বিয়ের ফুল
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জুন ২০২২, ৭:৫৬:৪১ অপরাহ্ন

তাসলিমা খানম বীথি
মধ্যরাতে আম্মার কান্নার শব্দে গভীর ঘুম ভেঙ্গে চোখ দুটো খুলে যায়। আম্মা জায়নামাজে বসে কাঁদছেন. দোয়া পড়ছেন। সব কথা স্পষ্ট না শুনলেও শুধু একটি কথা কানে এসে বাজে ’হে আল্লাহ যাদের বিয়ে হচ্ছে না সেইসব মেয়েসহ আমার মেয়ের জোড়া মিলিয়ে দেন’ বলতেই ফুফিয়ে ফুফিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদেন। তখন আর ঘুম আসে না। বালিশটাকে বিছানা লম্বা করে এলান দিয়ে বসে থাকি। রুমের নীল রং ডিম লাইটের আলো সাথে মিশে নিংশব্দে আমিও চোখের জল ছাড়ি। শুধু আজকের রাত নয়। এমন করে প্রতিদিনই আম্মা তাহাজ্জুদের নামাজে বসে কাঁদেন। কখনো ঘুম ভাঙ্গার আগেই সকাল হয়, কখনো ভোর হয় চোখের জলে। আম্মাকে বুঝতে দেই না। আমিও নিরবে ওঠে আম্মার মতই তাহাজ্জুদের নামাজে উনার চোখের জলে নিজেও বৃষ্টির মত ভিজতে থাকি।
২. তখন বিশে^ জুড়ে করোনা মহামারি চলছে। পুরো দেশ তখন লকডাউনে। গৃহবন্দি সবাই দিনযাপন করছে। এতটা কঠোর ছিলো যে প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের হত না। দিনেরবেলা বের হলে মনে হতো কারফিউ চলছে। বিনা অস্ত্র যুদ্ধ। করোনা নামে মহামারি রোগের সাথে মানুষের। সুস্থভাবে বেচে থাকাটাই তখন সবার কাছে ছিলো আর্চয্য। করোনা না হওয়া মানে সুস্থ থাকা। করোনা হলেই যেনো মৃত্যু সাথে লড়াই করা। বাস্তবতা এত কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে বিধিনিষেধ না মানলে জরিমানা। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ের কাজটা সারতো। অথচ কিছুদিন আগেও কয়েক লাখ টাকা ব্যয়বহুল বিলাসিতা ভরা ছিলো বিয়ে নামক শব্দে। করোনা এসে সে দৃশ্য আপতত সাময়িক আকারে বিয়েশাদি হচ্ছে। এই মহামারি দুঃসময়ে বিয়ে বরযাত্রী কনে বাড়ি তখন হাতেগোনা পরিবারের মানুষ ছাড়া লোকজন তেমন হত না। জাঁকজোমক আয়োজন ছাড়াই কনে বধুবেশে স্বামী বাড়ি যাচ্ছে।
৩. সেদিন খুব সকালে সাদা রংয়ের একটি নোহা গাড়ী বাসার গ্রীলের সামনে দেখে আম্মা ভেবেছে কেউ অসুস্থ। পরে যখন জানলো নিলু আপার বরের গাড়ী। তখনই রুমে ছুটে এসে খাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে দেন। নিলু আপা চলে যাচ্ছেন তার স্বপ্নের ঠিকানায়। তার কত দিনের ইচ্ছে পূরন হলো। বিয়ে নিয়ে নিলু আপা আশানিরাশার মধ্যে ছিলেন। বিশেষ করে তার মুঠি শরীর নিয়ে। মার্স্টাস শেষ করেছেন অনেক আগেই। বিয়ের প্রস্তাব আসলেও ভেঙ্গে যায়। ছোট বোন লিলি অর্নাস দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। তার বিয়ে না হলে লিলিও আটকে থাকবে। সেটি কখনো নিলু আপা চায় না। কিন্তু কেউ বিয়ে না করলে নিলু আপার কি করার আছে। যতদিন যাচ্ছে সে ততই মুঠি হচ্ছে। এতটাই মোঠা হয়েছে আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেরই খারাপ লাগে। ঘরের সবাই তাকে নিয়ে আছে বিপদে। মেয়েদের জন্ম পর বড় হবার সাথে সাথে বিয়ে দিতে না পারলে মাবাবার যেনো মাথা উপরে পাথর রাখার মত বুঝা মনে করে। যেনো পাথরটাকে কেউ সরিয়ে দিলে নিশিন্তে ঘুমাতে পারবেন। ছুটির দিনে বাসার ছাদে নিলু আপার সাথে দেখা হলে মায়ার সাথে এসব নিয়ে কথা বলতো। মায়া আর নিলু অবস্থা একেই। পরিবারে সবার একটাই চাওয়া ঘরের মেয়েদের যত দ্রুত বিয়ে হবে ততই ভালো। বিয়ে নিয়ে মায়ার এতটা মাথা ব্যথা নেই যতটা নিলুর আছে। মায়া আর নিলু এক ভবনের পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকে অনেক বছর হলো। তাদের দুজনের পরিবার প্রতিবেশি হিসেবে সুসম্পর্ক। কেউ দেখলে ভাববে আত্মীয়। নিলু মার্স্টাস শেষ করে চাকরি কোন ব্যবস্থা না হওয়া ঘরে বসে শুয়ে বই পড়ে আর ভাইয়ের নবজাতক নিয়ে সময় কাটাচ্ছে।
৪. নিলু আপার ভাবী প্রাইমারি স্কুলের টিচার। শহর থেকে একটু দূরে। তাই খুব সকালে ওঠেই স্কুলের জন্য রেডি হয়ে বের হতে হয়। মেয়ে জন্ম পর থেকেই নিলু আপাই মায়ের মতই লালনপালন করছে। একাই সংসার সামলায়। শরীর কিছুটা শুকনো জন্য ঘরের সব কাজ নিজের হাতে করে। তাতে যদি কিছুটা কাজ হয়। তবে খাওয়াদাওয়া বেশ রুচি। মুখের রুচি ভালো জন্য খাবারটা কন্ট্রোল করতে পারে না বলে তার যত রাগ জিহ্বা উপর। তবে তাকে যে করে হোক চিকন হতে হবে। কিভাবে মুঠি থেকে চিকন হওয়া যায়। তাই নিয়ে মায়ার সাথে কথা বলে। মায়া নিলুকে বলে জীমে ভর্তি হতে। জীমের কথা শুনে নিলু বলে ছেলেদের জীমে আমি কিভাবে ব্যায়াম করবো। একথা শুনলে বাসা থেকে যেতে দেবে না। মায়া হেসে বলে নিলু আপা কেন মন খারাপ করছো। যুগ পাল্টাচ্ছে এখন ছেলেদের জীম এর পাশাপাশি মেয়েদের জন্যও জীম হয়েছে। আমার পরিচিত এক আপা সেখানে জীম করে। ঠিকানা লিখে দিতেই নিলু খুশিতে মায়াকে জড়িয়ে ধরে বলে-মায়া তোকে কি বলে ধন্যবাদ দিবো। কিছুটা হালকা লাগছে। তুই তো জানিস বিয়ের আলাপ আসলে আমার স্বাস্থ্য জন্যই কেউ পছন্দ করে না। না হলে দেখ, আমি কি দেখতে এতটা খারাপ না, তাই না। মায়া জানে তার কষ্ট আর নিলু আপার কষ্ট রং এক। দুজনের বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে।
মায়া বলে-যেদিন তোমার বিয়ের ফুল ফুঁটবে সেদিনই বিয়ে হবে। শত বাধা বিপত্তি থাকলেও হবে। তখন দেখবে কেউ আটকিয়ে রাখতে পারবে না। এত হতাশ হও না তো। আল্লাহ উপরে ভরসা কর। কফি খেতে খেতে ছাদে দুজনে জমিয়ে আড্ডা দেয়।
নিলু তখন মায়াকে বলে-তোর কাছে মনের দুঃখ ব্যথা বলে শান্তি পাই। তোর মুখে আশার বাণী মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির মত বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। মায়া নিলুকে বলে বিয়ে হলে আবার ভুলে যেও না। কনে সাজে তোমাকে অনেক সুন্দর লাগবে। নিলু চোখ দুটো আনন্দে চিকচিক করে। গৌধুলী বেলা শেষ সূর্যস্থ সাথে দুজনের সিঁড়ি বেয়ে ঘরে ফিরে। মাঝে মধ্যে ঘুম না আসলে মধ্যরাতে প্রায়ই দুজনেই তুমুল আড্ডা। কথা বলার ফাঁকে দুজনই অট্টোহাসি দেই। তখন আম্মা ডাক শুনি। মাঝে মধ্যে এমন মন খারাপ হয় সব কথা সবাইকে বলাও যায় না। মায়ার মন খারাপে সবচে কাছের মানুষ নিলু। তার মন খারাপ ভালো করার প্রতিবেশি। রক্তের বা আত্মার হোক। মন খারাপে যেই পাশে থাকুক না কেন তিনি ই সবচে আপন।
৫. লকডাউনে মধেও নিলু আপাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসে। যদি পছন্দ হয় তাহলে এই দিনেই বিয়ে হবে। নিলু আপার মাবাবা বড় ভাই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। সন্ধ্যায় পাত্রসহ কয়েকজন মুরুব্বি আসেন। নিলু আপা নীল কালারের একটা শাড়ি পড়েছে। বেশ ফর্সা জন্য তাকে ম্যাকাপ ছাড়াই দারুন লাগছে। সমস্যা শুধু স্বাস্থ্যবতী শরীরটা। তার অতিরিক্ত মেদ জন্য শাড়ী পরতে চায় না। পাত্র সামনে শাড়ী না পরলে যেনো পাত্রীই লাগে না। সে জন্যই শাড়ী পরা। এত সুন্দর করে সাজ আর বাবা ভাইয়ের এত কষ্টের টাকা দিয়ে বাজার করা রান্না সব বিফলে যখন পাত্রপক্ষরা না করে দেয়। একটি মেয়ের বিয়ে কনে দেখে না করে দিলে তার পরিবারে প্রত্যেকের মনে যে কি পরিমাণ কষ্ট হয়, তা শুধু মাত্র মেয়ের বাড়ির লোকজনই অনুভব করতে পারবে। সেদিনের পর নিলু আপা অনেক কেঁদেছেন।
৬. অফিস থেকে ফিরেই মায়া নিলুর মন খারাপের কথা শুনে দুতলা সিঁড়ি মাড়িয়ে কলিংবেল শব্দে ভাবী এসে দরজা খুলেন। সোজা নিলুর রুমে মায়া।
-নিলু আপা কাঁদছ কেন? আমার বয়েসে অনেক বড় হলেও তুমি আমার কাছে একজন ভালো বন্ধুও। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। তোমার জন্য বেস্ট কেউ অপেক্ষা করছে। কাঁদবে না একদম। সত্যি সত্যি যেদিন বিয়ে হবে সেদিন জন্য চোখের জল জমা রাখো। নিলু চোখ মুছতে মুছতে বলে আজকে যে পাত্র আসছিল তার বয়স অনেক বেশি। দেখতে এতটা সুন্দর না। জানিস গায়ের রং অনেক কালো আর আমার চাইতে স্বাস্থ্য অনেক বেশি। ছেলেরা কি ভাবে নিজেদের। তুই জানিস শুধু পরিবার মাবাবার টেনশন কমানো জন্য বিয়েতে মত দিছি। না হলে বিয়েই করতাম না। সারাজীবন সিঙ্গেল থাকতাম। নিলুকে কিছুটা শান্ত হতে মায়া তার ঘরে চলে আসে।
৭. নিলু আপাকে কনে সাজে কেমন লাগছে। তার বিদায় বেলা দেখার জন্য আম্মা খুব জোরে আমাকে ডাকতে লাগলেন। মায়া ওঠ। নিলু চলে যাচ্ছে। তাকে কি সুন্দর লাগছে দেখ? মেয়েটাকে এক নজর দেখে যায়। মায়া ঘুম কাতর চোখে বলছে-নিলু আপা কোথায় যাচ্ছে।
-আম্মা জবাব দেন-গতরাতে ফ্রান্স প্রবাসী পাত্র সাথে নিলুর বিয়ে হয়েছে। কয়েকদিন থেকেই তার বিয়ে কথা শুনছি। কিন্তু এবার বিয়েটা হয়ে যাবে। এরকম হুট করে ভাবতে পারিনি। বেশ আনন্দের কথা। খুব ভালো হয়েছে আম্মা। আমি ঘুমাবো। তুমি আর ডেকে না আমাকে। তোর অফিসের সময় হয়েছে। কখন ওঠবি। আরলি ওঠলে নাস্তাটা ঠিকমত খেতে পারিছ। প্রত্যেক দিন লেইটে ওঠে তখন না খেয়ে যেতে হয়। মেয়েটা বড় হয়েছে কিন্তু নিজের যত্ন নিতে শিখলো না। আম্মা যাও তো এখন। কানের কাছে ভনভন করো না। কিছুক্ষণ পর মায়া দ্রুত বিছানা ছাড়ে। জাস্ট ওয়াশরুমে ঢুকে ব্রাশ করা, মুখ ধোয়া, ফ্রেশ। ওয়ার্ডড্রয়ার থেকে এলোমেলো জামাকাপড় থেকে একটা জামাকে বাচাই করে দ্রুত রেডি হয়ে অফিস ব্যাগটা হাতে নিয়ে দরজার সামনে সেলফ থেকে জুতা পায়ে দিয়ে বের হবে আর তখনই আম্মার ডাক। টিফিনটা নেয়, কিছু খেয়ে যায়। আমার খাওয়া নিয়ে টেনশন কর না আম্মা। আল্লাহ হাফেজ। বলেই মায়া বাসার গেইট থেকে বেরিয়ে রিকশা নিয়ে সোজা অফিসে। ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার হিসেবে জয়েন করে এখন সে সিনিয়র অফিসার। কলিগদের অনেকেই বিয়ে কাজ শেষ। এখন অবিবাহিত শুধু মায়া। অফিসিয়াল কাজে মায়া খুব সিরিয়াস। তার আন্তরিকতা, সততা ও দায়িত্বশীলতা জন্য সবাই তাকে স্নেহ করে ভালোবাসে। তার ছোট বোন আশা প্রাইভেট একটি হেলথ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে জব করে। মায়ার ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক স্বপ্ন। নিজের একটি অবস্থান হোক। পরিবারের জন্য ভালো কিছু করা। বিয়ের অনেক প্রস্তাব আসে। কখনো ছেলের পক্ষরা না করে, কখনো মায়ার পরিবার থেকে এগুতে গিয়ে পারে না। মেয়েটার বয়স বাড়ছে। বিয়ের বয়সে বিয়ে না হলে তখন অনেক সমস্যা হতে পারে। কিসের সমস্যা আম্মা। খাবারের টেবিলে খেতে বসে আবার বিয়ে কথা কেন? আমি ভালো আছি। তাছাড়া আল্লাহ হুকুম যখন হবে দেখবে তোমার মেয়েকে এসে এক রাজপুত্র নিয়ে যাবে। আমাদের কিসে ভালো আর খারাপ আল্লাহপাক সবচে ভালো জানেন। তিনি তো আমাদের জন্য উত্তম পরিকল্পনা করে রেখেছেন। তাই না। বিয়ের বয়সী মেয়ে ঘরে থাকলে মা-বাবা যে কষ্ট হয় যেদিন তুই মা হবে। সেদিন বুঝবি। আম্মার কথা অর্থ মায়া বুঝে। কিন্তু নিজের জীবনের জন্য কিছুটা সময় গুছিয়ে নেওযা দরকার। জীবনকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে জীবনবোধ অত্যন্ত জরুরী। যা জীবনকে অন্য রুপ দেয়। মায়া ঠিক তেমনি চায়। তার জীবনে এমন কেউ আসুক শুধু মাত্র তাকেই চাইবে। অন্য কোন লোভে নয়। মায়ার হৃদয়ে যে ভালোবাসা পুষে রেখেছে সেই সঠিক মানুষটি অবশ্যই আসবে। তার অপেক্ষা দিন শেষ হবে একদিন।
৮. ইদানিং আম্মার শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে। রাত জাগার জন্য মাথা সমস্যা বেড়েই চলছে। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়ে তিন মাসের ঔষুধ কিনে নিয়ে এসেছে মায়া। ডাক্তার বলেছে- রাতজাগা যাবে না। আম্মাকে শত বুঝালেও বুঝেন না। মাঝে মাঝে মায়ার কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। তার জন্যই হয়তো আম্মার শরীরটা দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু মায়া তো এটা কখনো চাইনি।
৯. প্রেম যে আসেনি তা নয়। মায়াকে যারা প্রেমের কথা বলত তাদের মুখে বন্ধুত্ব মনে প্রেমিকা ভাব থাকলোও আসলে তারা কখনো ভালোবাসার যোগ্য ছিলো না। বুঝে নিতো দেখে দূরে থাকতো এসব থেকে। প্রেম কিংবা ভালোবাসা যাকে ইচ্ছে তার সাথে হয় না। সম্পূর্ণ মনের ব্যাপার। চাওয়াটা নিখুঁত হলে পাওয়াটাও সুনিশ্চিত হতো। মুখে বন্ধুত্ব আর মনে প্রেম রেখে অনেকে বিরক্ত করে ফেসবুকে কিছু ছেলে ফেন্ডরা। তার কিসের এত অহংকার। কেন পাত্তা দেয় না। কি আছে তার? কত কথা শুনতে হয়। না কি তার মনে ভেতরে বাইরে এক? কেউ কেউ তাকে বলেই ফেলতো। তোমার শরীর বলে কিছু নেই। তাদের তাচ্ছিল্যভরা কথাকে মায়া পাত্তাই দিতো না। যদি পাত্তা দিতো এতদিনে হয়তো প্রেমটেম হয়ে যেতো। মায়া কখনো মনের সাথে আপোষ করে না। জীবন চলার পথে অনেক সমস্যা থাকবে। মনের শক্তি দিয়েই মায়া হেঁটে চলে। মায়ার পরিবার আত্মীয়-স্বজন সবার কাছে বিয়ে নিয়ে কথা শুনতে হয়। মায়া জানে জীবনের মত সমস্যাগুলো চিরস্থায়ী নয়। জীবনে সমস্যা থাকবেই। তাই বলে কি হেরে যেতে হবে কিংবা পালিয়ে যেতে হবে।
১০. মায়া তখন অফিসে কাজে প্রচন্ড ব্যস্ত ঠিক তখনই মায়ার খালোত বোন হালিমার কল। বাসায় দ্রুত আসতে বলে। আপা কি হয়েছে? আম্মা ঠিক আছে তো। ফোন রেখে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসা ফিরে মায়া।
-ড্রইংরুমে গেস্ট আছে।
-হালিমা আস্তে করে মায়াকে বলে, ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শাড়িটা পর।
-মানে কি হালিমা আপা? আমাকে কিছু বলছো না কেন?
-তোকে পাত্রপক্ষরা দেখতে আসছে।
-আমাকে আগে বলবে না কি? হুট করে এমন করা ঠিক হয়নি। মনের ত একটা প্রস্তুতি লাগে। আমার ইচ্ছে করছে না পাত্র পক্ষদের সামনে যেতে। না করে দাও। আমি মানসিকভাবে এখনো রেডি না।
-হালিমা জবাব দেয়-বিয়েতে এত প্রস্তুতি নিতে হয় না। আমরা চাচাতো খালোতো বোনদের সবাই বিয়ে এমনি করে হুটহাট হয়ে গেছে। তোর বুঝার মত বয়স হয়েছে। কেউ পছন্দ থাকলে বল। তার সাথে বিয়ে দিবো।
-পছন্দের কেউ নেই। তোমরা তো বিয়ে করে কেউ সুখি না। তাহলে আমাকে কেন বিয়ের কথা বলছো। আমি তো তোমাদের সংসার জীবন ব্যথিত ছাড়া কিছুই দেখি না। দুনিয়ার সব মানুষের এক পাল্লায় নিলে হয় না। ব্যতিক্রম কেউ কেউ থাকে। দেখবি তুই বিয়ের পর সুখি হবি। এত কষ্ট করতে হবে না। সবার কথা রাখতে মায়া রেডি হয়ে পাত্র সামনে আসে। নাম আর কিসে জব করছে শুধু এতটু জানতে চেয়ে কথা বলা শেষ হলে মায়া রুমে আসে। মুখ ভার করে বসে থাকে। ঘটক মহিলা কাছে মায়ার ছবি দেখেই ছুটে আসছে সরাসরি কনে দেখবে পাত্র।
-ঘটক মহিলা আম্মাকে বলছে-আপা দেখবেন এবার আপনার মেয়ে বিয়ে হবেই। ছেলে বলল, মেয়েকে পছন্দ হয়েছে। পরিবারের সাথে কথা বলে তাদের নিয়ে আসবে। ঘটক মহিলাকে আম্মা শম্পার মা বলে ডাকে। কথা শেষ হতেই শম্পার মার হাতে ২০০ টাকা তুলে দেয়। আমার খুব রাগ হলেও বুঝতে দেই না। বিয়ের জন্য যখন যা বলে আম্মা তাই করে। কখনো হুজুরের কাছে কখনো কবিরাজ। এসবে মায়ার কোন বিশ^াস নেই। মায়া সব ভরসার আশ্রয়স্থল আল্লাহ তার জন্য যতেষ্ট। মায়াকে যে পাত্র দেখতে এসেছে সে ইউনির্ভাসিটির লেকচারাল। বেশ লম্বা, শ্যামলা রং। পাঞ্জাবি পরাতে ভুরিটাকে তেমন বুঝা না গেলো। শার্ট পরলে নিশ্চিত পেট বের হয়ে যেতো। মায়া হালকাভাবে একনজর দেখেই চোখে দুটো নিচের দিকে নিয়ে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটি হাসিখুশি প্রাণবন্ত। কথা শুনে মনে হয়েছে তার পছন্দ হয়েছে। বৃষ্টি শুধু আনন্দের দিনে আসে না কষ্টের সময়ও আসে। হঠাৎ করেই বৃষ্টি ঝড়তে লাগলো বাইরে। ঘরের সবার চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। যেনো আজকেই মায়ার বিয়ে। মায়ার বৃষ্টি ভালো লাগলো এইসময়ে বিরক্ত লাগছে। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থামতেই পাত্র ও ঘটক মহিলা চলে যায়। এ পর্যন্ত মায়াকে যারা দেখতে আসছে তারা প্রত্যেকেই লোভী। তাদের চাহিদার শেষ নেই। কেউ বলে বাসা ভাড়া। নিজেদের বাসা নেই। কেউ বলে কনে তো চাকরিজীবী। সে আবার কিসের সংসার করবে। চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। পাত্র পরিবারের অজুহাতের শেষ নেই। এই জন্য মায়া প্রতিজ্ঞা করেছে। যে ছেলে শুধু তাকে ছাড়া আর কিছুই চাইবে না। তাকেই বিয়ে করবে। মেয়ের বাবা চায় একজন ভালো মনের সত মানুষের হাতে তার কলিজা টুকরোকে তুলে দেবে। ছেলের বাবারা চায় রূপ সম্পদ বাড়ি গাড়ী ইত্যাদি। মায়া এসব শুনতে শুনতে কান পচে যাচ্ছে। এ যুগের মানুষ এখন ক্যারিয়ার স্ট্যাটাসকে বিয়ে করে। মানুষ মানুষকে বিয়ে করলে এত পরকিয়া হত না আর সংসার ভাঙ্গতো না।
১১. তিন দিন পর ঘটক শম্পার মা কল দিয়ে আম্মাকে জানায় পাত্র না করে দিয়েছে। আম্মা কারণ জানতে চায়।
-মহিলা বলে-ছেলের চেয়ে মেয়ের বয়স বেশি। আম্মা মন খারাপ করে ওজু করে নামাজে বসেন। এবারও বিয়ের আলাপটা চলে গেলো। মায়া মন খারাপ হয় ঘরের সবার মন খারাপ দেখে। দিনের আলো চেয়ে রাতের অন্ধকারে একাকীত্ব ভীষণ প্রিয় মায়ার কাছে। তাই রুম লাইট অফ করে শুয়ে থাকে। তার মাথায় ঘুরঘুর করছে পাত্রকে কিছু একটা বলবে। বিয়ে করুক না। কিন্তু না করা একটা ভদ্রতা আছে। তাই বলে বয়স বেশি এটা কেমন কথা। হালিমা আপা পাত্র সিভি আর ছবি ওযার্সআপে দিয়েছিলো। মায়া চেক করে সেখান থেকে নাম্বারটা নিয়ে কল দেয় ঘটক মহিলার সাথে আসা সেই পাত্র শামীমকে।
কয়েকটা রিং হবার পর রিসিভ করে-মায়া হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বলে ওঠে কে বলছেন? সালাম দিয়ে মায়া বলে, শুক্রবারে যে মেয়েকে পাত্রি হিসেবে দেখতে এসেছিলেন আমি সেই। আপনার সাথে কিছু কথা বলার ছিল।
শামীম খুব বিনয়ী হয়ে বলে- আপনি কেমন আছেন?
-জি ভালো। শামীম জানায়, আমি মোটরসাইকেল আছি। বন্ধুর বিয়েতে যাচ্ছি। ফ্রি হয়ে কল দিবো আপনাকে। কল কেটে দেয় মায়া আর মনে মনে বলে নিজের বিয়ের বারোটা বাজিয়ে বন্ধুর বিয়ে খাচ্ছে।
মায়ার মনখারাপে সময় কাটে বারান্দা দাঁড়িয়ে। বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে একা একা কথা বলে। আম্মা অনেক নিষেদ করেন রাতের বেলা বারান্দা না আসতে। কিন্তু মায়ার যে আকাশ আর তাঁরাদের সাথে কথা না বললে ভালো লাগে না। বিষন্নতা আরো চেপে বসে। মন খারাপের সব কথা আম্মাকে না বললেও আকাশের বুকে তাঁরাদের বলতেই হয়।
১২. রাত তখন ১০টা।
শামীমের কল- কেমন আছো তুমি। কথা শুনেই মায়ার রাগ ওঠে।
-একদিনেই আপনি থেকে তুমিতে চলে আসছেন। এতটা আপন আমি নয়। আপনাকে কল দেবার কারণ হলো-আপনি নাকি ঘটক মহিলাকে বলেছেন আপনার চাইতে বয়সে বড়। নিজের চেহারাটা আয়না দেখেছেন। আগে নিজে দিক ভাবুন পরে অন্যেকে নিয়ে সমালোচনা করুন। পছন্দ না হলে বলতেন পছন্দ হয়নি। বয়স বেশি এটা বলার দরকার কি ছিলো। নাচতে না জানলে উঠান বাকা। মায়া একনাগারে কথা বলে যায়।
-শামীম হু-হু হা-হা অট্টোহাসি দিয়ে বলে- তোমাকে কে বলল এসব।
-আবার আমাকে তুমি করে বলছেন।
-আমাদের মাঝে এমন কিছুই হয়নি যে তুমি বলতে হবে।
-আচ্ছা স্যরি-শামীম জবাব দেয়-আমি ঘটক মহিলাকে কিছুই বলেনি। আসলে ঘটকদের কাজ টাকা না দিলে হয় না। মহিলাকে টাকা দিছি না বলে সে উল্টাপাল্টা কথা বলেছে। যাক সে কথা। এক উছিলা তো তোমার সাথে কথা হলো। কথা বলে আমার বেশ ভালো লাগছে। বিয়েটা তাহলে করা যায়। মায়া উত্তর দেয়-না। কাউকে চিনলে একমুহুর্ত চিনা যায়, না চিনলে সারাজীবনও চিনা যায় না। আপনি রাজি থাকলেও আমি আপনাকে বিয়ে করবো না। আর কখনো বিয়ে প্রস্তাব দেবার সাহস করবেন না। শামীমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মায়া মোবাইলের লাইনটা কেটে দেয়। বারান্দা থেকে মায়া রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে পরে।
১৩. মোবাইলের রিং হতেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। মায়া ভেবেছে ঘড়ির এর্লান। সকাল হল বুঝি। ঘুমের মাঝে লাইন কেটে দিয়ে টাইম দেখে পৌনে ১টা। এত রাতে কে কল দিলো। অপরিচিত নাম্বার তাই ব্যাক না করে মোবাইল অফ করে দেয়।
কিছুক্ষণ পর ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেস শব্দ-
-মাই ডিয়ার মিস ইউ।
-কেমন আছো। কি খবর তোমার?
-নতুন কোন বিয়ের আলাপ আসছে কি তোমার? কল দিলাম রিসিভ করলে না যে। সিমে টাকা নাই তাই অন্য নাম্বার কল দিছি। এতরাতে ফাহিমের ম্যাসেস দেখে তেমন অবাক হয় না। কারন সে মায়ার খুব ভালো বন্ধু ফাহিম। মনের সব কথা যাকে শেয়ার করতে পারে। ফাহিম শুধুই বন্ধু। তবে ইদানিং সে মায়াকে খুব জালাচেছ। মায়াকে সে ভালোবাসে। একথা বলার পর থেকে মায়া এড়িয়ে চলে। প্রেম হলে বন্ধুত্ব আর থাকে না। ফাহিম আঠার মত লেগেই আছে।
-ফাহিম ম্যাসেস দিয়ে বলছে-তোমার বিয়ে ফুল যেনো আরলি ফুঁটে আর আমার সাথেই যেনো বিয়েটা হয়ে যায়। পিক দেই কয়েকটা আমার। কক্সবাজারে গিয়েছিলাম। দেখবে।
মায়া উত্তর দেয়-পিক দিয়ে কি হবে? তোমার পিক দেখার শখ নেই। অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও।
ফাহিম বলে-বয়স বাড়ার সময় নেই। পিক দিব তুমি দেখবে।
পিক এর মানুষটাকে পেতে চাও।
-মায়া ম্যাসেস দেয় -বয়স বাড়তে থাকুক। জীবন চলুক নদীর স্রোতের মতই। জীবন চলুক জীবনের মতই। যে জীবনে আনন্দ আর দু:খ আছে। চাওয়া না পাওয়া যে জীবনে সবই আছে। মানুষের জীবন হচ্ছে দীর্ঘ একটি ছোট গল্প। সেই গল্পে পরতে পরতে আনন্দ-বেদনাকে সাথে নিয়ে জীবনের গল্প চলুক।
ফাহিম ম্যাসেস দিচ্ছে- আমাকে পছন্দ করো না তুমি।
-বল? তোমাকে ভীষণ পছন্দ করি আমি।
– তোমার সবকিছু। ওভার এল লাইফ।
-তুমি একটা অধরা ফুটন্ত লাল গোলাপ। সত্যি তুমি অসাধারণ। তোমার সব। তোমার ঘ্রাণ। কত যে সুমিষ্টি হবে। ভেবে পাই না।
-পাঁপড়ি পাঁপড়ি আর…।
-তোমার হাসি অসাধারণ। গোলাপের মত। তুমি যে কি। তুমি নিজেও জানো না। তোমাকে বুঝার সাধ্য সবার নাই।
মায়া জবাব দেয়- মানে কী? আমাকে এত বুঝা লাগবে না। আমাকে বিরক্ত না করে ঘুমা।
ফাহিম আবার ইনবক্স ম্যাসেস দিচ্ছে- আমি বানিয়ে কিছু বলছি না।
-রিয়েল বলছি। লাইক ইউ এন্ড লাভ ইউ মাই ডিয়ার। ইউ আর সো লাভলী, সুইট। তুমি একটা রসগোল্লা। রসগোল্লার মত রুপ রস টপটপ করছে। অমৃত।
-ও মাই ডিয়ার।
-মিস ইউ। ইস। তুমি যদি এখন পাশে থাকতে। রোমান্টিক নাইট হতো। আমার তো ঘুমই হত না। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি সময় তুমি কাছে থাকলে অনেক রোমান্টিক সময় কাটতো। উফ ভাবতেই ভালো লাগছে। প্লীজ কল দাও। কথা বলব। ফাহিম কল দিতেই মায়া লাইন কেটে দিয়ে অফ করে দেয়। ফাজিল একটা। রাতে বেলা তার যতসব ফালতু কথা মনে পড়ে।
১৪. শুধু ফাহিম নয়। তার মত করে এমন অনেকেই মায়াকে প্রেমে জড়াতে চায়। কিন্তু মায়া খুব বাস্তববাদি মেয়ে। জীবনের পথে হিসেব করে চলতে হয়। তার কাছে পরিবারের সম্মান সবার আগে। এমন কিছু সে করবে না যাতে সবাই কষ্ট পায়। পরিবারের পছন্দ পাত্রকেই বিয়ে করবে। তাই প্রেমটেম ধারে কাছে আসতে দেয় না। গতকয়েক বছর ধরে তাকে ফলো করে ফেরদৌস। কিন্তু সাহস করে মায়ার সাথে কথা বলেও বলতে পারে না। কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে মায়াকে ম্যাসেস দিতো ফেরদৌস। কে তাকে ফলো করে কে তাকে পছন্দ করছে এসব নিয়ে মায়ার কোন কৌতুহল নেই। একদম জরুরী ম্যাসেস ছাড়া তেমন উত্তর দিতো না। একদিন ফেরদৌস ম্যাসেস না দিয়ে কল দিলো। মায়াকে তার পরিচয় দেয়। মায়া জবাব দেয়, দেখুন আপনাকে চিনতে পারিনি। তাই অপরিচিত কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে নেই। ফেরদৌস বিনীয় অমায়িক হয়ে খুব ধীরে বলছে। আপনাকে কিছু কথা বলার ছিলো। যে কথাগুলো এতদিন থেকে আমার হৃদয়ে বন্দি হয়ে আছে। না বলতে পারাটাও এক ধরনের কষ্ট অনুভব করছি। বুকের ভেতর ছটফট করছে। তাই আজকে সাহস করে আপনাকে কল দিলাম বলার জন্য। মায়া তখন কিছুটা থমকে যায়। ফেরদৌসের কথা শুনে ভদ্রতা দেখিয়ে তখন তার কথা শুনে। মায়াকে কেন ফলো করে, পছন্দ করে। এখন ফাইনেলি বিয়ে জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আপনার বাপের বাড়িতে কি আছে না আছে আমি এসব জানতে চাই না। আমি আপনাকে ভালোবাসি। সারাজীবন একসাথে থাকতে চাই। ফেরদৌসের কথা শুনে মায়া অবাক হয়ে বলে দেখুন, আমাদের পরিবার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। বিয়ে বলাটা সহজ করাটা কঠিন। আমার পরিবার বলতে আমরা দুই বোন আর মা। বাবা অনেক আগেই মারা গিয়েছে। আমাদের পরিবারের একটা সময় অনেক আভিজাত্য ছিলো। আম্মার কাছে শুনেছি বাপদাদারা গ্রামের অর্থকর্তা ছিলেন। এখন সেইসব আমাদের কাল্পনিক রুপকথা গল্পের মতই। মায়ার কথা শুনে ফেরদৌস জানায় আমি তো আগেই বলেছি। আপনাকে শুধু চাই। আমার মাবাবাকে আপনার কথা জানিয়েছি তাদের কোন আপত্তি নেই। আমার পছন্দ তাদের পছন্দ। তবে এই মহুর্তে বিয়ের আলাপ দেবো না। একটু গুছিয়ে নেবার পর। নিজের পছন্দ অন্যের উপরে চাপিয়ে দেওয়াটা অন্যায়। তাই উত্তরের অপেক্ষা থাকবো। সেদিনের পর ফেরদৌসের কথা মায়া এতটা পাত্তা দেইনি। সব ছেলেদের মতই ফেরদৌস পলাতক হবে। মাঝেমধ্যে ইনবক্স ম্যাসেস মায়ার খোঁজখবর নেয় ফেরদৌস। সপ্তাহ মাসের পর মাস, মায়া হাল ছেড়ে দিলোও ফেরদৌস লেগে আছে। বেলাশেষে মায়া ঘরে ফিরে বারান্দা টবগুলো দেখলেই মন ভেতরে একধরনে আনন্দ অনুভব করে এই ভেবে গাছেরাও প্রতিবছর তাদের সবুজ পাতা হারালোও কিছুদিন অপেক্ষার পর আবার নতুন করে সবুজ পাতা ফিরে পায়। তেমনি প্রতিটি অন্ধকারে পরই প্রকৃতি নিয়মে মানুষের জীবনেও আসে সুন্দর সবুজময় সকাল। মায়াও সেই সকালের অপেক্ষায়।
১৫. অফিস থেকে ফেরার পর আম্মা জানায় আশার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। খুব ভালো খবর আম্মা, আশা রাজী থাকলে বিয়ে দিয়ে দেও। কিছুটা রাগ করে আম্মা জবাব দেন, বড় মেয়েকে রেখে ছোট মেয়ের বিয়ে কখনো দেবো না। তোর ব্যবস্থা হবার পর আশাকে দেবো। মায়া ত নিজের জীবন নিয়ে কোন ভাবনা নেই। কিন্তু ছোট বোন যে বিয়ের বয়স হয়েছে তার বর হোক ঘর হোক মায়া চায়। যে পরিস্থিতির সাথে লড়াই করে সে খুশিতে থাকে। মায়া মনকে কখনো বুঝায় মন কখনো মায়াকে বুঝায়। পৃথিবীতে কেউ পারফেক্ট না। সবাইকে মানিয়ে চলতে হয়। মায়া মনের ভেতর নিজেকে স্থির করে বিয়ের জন্য। প্রায়ই ফেরদৌনের কথা মনে পড়ে। কেন এ মানুষটির কথা কানে এসে বাজে। সারাজীবন এক সাথে পথ চলতে চায়। ফেরদৌসের কথায় একধরনের সাহস শক্তি অনুভব করে। যোগ্যতা দিয়ে চাকরি হয় সম্পর্ক নয়। মাবাবার একমাত্র ছেলে ফেরদৌস। সেও ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার। ফেরদৌস আবার নক করলে না করবে না। মায়া তো চেয়েছিলো যে তাকেই শুধু চাইবে সেই ছেলেকেই বিয়ে করবে।
১৬. তিন বছর পর…।
ফেসবুকে মায়া স্ট্যাস্টাস দেয় -দুজন মানুষের পছন্দ অপছন্দ মিলিয়ে সেসব মানিয়ে নেয়ার মাধ্যমেই তো একটি পূর্ণাঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় শুধু একজন ব্যক্তিকেই সবকিছু মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়, যেন মনে হয় দাঁতে দাঁত চেপে সবকিছু সহ্য করে সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব শুধুই একজনের! চোখে সামনে অনেকেই এমন করে সংসার করতে দেখে বিয়ে নামক শব্দ থেকে দূরে ছিলাম। পথ চলার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য কাউকে না কাউকে খুঁজে নিতে হয়। পরিবারের পাশাপাশি আরও একজন কে প্রয়োজন পরে আর সে হল মনের মানুষ। বাবা মায়ের পরে দ্বিতীয় তো তাকেই একজন নারী ভালোবাসে। যে মানুষটি জীবনের কঠিন সময় সুখেদু:খে পরম ভালোবাসায় পাশে থাকে! তোমার কাছ থেকে জেনেছি খুব সাধারণ জীবনযাপনে মন তৃপ্তি থাকার জন্য সুখি হতে লাগে শুধু ভালোবাসা আর যত্ন বিশ^াস, সহযোগি-সহমর্মিতা। আমার কাছে সংসার মানে তুমি এবং তুমি। আমার হৃদয় ভরা প্রেম-সৌন্দর্য-সফলতা-ব্যর্থতা শুধু বলি যে ভালোবাসা ও সম্মান তোমার কাছ থেকে পেয়েছি। আমার জীবন সংসারের সবচে সেরা সফলতা প্রাপ্তি। এভাবেই আজীবন ভালোবেসো প্রিয়। রিমঝিম বৃষ্টিতে কিংবা ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে গেলে আমার স্বপ্নরা ডানা মেলে, ইচ্ছে করে ঠিক তেমনি প্রতি বর্ষায় শুধু নয় প্রতিটি বসন্তের কোকিলের ডাক শুনে তোমার হাতটি ধরে আমি ঝুম বৃষ্টিতে হাজারও বছর বাঁচতে পারি, ভিজতে পারি।
শুভ বিবাহ বার্ষিকী আমার মেয়ের বাবা
”আমার প্রিয়তম”!