ভাষা আন্দোলনে সিলেটের নারী সমাজ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৫:৪০:১৫ অপরাহ্ন

ইছমত হানিফা চৌধুরী
দেশ ও জাতির বড় সম্পদ তার ভাষা। বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের একটি বড় অধ্যায় জুড়ে রয়েছে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের গৌরবের অন্যতম একটি বিষয়। বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় জীবনে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের একটি বড় অধ্যায় জুড়ে রয়েছে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। মায়ের মুখের ভাষার সতীত্ব রক্ষায় বাংলার নির্মম-মৃত্যু-ভয় নির্লিপ্ত দুর্জয় সন্তানেরা আপন বুকের রক্তে পিচ-ঢালা কালো রাস্তাকে রঞ্জিত করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে এসে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তদানিন্তন পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা দেন-উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর তিন দিন পরে অর্থাৎ ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথা জোরের সাথে ঘোষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। কিন্তু শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও জিন্নাহ এতে কোন কর্ণপাত করেন নি। ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এই ঘোষণা দিলে ছাত্র সমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এর প্রতিবাদে সারাদেশের মতো সিলেটের জনগণও সোচ্চার হয়ে উঠে। শুরু হয় সংগ্রাম। ইতিহাস বলে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গড়ে ওঠা এই আন্দোলনে সিলেট ছিলো সবার আগে এবং সিলেটের নারী সমাজ পালন করেছেন অগ্রণী ভূমিকা। বলতে গেলে আটচল্লিশের আগে থেকেই বাংলা ভাষার পক্ষে সিলেটের নারী সমাজের ছিল দৃঢ় অবস্থান। সিলেটের মহিলারা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় নেমে এসেছেন রাজপথে। সাহসিকতার সাথে অংশ নিয়েছেন মিছিল-সমাবেশে। ভাষা আন্দোলনে, জোবেদা রহিম চৌধুরীর নেতৃত্বে সিলেটের মহিলারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুসলিম লীগের নেত্রী হয়েও জোবেদা রহিম চৌধুরী নীতির প্রশ্নে আপোষ করেননি।
জোবেদা খাতুন চৌধুরী ছিলেন, সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণের শিলঘাট এর খান বাহাদুর শরাফত আলী চৌধুরীর মেয়ে। জোবেদা খাতুন ১৯০১ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে তিনি ছিলেন ইডেন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী (১৯০৬) ১৯১৯ খ্রীস্টাব্দে তার বিয়ে হয়, হবিগঞ্জের পানি উমদার খান বাহাদুর আব্দুর রহিমের সাথে। ১৯৪৮ খ্রীস্টাব্দে সিলেটের ভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দেন, তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন ছাত্র সমাজ, মহিলা সমিতি এবং মুসলিম লীগের প্রগতিশীল গোষ্ঠী। বছরটির শুরু থেকেই সিলেটের মহিলারা বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে, ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখেন। ঐ বছর এগার জানুয়ারি পাকিস্তান সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুর রব নিশতার সিলেটে এলে স্থানীয় মহিলাদের একটি প্রতিনিধি দল তার সঙ্গে দেখা করে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে সিলেট জেলা মহিলা মুসলিম লীগের সভানেত্রী জোবেদা রহিম চৌধুরী, সহ-সভানেত্রী সৈয়দা শাহার বানু (সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, এবং বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী একেএম মুমিন সাহেবের মা-জননী) সম্পাদিকা সৈয়দা লুৎফুন্নেছা খাতুন, সিলেট সরকারী অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিসেস রাবেয়া খাতুন বিএবিটি, মিসেস জাহানারা মতিন, মিসেস রোকেয়া বেগম, মিসেস শাম্মী কাইসার রশীদ, এমএ বিটি নুরজাহান বেগম, মিসেস সুফিয়া খাতুন, মিসেস মাহমুদা খাতুন, সৈয়দা নজিবুন্নেছা খাতুন (শেখঘাটের এহিয়া ভিলার গৃহবধূসহ সিলেটের আরও কিছু বিশিষ্ট মহিলারা মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এই স্মারকলিপিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোর দাবি জানানো হয়। এই স্মারকলিপি পেশ করাকে কেন্দ্র করে সেই সময় সিলেটে উর্দু সমর্থক পত্রিকা ইস্টার্ন হেরাল্ড (আসাম হেরাল্ডের পরিবর্তিত নাম) একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে মহিলা নেত্রী জোবেদা রহিম ও স্মারকলিপি সম্পর্কে অশোভন মন্তব্য প্রকাশ করে। এই অশোভন বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন স্মারকলিপিতে স্বাক্ষরদানকারী সৈয়দা নজিবুন্নেছা খাতুন। সাপ্তাহিক নওবেলালের ১২ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত এক প্রতিবাদ লিপিতে তিনি বলেন, যাহারা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী হয়ে মাতৃভাষার বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা মাতৃভাষার বিশ্বাসঘাতক। সিলেটের উর্দু অনভিজ্ঞ মুসলমানেরা ইসলাম ধর্মের অনুশাসন পালনে কোন অংশে হীন নয়। সিলেটের মুসলমানদের তাহজীব ও তমদ্দুন এক বিশিষ্ট স্থান লাভের অধিকারী বলিয়া অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা মত প্রকাশ করিয়াছেন। তমদ্দুন মজলিসের সম্পাাদক প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম চিঠি লিখে সাহসী ভূমিকার জন্য জোবেদা রহিম চৌধুরীসহ নারী নেত্রীদেরকে অভিনন্দন জানান। তার চিঠিতে তিনি লেখেন, আজ সত্যিই আমরা অভূতপূর্ব আনন্দ এবং অশেষ গৌরব অনুভব করছি। সিলেটের পুরুষরা যা পারেনি, তা আপনারা করেছেন। উর্দুর সমর্থনে সিলেটের কিছু পত্রিকা যে জঘন্য প্রচার করছে আর সিলেটের কিছু পুরুষ স্মারকলিপি দিয়ে যে কলঙ্কজনক অভিনয় করেছেন তা সত্যিই বেদনাদায়ক কিন্তু আপনাদের প্রচেষ্টা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের ভয়ের কোন কারণ নাই। তমদ্দুন মজলিস আজ আপনাদের অকৃত্রিম ধন্যবাদ জানাচ্ছে।
৮ মার্চের গোবিন্দচরণ পার্কের সমাবেশে হামলার প্রতিবাদে, সিলেটের মহিলারা ১৯৪৮ সালের ১০ মার্চ গোবিন্দ পার্কে একটি সভা আহবান করেন। কিন্তু সিলেট এর প্রশাসন সমগ্র সিলেটে সভা সমাবেশ আয়োজনে ১৪৪ ধারা জারি করেন। আইনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে, আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে বক্তব্য দেন, সিলেটের মহিলারা জিন্নাহ সাহেবকে এক তারবার্তা প্রেরণ করে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ১৯৫২ সালে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্র জনতা হত্যার প্রতিবাদে নারী সমাজ আবারো প্রতিবাদে ফেটে পড়ে এবং ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মিছিলে সিলেটের বহু মহিলা স্বতস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। ১১টায় শুরু হয়ে মিছিল প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে গোবিন্দচরণ পার্কে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তৃতা করেন মহিলা নেত্রীবৃন্দ। ঐদিন বিকালে জিন্নাহ হলে (বর্তমান কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ হল) এক মহিলা সমাবেশ হয়। বিকেলে গোবিন্দচরণ পার্কে সিলেট মহিলা কলেজের অধ্যাপক আব্দুল মালেকের সভাপতিত্বে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৫২ ভাষা আন্দোলনে সিলেটের আরো অগ্রণী মহিলাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন হাজেরা মাহমুদ, রাবেয়া আলী, ছালেহা বেগম, লুৎফুন্নেছা বেগম। নওবেলাল পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদ আলীর স্ত্রী হাজেরা মাহমুদ একজন বামপন্থি নেত্রী ছিলেন। রাবেয়া আলী ছিলেন সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর স্ত্রী। লুৎফুন্নেছা বেগম ছিলেন একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরী এবং সৈয়দা নজিবুন্নেছা খাতুন দলীয় অবস্থানের বিরোধীতা করে, ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শহিদের রক্ত বৃথা যায়নি। সকল ভাষা সৈনিক এর সাথে সিলেটের এই মহীয়সী নারীদের ত্যাগ এবং সংগ্রামে অর্জিত আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আজ পৃথিবীর বুকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারী গৃহিত হয়ে বাংলা ভাষা বাংলাদেশকে করেছে গৌরবান্বিত। কবি শামসুর রাহমান এর কবিতার ভাষায় বলি :
তোমাকে উপড়ে নিলে বলো তবে কী থাকে আমার
ঊনিশ শো বাহান্নর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলী
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।