ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৪:৪৪:০০ অপরাহ্ন

মো. আমিনুল ইসলাম
ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতির ইতিহাসে এক বিশাল জায়গা দখল করে আছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে আছে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে। এখনও সামাজিক- রাজনৈতিক দল অন্যায়ের প্রতিবাদে শহীদ মিনারে অবস্থান নেয়। দল বা গোষ্ঠির দাবি আদায়ের জন্য মানব বন্ধন, অনশন, করার জন্য নির্ভরতার স্থান। বছর জুড়েই বিভিন্ন কার্যক্রম শহীদ মিনারে দৃশ্যমান। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ভাষা আন্দোলনে যা হয়েছে তা বিশ্বের ইতিহাসে কোথাও আর হতে দেখা যায়নি। ভাষা আন্দোলন আমাদের ঐক্যের গল্প, প্রেরণার গল্প, এগিয়ে যাওয়ার গল্প, সাহসের গল্প, ত্যাগের গল্প, প্রাপ্তির গল্প, বিজয়ের গল্প, আনন্দের গল্প। ভাষা আন্দোলনেই আলোকবর্তিকা হয়ে আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির মুক্তিযুদ্ধের সাহস যোগেয়েছিল। তাই মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের গর্বের জায়গা, বৈশ্বিক পরিবারে পরিচিতির জায়গা।
পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক মাস পূর্বে ১৭ই মে ১৯৪৭ সনে মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, উন্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তার এই বিবৃতির পর কিছুসংখ্যক বাঙালী লেখক উদ্বিগ্ন হয়ে কলম ধরেন রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে। সেই সময়ে লেখক সাংবাদিক আব্দুল হক বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে ‘ইত্তেহাদ ‘ও ‘আজাদ পত্রিকায় দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত দিয়ে বিশ্লেষণ করে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন যেকোন দিক দিয়েই বিবেচনা করা হোক না কেন রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে বাংলাভাষার দাবিই সবচেয়ে বেশি। অন্যতম কারণ ছিল পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর কেন্দ্রীয় শাসনে অবাঙালির প্রাধান্য এবং বাঙালির মুসলিম লীগের অধিকাংশ নেতাদের মানসে ধর্ম ও পাকিস্তান একাকার হয়ে বাকবাকুম দিচ্ছিল, যার জন্য বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করতে সামর্থ্য হয়নি। পরবর্তীতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্র, ভাষা করার জন্য আরোও অনেক বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন মাধ্যমে লেখালেখি করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লা, ড. এনামুল হক, কাজী মোতাহার হোসেন, আধ্যাপক আবুল কাশেম প্রমুখ। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়, কিছু বাঙালি বুদ্ধিজীবী উন্দুর পক্ষেও অবস্থান নিয়েছিল।
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে যারা জীবনবাজী রেখে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন; কিছুদিনের মধ্যেই তারা বুঝতে পারে বিশাল ফাঁদে আঁটকে পরেছে। সাম্প্রদায়িক কারণে বিশ্বপরিক্রমায় কত নোংরা কাজ ও কত মানুষের জীবন দিতে হয়েছে তা সৃষ্টিকর্তাই ভাল জানেন। ভারতবর্ষ ভিবক্তির ক্ষেত্রে যে সূত্রকে ভিত্তি করে হয়েছে তাও নোংরা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের দায় তাদেরকেই নিতে হবে। পূর্বপাকিস্তান ও পশ্চিমপাকিস্তান নামক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি কেমন তার বৈশিষ্ট হবে?, কিভাবে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে? রাষ্ট্র গঠনে মৌলিক বিষয় সমূহে ঐক্যমত হয়ে দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ চুক্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। এত বড় বড় মেধাবী রাজনীতিবিদগণ এ বিষয় সম্পর্কে কেন যে উদাসীন ছিলেন তা গবেষণার বিষয়।
ভাষা আন্দোলনের চরিত্র ছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক। কেন কিংবা কী কারণে বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অন্তঃপ্রাণ সমর্থন দিয়েছিল? তা ভেবে দেখার বিষয় হতে পারে। ইংরেজ শাসন আমলে অধিকাংশ জমিদার মহাজন হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিল। তারা ইংরেজদের সহযোগী হয়ে সাধারাণ মানুষকে শোষণ, নিপীড়ন করে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। এদের হাত থেকে মুক্তির নেশায় বাঙালি মসুলমানেরা অন্য সবকিছু ভুলে পাকিস্তান জিন্দাবাদ মিছিলে অকুন্ঠ সমর্থন দেয়। এই মোহে প্রথম আঘাত আসে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে। তখন প্রকাশিত এনভেলাপ, পোস্টকার্ড, মনি অর্ডার ফরম, ডাকটিকেট ও রেলওয়ের টিকেটে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু লেখা দেখে নীলক্ষেত ব্যারাকের কিছু সংখ্যক সরকারি কর্মচারী নীলক্ষেত এলাকায় সভা করে রাজপথে মিছিল বের করে। সেই সময়ের মিছিলে স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘সবকিছুতে বাংলা চাই- উর্দুর সাথে বিরোধ নাই’। তাদের সাথে কিছু সংখ্যক ছাত্রও যোগ দিয়ে ছিল। উন্দুর সাথে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা দাবি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রাজনৈতিক চরিত্র পায়- করাচির শিক্ষা সম্মেলনে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দুকে সুপারিশ কারায় (২৭, নভে ১৯৪৭)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে এক প্রতিবাদ সভা হয়। এই সভায় কয়েকজন শিক্ষকও অংশগ্রহণ করেন। অধ্যাপক আবুল কাশেম স্যারের সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন মুনির চৌধুরী, এ কে এম আহসান, কল্যানী দাশগুপ্ত ও কয়েকজন ছাত্রনেতা।
বিচ্ছিন্ন আন্দোলনে কোন ফল আসেনি দেখে ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে ছাত্র, শিক্ষক, বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব ও বুদ্ধিজীবীর সমন্বয়ে” রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ “গঠন করা হয়। এই সভায় নূরুল হক ভুইয়াকে আহবায়ক করা হয়। ভাষার দাবিতে প্রথম সংগঠিত আন্দোলন শুরু হয় পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ তারিখে কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ব্যবহারিক ভাষা হিসাবে ইংরেজি, উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাখার জন্য। কিন্তু মুসলিম লীগের বাঙালি-অবাঙালি সদস্যদের বিরোধিতায় সেই প্রস্তাব বাতিল হয়। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর বক্তব্য ছিল অগ্রহণযোগ্য। এ ঘটনায় ছাত্রসমাজ তীব্র প্রতিবাদ করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বতঃস্ফুর্ত ধর্মঘট পালিত হয়। মিছিল সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচী ধারাবাহিক ভাবে চলতে থাকে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১১ই মার্চ সারাদেশে প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ২ই মার্চ ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংগ্রাম পরিষদ পুণর্গঠিত হয় এবং আহবায়ক করা হয় শামছুল ইসলামকে। ১১ই মার্চ কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে সচিবালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পিকিটিং করতে গিয়ে শামছুল হক, শেখ মুজিবুর, মোহাম্মদ তোহা, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী প্রমুখ। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বেশ কিছু ছাত্রও গ্রেফতার হয়। এই অবস্থার পরিপ্রক্ষিতে ঢাকাসহ সারাদেশে লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকে। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়ায় পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আন্দোলন বন্ধ করার জন্য সংগ্রাম পরিষদের কাছে সমঝোতার প্রস্তাব দেন। অনেকে এই প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিলেও সমঝোতার প্রস্তাব মেনে নেয়। আন্দোলন স্থগিত হয়ে যায় এবং ১৫ই মার্চ রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়। মূলত পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নার সফরকে উপলক্ষ করেই সরকার এই পদক্ষেপ নেয়।
মোহাম্মদ আলী সফরে আসেন ১৯মার্চ ১৯৪৮ এবং ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল সমাবেশে ভাষণ দেন। তার বক্তব্যে দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ নিয়ে যারা আন্দোলন করবে তাদেরকে সতর্ক করে বক্তব্য দেন এবং বিভিন্ন দেশের এজেন্ট হিসাবে উল্লেখ করেন। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বক্তব্য দেন। যখনেই তিনি বলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু তখনেই অধিকাংশ ছাত্র নো নো বলে প্রতিবাদ জানায়। এমনকি জিন্না সাহেব সংগ্রাম পরিষদের সাথে চুক্তি বাতিল করেন। সেই সময়ে তার বক্তব্যের প্রতিবাদে একমাত্র শেরে বাংলা শক্তিশালী শব্দ প্রয়োগে মধ্য দিয়ে বিবৃতি দেন। তাঁর বিবৃতির মধ্যে ছিল, জিন্না ও তার সহযোগীরা যে ভাষায় বক্তব্য দিয়েছে তা বিবেক বর্জিত, শিষ্টাচার বহির্ভূত, অগণতান্ত্রিক, অগ্রহণযোগ্য।
ভাষা আন্দোলন ও মুসলিম লীগ জিন্নাপন্থী নেতাদের আচরণের ফলে দ্রুত রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে। পূর্ব বঙ্গের উদারপন্থী মুসলিম লীগ নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন এক হয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। সেই প্রেক্ষাপটে ১৯৪৯ সালে ২৩জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এক বছর পর ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চ উদযাপন উপলক্ষে আব্দুল মতিনকে আহ্বায়ক করে বিশ্ববিদ্যালয়ে” রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ “গঠিত হয়। পাকিস্তান গণপরিষদ কর্তৃক মূলনীতি কমিটি রাষ্ট্রভাষা উন্দু করার জন্য সুপারিশ করলে আবার আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ছাড়াও রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন সমূহ দেশব্যাপী রাষ্ট্রভাষার গুরুত্ব তুলে ধরে সকল পর্যায়ের মানুষকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হয়। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন তার বক্তব্যে বলেন উর্দুই হতে যাচ্ছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ছাত্র সমাজ ছাত্র ধর্মঘট, প্রতিবাদসভা, মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীসভায় কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে ৪১ সদস্যের” সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করা হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি সভায় সিদ্ধান্ত হয় ২১শে ফেব্রুয়ারি সারাদেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রতিবাদ দিবস পালনের। তাদের সিদ্ধান্ত সর্বদলীয় পরিষদ সমর্থন জানায়। এইদিন পূর্ববঙ্গের বাজেট অধিবেশন বসার কথা। এই কর্মসূচীতে প্রসাশন বিচলিত হয় এবং একমাসের জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪৪ ধারা জারি করে। আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে অনেক আলোচনা পর্যালোচন করে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে যুবসমাজের অলি আহাদ, আব্দুল মতিন ও গোলাম মাওলা মুখ্যভূমিকা পালন করেন।
২১শে ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা সকাল থেকেই থমথমে অবস্থা বিরাজমান ছিল। বাইরে পুলিশ জিপ, ট্রাক নিয়ে প্রস্তুত ছিল। সর্বদলীয় পরিষদের প্রতিনিধি শামছুল হক ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে যুক্তিদিয়ে বক্তব্য দিতে গেলে উত্তেজিত ছাত্ররা থাকে থামিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির আহবায়ক আব্দুল মতিন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে বক্তব্য দিলে ছাত্র সমাজ উল্লাসে সমর্থন করে। আব্দুস সামাদের পরামর্শে ১০জন করে মিছিল করে এগিয়ে যায় এবং ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হয়। মিছিলে স্লোগান ছিল “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই “রাজববিন্দদের মুক্তি চাই” চলো চলো আসেম্বলিতে চলো”। পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ করে ও গ্রেপ্তার করে, কিন্তু পরে এত বেশিসংখ্যক ছাত্রছাত্রী একসাথে চলে আসে পুলিশ লাঠি দিয়ে আটকাতে পারেনি। বিভিন্ন পথে ছত্ররা পরিষদ ভবনের সামনে চলে আসে এবং বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। বেলা তিনটার দিকে জমায়েতের উপর টিয়ারগ্যাস ও কয়েকদফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম সহিদ হন ছাত্র রফিকউদ্দিন, ২য় শহিদ হন অছাত্র আব্দুল জব্বার, ৩য় শহিদ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত, পুলিশ আরো এইদিন তিনটি লাশ সরিয়ে নেয়। এই খবর পেয়ে অধিবেশন বর্জন করেন মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, শামসুদ্দিন, খয়রাত হোসেন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মনোরঞ্জন ধর, আনোয়ারা খাতুন প্রমুখ এমএলএ। অন্দোলনের গতি কমিয়ে আনতে ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ প্রস্তাব পূর্ববঙ্গের আইন পরিষদে পাস করে।
১৯৪৭ সনে অভিব্যক্ত বাংলা যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতো তাহলে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত হত। ভাষা, রাজনীতির ভাবনা, সাংস্কৃতিক, কৃষ্টি, ঐতিহ্যগত সম্পর্ক থাকলে অনেক কাজই সহজ হত। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণ, শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিকাশে গঠনমূলক কার্যক্রম গ্রহণে জটিল সমীকণের হিসাব মিলাতে হত না। ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের সময় শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ বাংলাতেই বেশি হয়েছে। ১৯০ বছর ইংরেজ শাসনের সময় বাংলায় উল্লেখযোগ্য আন্দোলনের মধ্যে ফকির-সন্যাসী আন্দোলন, কৃষক বিদ্রোহ, যুববিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহ, তিতুমিরের বিদ্রোহ, সাওতাল বিদ্রোহ, নানকার বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ অন্যতম। এর মধ্যে কিছু বিদ্রোহ ছিল বৃটিশদের ভিতরে কাঁপন ধরিয়েছিল। যেমন চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সনে সিপাহী বিদ্রোহ- যারা মৃত্যু নিশ্চিত জেনে বিদ্রোহের শপথ নিয়েছিল। এইসব আন্দোলন রাষ্ট্রভাষার অধিকার আন্দোলনে সাহস যুগিয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে আজ আমরা এদের কথা ভুলতে বসেছি।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।