ভিক্ষুক
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জানুয়ারি ২০২১, ৪:৩৩:৩৫ অপরাহ্ন

হাসান শাওন:
দু’মাস ধরে বাসায়। মেজাজ খিটখিটে। সকালে অফিস থেকে মেইল এসেছে বোনাস হবে না। দু’মাসের হোম অফিসের এই প্রতিদান।
শারমীন বলল, বাবুর দুধ লাগবে। নিচে যাও।
লিফট বন্ধ। আরো খিচড়াল মেজাজ। এখন পায়ে হেঁটে বারো তলা থেকে নামা। পকেটে হাত দিলাম। সিগারেটের প্যাকেট নেই। শুধু লাইটার আর ফোন পেলাম। প্যাকেট বোধহয় বাসায়। সিগারেটের দাম পর্যন্ত বাড়িয়েছে করোনায়।
যাচ্ছি মহল্লার পড়শী জেনারেল স্টোরে। সিগারেট, দুধ সবই পাব বাকিতে। এ মাসের বাকি পড়েছে তেইশশো টাকা। আলী ভাই ঢুকতেই বললেন, ভাই, আজকে কিছু দিয়েন। আমার তো পোষানো লাগবো। উত্তর দেওয়ার মুড নেই এ কথার।
বললাম, সিগারেট দেন। লাইটার হাতে নিতেই শারমীনের ফোন। বাবুর প্যাম্পার্সও লাগবে। তো আগে কী করো তুমি? আমি তো টাকা নিয়ে বের হইনি। বিরক্তি বাড়ল। মুখে বললাম শুধু, ঠিক আছে। পাশে ফার্মেসি আছে। কিন্তু সেখানে বাকি করতে পারব না। বাবুর দুধ কিনলাম বাকিতে। পড়শী থেকে বের হব তখন একজন হাত বাড়িয়ে দিল। এক বৃদ্ধ।
: বাবা, একটা অষুধ কিন্যা দেন। খুব বিরক্ত লাগল। গত কয়েক দিনেই দেখছি এলাকায় ভিক্ষুক বেড়ে গেছে। ভিক্ষুকদের গলা আমার বারো তলা ফ্ল্যাট পর্যন্ত পৌঁছায়। নিজের দৈন্যের দিনে ভিক্ষুক সহ্য হয় না।
বললাম, কী ওষুধ? দাম কত?
বৃদ্ধ বললেন, আপনে একশ টাকা দিলেই হইবো। বাকি টাকা আমার আছে।
পড়শীতে ঢুকে আলী ভাইকে বললাম, ভাই ৩০০ টাকা দেন। বিকালে ৫০০ টাকা দিয়ে যাব।
আলী ভাই ক্যাশে হাত দিলেন। বললেন, ভাই পাঁচ দিলে ক্যামনে হইবো। এক দিয়েন। দেখি, বলে টাকা হাতে নিলাম।
বৃদ্ধকে একশ টাকা দিয়ে একটু দাঁড়ালাম। দেখি ওষুধ কেনে কি না লোকটা। একটু পর কাশির সিরাপ নিয়ে বেরিয়ে এল বৃদ্ধ। বলল, বাবা, বাঁচাইলেন। রাইতে খুব কাশি ওঠে।
ভালো লাগল বৃদ্ধকে। ওষুধের দাম পুরোটা সে আমার কাছ থেকে নেয়নি। যত টাকা দরকার ততই নিয়েছে। এই লোককে পেশাদার ভিক্ষুক মনে হলো না। করোনার ছোবলে উন্মূল কেউ। আরো একশ টাকা বাড়িয়ে দিলাম বৃদ্ধের দিকে। বললাম, চাচা, এই টাকাটাও রাখেন।
মুখ ঘুরিয়ে ফেললেন বৃদ্ধ। বললেন, বাবা, আমি ভিক্ষা করি না। আমার ছেলে গাড়ি চালায়। এই দুই মাস কামাই ভাইঙ্গা চলছি। এহন আর পারি না। এহন অষুধের টাকা লাগলে হাত পাতি।
আমি মানিব্যাগে টাকা ঢুকালাম। প্যাম্পার্স কিনে বাসার দিকে হাঁটা দিলাম। টিভি নিউজে তো খালি প্রণোদনার কথা বলা হয় দেখি। পায় কারা এসব?
বাসার লিফট চালু হয়েছে। উঠে গেলাম ১২ তলায়। ডোরবেল টিপতে যাব তখন ফোন। ব্যাংক থেকে। ক্রেডিট কার্ডের বিল বাকি পড়েছে। ১০ তারিখের মধ্যে দিতে হবে।
ঘরে ঢুকলাম। বাবু ঘুমুচ্ছে। শারমীন রান্নাঘরে। প্যাম্পার্স, দুধ টেবিলে রেখে রুমে ঢুকলাম।
অনেক দূরে আমি এখন। বারো তলার ফ্ল্যাটে। জানালা ভালোমতো লাগিয়ে দিলাম। গানের স্পিকার বাড়িয়ে দিলাম। সোজা শুয়ে পড়লাম বিছানায়। একটু দীনতা লাগছিল মানিব্যাগের দিকে তাকিয়ে। মনে হচ্ছিল এর ভেতর থাকা একশ টাকার নোট কোনো ভিক্ষুকের কাছ থেকে পাওয়া।