বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মার্চ ২০২১, ৪:১৩:১৯ অপরাহ্ন

রাজীব সরকার
বুদ্ধদেব বসু অবিস্মরণীয় কীর্তি পঁচিশ বছর ধরে ‘কবিতা’ পত্রিকা সম্পাদনা করা। কবিতার পাশাপাশি এ পত্রিকায় সমকালীন সাহিত্য সম্পর্কে নিয়মিত সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। বুদ্ধদেব বসু নিজেও সৃজনশীল সাহিত্য সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দেশ-বিদেশের উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন। এ ক্ষেত্রেও তার রবীন্দ্রানুরাগ স্পষ্ট। অন্ধভক্তি নয়, যথার্থ সাহিত্যরসিক হিসাবেই রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনা সম্পর্কে ‘কবিতা’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তাকে উপলক্ষ্য করে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা ‘রবীন্দ্রসংখ্যা’ প্রকাশ করেছে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে ‘কবিতা’ পত্রিকার ‘রবীন্দ্রসংখ্যা’। রবীন্দ্রনাথের আশি বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ২৫ বৈশাখ ১৩৪৮, ৮ মে ১৯৪১ তারিখে এটি প্রকাশিত হয়। বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদনায় এ সংখ্যাটির লেখক তালিকা ছিল চোখ ধাঁধানো- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায়, যামিনী রায়, প্রমথনাথ বিশী, অমিয় চক্রর্র্বতী, অন্নদাশঙ্কর রায়, হুমায়ুন কবির, বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, জ্যোতির্ম্ময় রায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অজিত দত্ত, প্রভু গুহঠাকুরতা, হিমাংশুকুমার দত্ত, সুধীরচন্দ্র কর, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত এবং বুদ্ধদেব বসু।
ঠাকুর পরিবারের অন্যতম প্রতিভা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘রবিকাকার গান’ শীর্ষক স্মৃতিচারণায় ঠাকুরবাড়ির সাংগীতিক আবহে রবীন্দ্রনাথের বিকাশের পটভূমি তিনি মনোজ্ঞ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন-
‘তিনি (রবীন্দ্রনাথ) লিখেছেন- আমি চ’লে যাবো, নতুন পাখি আসবে। কিন্তু নতুন পাখি আর আসবে না।
একলা মানুষের কণ্ঠে হাজার পাখির গান। আমার এখনো মনে হয় তার সব রচনার মধ্যে- লেখাই বলো, ছবিই বলো- সব চেয়ে বড়ো হচ্ছে তার গানের দান।’
প্রমথ চৌধুরী তার লেখায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কের সূত্র ধরে হƒদয়গ্রাহী আলোচনা করেছেন-
‘আমি এর পূর্ব্বে রবীন্দ্রনাথের মত সুপুরুষ কখনো দেখিনি। তার বর্ণ ছিল গৌর, আকৃতি দীর্ঘ, কেশ আপৃষ্ঠ লম্বিত ও কৃষ্ণবর্ণ, দেহ বলিষ্ঠ, চম্ম মসৃণ ও চিক্কন, চোখ-নাক অতি সুন্দর। রবীন্দ্রনাথ সেকালে গায়ে জামা দিতেন না। পরতেন একখানি ধুতি আর গায়ে দিতেন একখানি চাদর। সুতরাং তার সর্ব্বাঙ্গ দেখবার সুযোগ আমার হয়েছিল; উপরন্তু তার সর্ব্বাঙ্গ ছিল প্রাণে ভরপুর, প্রাণ তার দেহে ও মুখে টগবগ্ করত। তিনি ছিলেন একটি জীবন্ত ছবি। রূপের যদি প্রসাদগুণ থাকে ত সে গুণ তার দেহে ছিল। তিনি (রবীন্দ্রনাথ) যে একজন লোকোত্তর পুরুষ, আজ তা সকলে স্বীকার করবেন। তিনি কায়মনোবাক্যে পরিচয় দিয়েছেন যে, তার বিচিত্র জীবন হচ্ছে একটি জীবন্ত কাব্য, যা শতদলের মত ফুটে উঠেছে।’
‘আমাদের ছাত্রাবস্থা ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে অতুলচন্দ্র গুপ্ত একটি বিশেষ সময়কে উপস্থাপন করেছেন। বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনের সময় সমগ্র দেশজুড়ে যখন উত্তেজনা তখন ছাত্রসমাজ প্রেরণা পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। তার কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গান নিয়ে তখন তুমুল হইচই। ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’, ‘মোদের যাত্রা হলো সুরু এখন ওগো কর্ণধার’, ‘বিধির বিধান কাটবে তুমি এমন শক্তিমান’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে’ প্রভৃতি কালজয়ী গান এ সময়ের ফসল।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘বাকপতি শ্রীরবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধের ভাষাবিজ্ঞানী হিসাবে রবীন্দ্রনাথের অবদান সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন। তরুণ বয়সে বাংলা উচ্চারণ ও শব্দতত্ত¦ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার শিল্পীসত্তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রখর বিজ্ঞানমনস্কতা। সুনীতিকুমারের তীক্ষ্ পর্যবেক্ষণ-
‘রবীন্দ্রনাথের চিত্তে একাধারে অপার্থিব রসানুভূতিও বস্তুতন্ত্র বিজ্ঞানের অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়; সেই জন্যই তাহার রচনা ও আলোচনা উভয়ই কল্পনা ও বিজ্ঞানের আলোকে উজ্জ¦ল।’
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস সম্পর্কে অসামান্য আলোচনা করেছেন। বাংলা উপন্যাসের সার্থক ¯্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের তুলনা করে নীহাররঞ্জন রায় রবীন্দ্র উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি নির্ধারণ করেছেন।
সর্বত্রগামী প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ সত্তর বছর বয়সে ছবি আঁকা শুরু করেন। মাত্র দশ বছরের সাধনায় তিনি ভারতীয় চিত্রকলায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। খাঁটি ইউরোপীয় আঙ্গিকে তিনি ছবি এঁকেছেন। তার শ্রেষ্ঠ ছবিগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিনি একজন নবীন চিত্রকর। কল্পনার অসামান্য ছন্দোময় শক্তিতে তিনি অনভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতা পূরণ করেছেন। যামিনী রায় রবীন্দ্রনাথের ছবি সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ অথচ লক্ষ্যভেদী মূল্যায়ন করেছেন। ‘রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি’ প্রবন্ধে অমিয় চক্রবর্ত্তী রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাধনা ও কর্মজীবনের উৎসকে এক বিন্দুতে মেলাতে চেয়েছেন। তার ভাষায়-
‘আশি বৎসরের ধ্যানে মানুষের দুঃখকে তিনি (রবীন্দ্রনাথ) ভোলেননি, মানুষকে বিশ্বাস করেন বলেই তার ভ্রষ্টতা তাকে বিঁধছে। হন্যেনীতিকে আর্থিক বা পারমার্থিক অঞ্জলি দেননি- যে-পক্ষেরই হোক- কেননা পাপের প্রসারে মানুষের ক্ষতি। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি ভয়হীন, কেননা তা কারুণিক এবং দলীয় স্বার্থের বিরোধী।’
আশি বছরের জীবনকে প্রকৃত অর্থেই ফলবান করে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ব্যক্তিজীবনও শিল্পীজীবনের মধ্যে অপূর্ব ভারসাম্য রক্ষা করে তিনি যে অনন্যসাধারণ সার্থক জীবনের উদাহরণ তৈরি করেছেন এর তুলনা কোথাও নেই। ‘রবীন্দ্রনাথের শেষজীবন’ প্রবন্ধে অন্নদাশঙ্কর রায় রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র কর্মস্পৃহা ও অন্তহীন জীবনজিজ্ঞাসার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। শিল্পসাহিত্যের বিচিত্র ভুবন, জমিদারি, কৃষিকাজ, প্রজাহিতৈষী নানা উদ্যোগ রবীন্দ্রনাথের কর্মযজ্ঞ বিরামহীন। পতিসরে তিনি দরিদ্র প্রজাদের আন্তরিক সুহƒদের ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্রজাদের অধিকাংশ ছিলেন মুসলমান। রবীন্দ্রনাথকে তারা বলেছিলেন, ‘পয়গম্বরবে আমরা চোখে দেখিনি।
সংক্ষিপ্ত, অথচ তীক্ষ্ধী একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের জীবনব্যাপী মানবধর্ম সাধনার প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন হুমায়ুন কবির। জীবন ও সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ কর্মযোগী। বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি যদি মেলেও, সেই মুক্তি চাননি রবীন্দ্রনাথ। অসংখ্য বন্ধনের মধ্যে মহানন্দময় মুক্তির সাধনা করেছেন তিনি। এভাবেই মনুষ্যত্বকেন্দ্রিক সাহিত্য সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। মনুষ্যত্বের সাধনাই তার জীবনাদর্শ। এ জীবনদর্শন অত্যন্ত ইতিবাচক। তাই আশিতম জন্মদিন উপলক্ষে প্রদত্ত অভিভাষণে মানবধর্মে তীব্র আস্থাবান রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে শুনি-
‘মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্ম্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্ব্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরিচিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে যাবার পথে। মানুষের অন্তহীন, প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ বলে মনে করি।’
‘রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প’ শীর্ষক আলোচনায় জ্যোতির্ম্ময় রায় রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে উত্থাপিত কয়েকটি অভিযোগ খণ্ডন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গল্প সমাজ জীবনের বিশেষ কোনো একটি দিকে ঝুঁকে পড়েনি। মানবসভ্যতার বহুমাত্রিক ও মানবমনের বহুকৌণিক চিত্র নৈপুণ্যের সঙ্গে রূপায়িত হয়েছে তার গল্পে। রবীন্দ্রনাথ নিুবিত্তের জীব নিয়ে কিছু লেখেননি, শ্রেণিবৈষম্যের চিত্র অনুপস্থিত তার রচনায় এমন অবান্তর অভিযোগ যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন তিনি-
“রবীন্দ্রনাথের কোনো গল্পেই তিনি শ্রেণী-চেতনা বা শ্রেণী-বৈষম্যকে বড় ক’রে দেখাতে প্রয়াস পাননি, বেশির ভাগ গল্পেরই পশ্চাৎপট ব্যাপ্ত ও সার্ব্বজনীন। বোষ্টমী কঙ্কাল, ক্ষধিত পাষাণ, গুপ্তধন, কাবুলীওলা : এসব গল্পে শ্রেণী বা জাতিটা নেহাৎই যেন আকস্মিক ও অকিঞ্চিৎকর- মানুষের কথাটাই বড়। মানুষের প্রতি দরদ ও সহানুভূতিতে গল্পগুলো এমন তাজা, মনে হয় প্রতিটি চরিত্র গা ঘেঁষে ঘোরাফেরা করছে। ‘স্ত্রীর পত্র’- খানি বাঙলা সাহিত্যের এক অনবদ্য বস্তু। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর মতে এ যেন বাঙলার মেয়েদের এক মর্মন্তুদ ম্যানিফেস্টো। সমগ্র চিঠিখানিজুড়ে গভীর আবেগও দরদের সঙ্গে তীক্ষ্ শ্লেষ ও যুক্তির কী অপূর্ব সংমিশ্রণ ‘হালদার গোষ্ঠী’র মতো গল্পে পাই ক্ষয়িষ্ণু ধনী পরিবারের পরিচয়, ‘শাস্তি’র মতো গল্পে ফুটেছে নিম্নশ্রেণীর নিখুঁত প্রতিচ্ছবি।”
প্রভু গুহঠাকুরতা ‘রবীন্দ্রনাথের নাটক’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, রবীন্দ্রনাথের নাটকের অধিকাংশ চরিত্রই তার নিজের মতো কবি চরিত্র- কবির নিজের জীবনের আদর্শই নাট্যরূপ পেয়েছে তার হাতে। তাই তার নাটকে গান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এ গীতলতাই জড়বাদী সমাজ ও যান্ত্রিক সভ্যতার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে।
‘কবিতা’র রবীন্দ্র অর্ঘ্যে সবচেয়ে মূল্যবান পুষ্প অর্পণ করেছেন স্বয়ং সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু। তিনি লিখেছেন-
‘আসলে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিরাট কবিপ্রতিভা ও গীতপ্রতিভার যে অদ্ভুত মিলন হয়েছে, এ মিলনই বোধ হয় এর আগে কোনো মানুষে কখনো হয়নি। এত বড়ো কবি গান গেয়েছেন কবে, আর কোন দিগিজয়ী কবিপ্রতিভা গান বাঁধবার নেশায় ক্ষেপেছে এ দুয়ের সম্মিলন হয়েছে, এমন আর যে ক’জনের কথা মনে করা যায়, সকলেই ছোটো কবি। গানে তাই রবীন্দ্রনাথ রাজা, এ তার এমন সৃষ্টি যেখানে কোনো প্রতিযোগী নেই। কবিতায়, গল্পে উপন্যাসে, নাটকে প্রবন্ধে সমালোচনায় তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন নানা দিক দিয়ে তার তুল্য অনেকেই; গানে তার মতো কেউ নেই। গান তার সবচেয়ে বড়ো, সবচেয়ে ব্যক্তিগত ও বিশিষ্ট সৃষ্টি; সমগ্র রবীন্দ্র-রচনাবলীর মধ্যে গানগুলি সবচেয়ে রাবীন্দ্রিক।’
‘কবিতা’ পত্রিকার ইতিহাসে রবীন্দ্র সংখ্যা এক অবিস্মরণীয় আয়োজন। সমকালীন শ্রেষ্ঠ লেখকগণ রবীন্দ্র প্রতিভার মূল্যায়নে অসামান্য আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এই পত্রিকা এমন এক সময়ে প্রকাশিত হয় যখন রবীন্দ্রনাথের জীবনীশক্তি অবসানের পথে। শুধু ‘কবিতা’ পত্রিকার নয়, বাঙালি পাঠকমাত্রেরই সৌভাগ্য যে রবীন্দ্রনাথ জীবনমঞ্চ থেকে বিদায় নেওয়ার আগেই তার হাতে অমূল্য রবীন্দ্র-সংখ্যাটি পৌঁছেছিল।