বয়ান-বন্দনায় বর্ষা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ আগস্ট ২০২২, ৬:১৩:২৯ অপরাহ্ন

আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্
ঋতুর বৈচিত্র্যে বাংলাদেশে অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসে বর্ষা। আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির অনুপ্রেরণা পৃথিবী তার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে আষাঢ়-শ্রাবণ কে নিয়ে তার পদার্পণ পুরো বাংলায়। ছয় ঋতুর দেশে বাকি পাঁচ ঋতু চোখ খোলে,বুক বাঁজিয়ে এলেও বর্ষা আসে তার নিজস্ব গুরুগম্ভিরতা নিয়ে। আসে মহাসমারোহে। কখনও আকাশের নীল শাড়ি খুলে কালো শাড়ি পরিয়ে। কখনওবা আকাশকে কাঁদিয়ে। তখন বাংলার আকাশে ঘন ঘন চোখ তুললেই দেখা যাবে-আকাশের উদর থেকে তারকারাজি গুরুগম্ভির অথচ বজ্র ধ্বনির বিকাশে, তুমুল হরষে বাংলার জমিন বরাবর নেমে আসে বলে বর্ষাকে নিয়ে আমাদের কতো আয়োজন। ছাতা, স্যান্ডেল কেনা থেকে শুরু করে খাবারের ম্যানুকেও বদলে যেতে দেখি। কাদাজলে বদলে যেতে দেখি- মাঠ ঘাট, জলাশয়। গ্রাম কিংবা নগরে নালা নর্দমার জল দিকে দিকে করে থৈ থৈ। কাদাজলে থিক থিক করে-চলাচল ভূমি। বর্ষাকে দেখি বন্যাকেও ডেকে আনে। বর্ষা এলে গাভীন গাঙ্গের ঘোলাজলে নেমে যায়- খেয়া তরি। গরুর গোয়ালে জমে গাদা গাদা খাবারের খড়। কৃষকের অবসরে বিড়ি হুকোর সুখটান সুখি সুখি করে তার পুরো পরিবার। আয়েসে পা তুলে বসে থাকে কৃষকের সোনাবউ। গালের গলিতে পান তুলে কৃষাণী গড়ে তুলে বাঁশ বেতের নানা পদের বাহারি সরঞ্জাম। গালের গলুইয়ে ডোবায়-অবাধ্য সুঁইয়ের বেয়াড়া সুতো। এমন সময়ও কোন কোন দিন দেখা যায়-লুঙ্গির আঁড়ে লুকানো শরীর খোঁজে কৃষাণীর সুখদ অবসর। বাজার জমে না, গাড়ি চলে না, চলে শুধু চরণ যুগল। মাছেরা সংসার পাতে। জলে জলে মাছেরা ঘুরে, পুকুর পুকুর কতো পুকুরের জলে। ভিসাহীন ঘুরে বেড়ায় এপার ওপার নানা পার বা স্বদেশের ভেতর। ওঠে পুঁটিমাছের শরীরে লালে লাল বেনারসি। আকাশের ডাক পেলে হুড়মুড় করে ওঠে যৌবন ফেরা অবাধ্য কৈ। বর্ষায় আসে পাখির পাখনায় নবীনা ভর। তাই গাছের কুঠরে ডিমের রাজ্য উত্তাপ দিতে বসে পাখির মায়াবউ।
বর্ষা যেদিন গ্রীষ্মকে বিদায় দিয়ে আসে, সেদিন বুক উঁচু করে বলে- জলের কলস ভরেছি। ভরেছি জলাশয়। দীর্ঘ অপেক্ষার পালা শেষে চাতক পাখির ঠোঁটে উজাড় করে ছি তৃষ্ণার জল। বর্ষা না এলে জলের জন্য শুকায় জলাধার। বড় খালি খালি হয়ে যায় সবুজাব শাড়িতে সাজান কদমের ডাল। বর্ষা না এলে দু হাত প্রসারে বিরহী পিপাসু প্রেমিক মধ্যযুগের গীতিকবিতার মতো গেয়ে ওঠে না- ‘এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা/কেমনে আইলো বাটে/আঙ্গিনা মাঝে বধূয়া ভিজিছে/দেখিয়া পরান ফাঁটে। ‘অথবা হৃদয় মুচড়ানো কথায় ফোঁটে- ‘শাওন মাস গগনে ঘন-গরজন/শুনি ধ্বনি পুলকিত গাত/শ্যাম-অনুরাগ ভরে রহিতে না পারি ঘরে/চলিলা সখিগণ সাথ’।।
আমরা দেখি, বর্ষা এলে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামেরও কলমে ওঠে- ‘থৈ থৈ জলে ডুবে গেছে পথ/এস এস পথ ভোলা। /সবাই দুয়ার বন্ধ করেছে /(আছে)আমার দুয়ার খোলা। /সৃষ্টি ডুবায়ে ঝরুক বৃষ্টি/ঘন মেঘে ঢাকো সবার দৃষ্টি, /ভুলিয়া ভুবন দুলিব দুজন/বাঁধি প্রেম-হিন্দোলা’।।
বর্ষা এলে মানচিত্রের জমিনে চোখ মেলে দেখি-
প্রকৃতির প্রতি অঙ্গ থেকে গ্রীষ্মের ক্লান্তি মুছে চর উচ্ছাসে জেগে ওঠে বর্ষার নয়ন রঞ্জন রুপশ্রী। কানায় কানায় ভরে ওঠে পুষ্প গন্ধ আকুলিয়া। দিকে দিকে ব্যাঙের দল নব টানে ফেরায় আকুল পরান। আর এমন গানে গানে দিগন্তের পানে পানে ভেসে আসে ধ্রুপদী সংগীতের মায়াবি সুরের খেলা। উর্বরে উর্বরে জেগে ওঠে পলিমাটি। জাগে কৃষকের প্রাণ। তুমুল বন্ধু প্রেমের আবাহন জাগে-বর্ষা আর কদমের ফুলে ফুলে।
সুবাসের ভরা কৌঠা নিয়ে আসে দোলনচাঁপা, রজনীগন্ধা, জুঁই, কামিনী, বেলি আর বন বাদাড়ের অজানা ফুল।
আমাদের দেশের সাথে বর্ষা বা বৃষ্টির তুলনা অন্য কোথাও অমিলে থাকে বলে এ দেশে বৃষ্টি হয়েও শেষ হয় না। বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে আসে বর্ষা। এ যেনো এক স্বর্গ মিতালি। বৃষ্টি নেই তো বর্ষা নেই। বৃষ্টি ছাড়া বড়ো একা একা বর্ষা। অসম্ভব অসম্পূর্ণ তার ঋতুর বৈচিত্র্য। বর্ষার হাত ধরে পদে পদে আসে বৃষ্টি। প্রেমে প্রেমে আটখানা হয়ে ওঠে মানুষের হৃদয়ও মসনদ। আবার ঘুমের খাটে কষ্টের পাথরে বুক বাঁধে প্রেমে কাতরানো প্রেমিক। উতলা হয়ে ওঠে মানুষ। উতলা হয়ে ওঠেন আমাদের কবি। উদগ্রীব হয়ে ওঠেন-গাল্পিক, ঔপন্যাসিক, চিত্রকার, গীতিকার। বর্ষা মৌসুমে অবসর আসে বলে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে সাহিত্যের ময়দান। আকুলে ব্যাকুলে নব সৃজনে জাগে সাহিত্যের স্পন্দন ও প্রাণ। মনে হয় একসাথে জেগে ওঠেন সমূহ সাহিত্যিক! বর্ষা নিয়ে তার চেয়ে বেশি জাগেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। তিনি তাঁর হাত দিয়ে বর্ষা বন্দনায় যেনো জোয়ার সৃষ্টি করে দেন। আপন মনে তাই কবির সাথে গেয়ে ওঠি-’ ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী/ উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে/নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণ সংগীতে/ রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম।’ মানব জীবনের চিরজাগরুক আবেগ,অনুরাগ শব্দ সুরে অনুরণিত করেও রবীন্দ্রনাথের গীত শুনি- ‘আজি বরিষণ মুখরিত শ্রাবণ রাতি,/ স্মৃতি বেদনার মালা একেলা গাঁথি। /আজ কোন ভুলে ভুলি আঁধার ঘরেতে দুয়ার খুলি।’
আবার প্রেমিক হৃদয়ে উস্কানি দিতে শুনি- ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘন ঘোর বরিষায়,/এমন মেঘ স্বর বাদল ঝরঝরে/তপনহীন ঘনতম সায়…’। ‘আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলাধারে/বেনুবনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ,মন যেন চায় কারে।’
শুধু যে কবিতা আর গান তাও নয়। রবীন্দ্রনাথ ক্ষণে ক্ষণে জনে জনেও করেছেন বর্ষার বন্দনা। যেমন, ১৩০৯ শান্তনিকেতন বোলপুর থেকে বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠিতে পাই- ‘মেঘের নীলাস্থল এমন আর নাই-এখানেই জয়দেব বিপুলচ্ছন্দে তমালবনে বর্ষারাত্রির বর্ণনা লিখিয়াছিলেন। এখান হইতে জয়দেবের জন্মভূমি ছয় ক্রোশ-চন্ডিদাসের জন্মভূমিও অধিক দূরে নহে। এই জায়গায় ঘনবর্ষার সময় একবার তোমাকে গ্রেফতার করিতে পারিলে চমৎকার হয়।’ ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখা অন্য চিঠিতে লেখেন-হাজার বছর পূর্বে কালিদাস যে আষাঢ়ের প্রথম দিকে অভ্যর্থনা করেছিলেন প্রকৃতির যেই রাজসভায় বসে অমর ছন্দে মানবের বিরহ সংগীত গিয়েছিলেন,আমার জীবনেও প্রতি বৎসরে আষাঢ়ের প্রথম দিন তার সমস্ত আকাশ- জোড়া ঐশ্বর্য নিয়ে হাজির হয়।”
আমরা দেখেছি বর্ষা তার সৌন্দর্য,রহস্য ও প্রবল দাপুটে ক্রিয়াকলাপ নিয়ে হাজিরা দেয় বাংলা গল্প উপন্যাসেও। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর পথের পাঁচালী, জহির রায়হান এর হাজার বছর ধরে উপন্যাস ছাড়াও গভীরভাবে বর্ষা এসেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর পুতুল নাচের ইতিকথাতেও। বাংলাদেশের জমিন জুড়ে তার জনজীবন। প্রেম- ভালোবাসা, সম্পর্কের রসায়ন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে বর্ষার প্রকৃতির সঙ্গ কামনায়।
আধুনিক বাংলা উপন্যাসের যুগেও বর্ষা এসেছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ এর ধারে কাছেও তিনি তাঁর অন্যতম প্রিয়তমা স্ত্রী শাওন এর কন্ঠে মানসী প্রিয়া কে ডাকেন- ‘যদি মন কাঁদে/তুমি চলে এসো, চলে এসো/এক বরষায়…/যদি মন কাঁদে/তুমি চলে এসো, চলে এসো/এক বরষায়…/এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে/জল ভরা দৃষ্টিতে/এসো কোমল শ্যামল ছায়। ‘কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর গঙ্গা উপন্যাসেও বর্ষার বন্দনা পড়ি-’ বৃষ্টি এলো ফিসফিস করে তারপর মহিষগুলো দাপাদাপি করল। বৃষ্টি এলো মুষলধারে। মেঘ নামলো গরিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে আসছে যেন গোটা গঙ্গার বুকখানি।’ আধুনিক লেখকদের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাার ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ ছোটগল্পটি পাঠকের মুঠোয় তুলে দিলে পাঠক পড়তে পারেন- ‘আমার জানলায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারের ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদ বর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আজ আমার ভারি ভালো লাগছে।’
বর্ষায় সংস্কৃত কবি কালিদাস এর মেঘদূতের কথা আমাদের জানা নেই-কথাটি ভুল! আমরা যক্ষ- কান্তার উপাখ্যানকে প্রশ্রয় দিতে জানি।’ মেঘকে বাদ দিলে তো মেঘদূতের কিছু থাকে না। বাতাসে ভাসমান মেঘ আসলে মেঘ নয়-জীবনের অন্য নাম প্রেমের জন্য উড়ে-উড়ে চলা। মেঘ আসলে দূতই ঠিক। এ দূগ জীবনের প্রণোদনা যার কাছ থেকে বার্তা না এলে জীবন ফুরায়ে যায়। ‘বাঙালির আদিগ্রন্থ চর্যাপদে বর্ষার কথা সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও আমরা
নৈরামণি তার প্রেমিক নিয়ে হারিয়ে যেতে যেতে জল নৌকার কথাও উপাখ্যানে পাই। রাধা কৃষ্ণের প্রেমের প্লাবনেও বর্ষার ইতিউতিকে ছাড় দিতে পারি না।
তবে যা ই বলি- বর্ষা, এলে আকাশ বেয়ে, ঝিরিঝিরি দড়ি বেয়ে নেমে আসা এক চেনা কাঁচপরি! এ পরী প্রেমে আসে। আসে হৃদয়ের জোয়ার-ভাঁটায়। আসে- নাচে-গানে, আসে- অংকনে, চিত্রণে, রূপ অপরূপ বৈচিত্র্যে। এ রূপে মজেই রাধা তার সখি কে বলে- ‘ঝর ঝর বরিষ সঘন জলধার/দশদিশ সবহু ভেল আঁধিয়ার? এ সখি কিয়ে করব পুরষ্কার/বার এ হরি অভিসার।’
যেহেতু রবীন্দ্রনাথ বারবার বর্ষার কলমে কাগজের সাদা পৃষ্ঠা দিয়েছেন মন ভরে। তাই তাঁকে ছাড়া কেমন জানি মনে হয়-হয়নি কিছুই।
বর্ষার তো শেষ নেই। আরও আছে বর্ষা।
বছরে বছরে বর্ষা। বারে বারে নেচে উঠবে রবীন্দ্রনাথের পংক্তি- ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচেরে হৃদয় নাচেরে-’
এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা/গগন ভরিয়া এসেছে ভুবন ভরসা/দুলিছে পবনে শন শন বনবীথিকা,/ গীতিময় তরুলতিকা। ‘তখন হয়তো রবীন্দ্রনাথকে, তাঁর বর্ষা সৃষ্টিকে কাজে লাগিয়ে জেগে উঠবে আরও সাহিত্য। গলায় গলায় গান। এমন কী নিজেও লিখে শুনাবো দুকলম-বৃষ্টি মানে-/নীরব বনে পাতার ওপর ঘাস ফড়িং আর প্রজাতির /রোদেলা সময় নিরন্তর খুঁজে খ্ুঁজে ফেরা। /বৃষ্টি মানে-/জানলার কাচ খুলে পলকে পলক ফেলে/আরও সত্যি চোখে সত্যিকার চোখ খুঁজে চলা। /বৃষ্টি মানে-/নিবিবদ্ধ খুলে খুলে ঘুমের ভেতর ভাঙ্গা ঘুমে/আলাফলি প্রেম বেচা কিনি করা।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট