৈরব অংশে দুর্ঘটনায় শতাধিক লোকের প্রাণহানি হয়েছে।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি (বুয়েট)-এর এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো: সাইফুন নেওয়াজ জানান, বিপজ্জনক বাঁক, রোড মার্কিংয়ের অভাব, ফিডার রোড (পার্শ্ব রাস্তা) এবং সড়কে অটোরিক্সার দাপট-এ মহাসড়কে দুর্ঘটনা বাড়ার মূল কারণ। এ চারটি কারণের পাশাপাশি এই রোডে দুর্ঘটনার জন্য আরো কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন তিনি।
তার মতে, ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে গাড়ি চালানো, অতিদ্রুত বা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, গতিসীমা অনুসরণ না করা, মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী বা মালামাল বহন করা, রোড সাইন, মার্কিং ও ট্রাফিক সিগন্যাল সম্পর্কে ধারণা না থাকা বা ধারণা থাকলেও তা মেনে না চলা, ওভারটেক, সামনের গাড়ির সাথে নিরাপদ দূরত্ব বজায় না রাখা, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চালানো, চালকের পরিবর্তে হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, ঝূঁকিপূর্ণ পরিবেশে গাড়ি চালানো, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম না নিয়ে অবসাদগ্রস্থ অবস্থায় একটানা গাড়ি চালানো, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো, শিক্ষার স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত ট্রেনিং ও অনভিজ্ঞতাকেও দুর্ঘটনার পেছনের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তিনি।
হাইওয়ে পুলিশ, সিলেট রিজিওনের পুলিশ সুপার মো: শহীদ উল্যাহ জানান, সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের অধিকাংশ স্থানে রোড মার্কিং নেই। বিধান না থাকলেও এ মহাসড়কের স্থানে স্থানে স্পীডব্রেকারের ছড়াছড়ি। জরিমানা করেও মহাসড়কে অটোরিক্সা চলাচল বন্ধ করা যাচ্ছে না। বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানোর পাশাপাশি চালকরা বিশ্রাম না নিয়েই চালাচ্ছে যানবাহন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে চালক সিলেট থেকে গাড়ি চালিয়ে ঢাকা যাচ্ছে, ফিরতি হিসেবে সেই আবার ঢাকা থেকে গাড়ি চালিয়ে সিলেট আসছে। বিশ্রাম না নেওয়ায় অনেক চালক ঘুমিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে অনেকে অবলীলায় ডান দিক থেকে চলে যাচ্ছে বামদিকে-এ কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। তিনি বলেন, এ মহাসড়কের সিলেট টু শায়েস্তাগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তায় মার্কিং নেই। রাস্তার অনেক স্থানে উঠে গেছে কার্পেটিংও।
সোহাগ পরিবহনের সাবেক ড্রাইভার ও সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ময়নুল ইসলাম জানান, সিলেট-ঢাকা মহাড়কে পৃথক কোন লেন নেই। একটিমাত্র রাস্তা দিয়ে গাড়ি আসা যাওয়া করে। পাশাপাশি এ মহাসড়ক অনেকটা অপ্রশস্ত। আগের তুলনায় রাস্তায় যানবাহন কয়েকগুণ বাড়লেও বাড়েনি রাস্তার প্রশস্ততা। দক্ষিণ সুরমার রশীদপুরে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার বিষয়ে আলোকপাত করে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে রং সাইড দিয়ে আসা লন্ডন পরিবহনের বাসটিকে টার্নিংয়ের কারণে দেখতে পারেনি এনা পরিবহনের চালক। যে কারণে এ দুর্ঘটনায় ৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের পুলিশ সুপার জেদান আল মুসা জানান, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মূলত ওভারটেকিং, ওভার লোড, ওভার স্পীড ও ওভার কনফিডেন্স দায়ী। সড়ক দুর্ঘটনারোধে সচেতনতার পাশাপাশি সড়ক পরিবহন আইন ও ট্রাফিক আইন মেনে চলার তাগিদ দেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।
হাইওয়ে পুলিশ, সিলেট রিজিওনের তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ মাসে তাদের আওতাধীন সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের তাজপুর থেকে ভৈরব পর্যন্ত অংশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৮৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন ৫৬ জন। এর মধ্যে শায়েস্তাগঞ্জ হাইওয়ে থানা এলাকায় কেবল ২৩ জন, খাটিহাতা থানা এলাকায় ২২ জন, শেরপুর হাইওয়ে থানা এলাকায় ২১ জন, ভৈরব হাইওয়ে থানা এলাকায় ১৬ জন এবং তামাবিল হাইওয়ে এলাকায় ৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এ সময়ে সবমিলিয়ে ৫৬টি দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ১৯টি করে বাস ও ট্রাক দুর্ঘটনা, ১১টি প্রাইভেট কার-মাইক্রোবাস দুর্ঘটনা, এর বাইরে সিএনজি অটোরিক্সা দুর্ঘটনা, কাভার্ড ভ্যান দুর্ঘটনা, মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়াও একই সময়ে ১৩টি পথচারী দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া, মহাসড়কের চন্ডিপুল থেকে নাজির বাজার পর্যন্ত অংশে (সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ এলাকায়) আরো অন্তত ১০/১১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের রশীদপুর থেকে ভৈরব পর্যন্ত কমপক্ষে অর্ধ শতাধিক বাঁক/মোড় রয়েছে। এর মধ্যে কেবল শায়েস্তাগঞ্জ হাইওয়ে থানার অধীনেই রয়েছে ২৫টি মোড়। শায়েস্তাগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশের ওসি মাইনুল ইসলাম জানান, মহাসড়ক পারাপারের সময় প্রায়ই পথচারী-শিক্ষার্থীরা দুর্ঘটনার শিকার হয়। এ অবস্থায় তিনি হাইওয়ে এলাকায় ইনফরমেটিভ সাইন বসানোর তাগিদ দেন। এছাড়া, সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দক্ষিণ সুরমার রশিদপুর বাঁকেও একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। গত শুক্রবার এই বাঁকেই লন্ডন এক্সপ্রেস ও এনা পরিবহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে সিলেটের এক উদীয়মান চিকিৎসকসহ ৮ জন প্রাণ হারান।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণা অনুযায়ী, সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের চন্ডিপুল থেকে সাত মাইল পর্যন্ত অংশ এমনিতেই সড়ক দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকা হিসাবে চিহ্নিত। ঢাকা-সিলেট সড়কটির দূরত্ব ২৭৮ কিলোমিটার।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), সিলেট-এর তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী উৎপল সামন্ত জানান, সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। এ কারণে হয়তো রাস্তার অনেক স্থানে মার্কিং নেই। যেসব স্থানে উন্নয়ন কাজ শেষ হয়েছে, সে সব স্থানে রোড মার্কিং দেয়া হচ্ছে। উন্নয়ন কাজ শেষ হলেই পুরো রাস্তায় মার্কিং দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, এ মহাসড়কের সিলেট অংশে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে ভোররাতে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, রাতে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বাসের চালক ও যাত্রীরা মধ্যরাতের পর হাইওয়ে রেস্টুরেন্টগুলোতে খাবার খান। ক্লান্তির কারণে এরপর তাদের মধ্যে ঝিমুনি চলে আসে। যে কারণে ঘটে দুর্ঘটনা। তিনি জানান, সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক প্রকল্প এরই মধ্যে একনেকে অনুমোদিত হয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সড়কের অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ পুলিশ-এর তথ্য অনুযায়ী, সিলেটে ২০২০ সালে ১৮৭টি দুর্ঘটনায় ২৫০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। একই বছর সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৬ হাজার ৬৮৬ জনের। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ৬৪৮টি মামলা রুজু হয়। এতে নিহত হন ৬০১ জন। গুরুতর আহত হয়েছেন ৩২৯ জন এবং সামান্য আহত হয়েছেন ৩৪ জন। এর মধ্যে ট্রাক ২৮.৯৭%, বাস ১৬.৫৩%, কার ও জীপ ১২.৩০%, মোটরসাইকেল ১৯.৭৮%, ট্যাক্সি ১১.৭৭% এবং অন্যান্য যানবাহন রয়েছে ১০.৮৫%।
প্রসঙ্গত, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দুর্ঘটনায় সাবেক অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান, সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র কবি মমিনুল মউজদিন এবং সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ইফতেখার হোসেন শামীমও প্রাণ হারান।