ভূতের বাড়ীর খোঁজে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ নভেম্বর ২০২১, ৪:১০:৪৯ অপরাহ্ন

আরিফুর রহমান সেলিম
শাকিব দাদীর কাছে গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই প্রতিদিন রাত্রেই সে দাদীর কাছে গল্প শুনতে যায়। রাজা রাণীর কিচ্ছা, আলাদিনের দৈত্যের কাহিনী, শয়তানের দুষ্টামি এরকম অনেক অনেক গল্প দাদী জানে। দাদী আরো জানে ভূতের গল্প।মিথ্যা মিথ্যা ভূত নয় একেবারে সত্যি সত্যি ভূতের গল্প। শাকিব ভূতের গল্প শুনে আর দাদীকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে। তবু তাঁর ভূতের গল্প শুনতে চাই। তাই দাদীও বাধ্য হয়ে ভূতের গল্প বলে।
সে দিন ছিল অমাবস্যার রাত। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুদিন আগে দাদীর বিয়ে হয়েছে শাকিবের দাদার সাথে। তাই সে নতুন বউ হয়ে বেশি বাড়ীর বাইরে যেতে পারেন না। কিন্তু রাত্র হলেই কে যেন তাঁর নাম ধরে ডাকে। কে ডাকে তাকে? তাঁর মা নয়তো? মাঝে মাঝে মনে হয় তাঁর মায়ের কণ্ঠ, মাঝে মাঝে মনে হয় তাঁর বড় আপার। শাকিবের দাদী বুজতে পারেন না আপা আর মা হলে তো তার ঘরেই আসতে পারে। আসেনা কেন? ঘরে না এসে চুপি চুপি বলে তাকে তেতুল তলায় যেতে। বাড়ীর এক কোনায় তাদের তেতুল গাছ। তেতুল তলার কথা শুনেই তাঁর বুকটা শুকিয়ে আসে।
দাদী বললো জানিস শাকিব আমার যে দিন বিয়ে হলো সে দিনই আমার শাশুড়ি বলেছিলেন সাবধান বউ মা তুমি ভুলেও তেতুল তলায় রাত বিরাতে যাবেনা। ওটা হলো ভূতের আখড়া।কালো ভূত, মেছো ভূত, দাঁতলা ভূত সব ভূত থাকে ওখানে। তাই তেতুল তলায় ভুলেও যাবেনা। গেলেই তোমাকে ভূতে ধরবে। আমাদের পাড়ার শেফালীর মাকে ভূতে ধরেছিলো। কোথাও তাকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সারা গ্রামে খোঁজা হলো। নাই, নাই, নাই শেষে কোথায় তাকে পাওয়া গিয়েছিলো জানো? এই তেতুল গাছের মগডালে। সকাল হতে হতে এ খবর আর পাঁচ গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিলো। ফলে শেফালির মাকে দেখার জন্য শত শত মানুষ এসেছিল। সেই থেকে আমাদের বাড়ীটাকে সবাই ভূতের বাড়ী বলে। আর তেতুল গাছটাকে সবাই ভয় পায়।
শাকিব দাদীর আরো কাছে আসে। দাদীর একটা হাত তাঁর বুকের উপর নিয়ে রাখে। এরপর শাকিব দাদীকে বলে এরপর কি হয়েছিল বলো। ভূতটা কি তোমাকে তেতুল তলায় নিতে পেরেছিলো।গিয়েছিলে তুমি ভূতের পিছু পিছু?
দাদী বলে আরে না শাকিব। শোন তাঁরপর কি হয়েছিল। আমার শাশুড়ির কথা শুনে আমি তো আর তেতুল তলায় যাইনি। ভূতটা পরে আমার পিছু নিলো। আমাদের যে কামিনী ফুলের গাছটা আছেনা এটা তো ছিলো আমার ভীষণ প্রিয়।এখানে আমি বসে থাকতাম আর ফুলের ঘ্রাণ নিতাম। কি যে মিষ্টি ঘ্রাণ। একদিন রাতে আমি কামিনী গাছের নিচে একটা চেয়ার পেতে বসে আছি। দখিনা বাতাসে কামিনী ফুলের মৌ মৌ ঘ্রাণ সারা বাড়ী ছড়িয়ে গেছে। হঠাৎ কি হলো কামিনী ফুলের গাছের নিচে আমি হঠাৎ দেখলাম একটা ধবধবে সাদা বিড়াল। ম্যাওঁ ম্যাওঁ ডাকছে। আমি তো ভাবলাম বিড়ালই।কিন্তু না একটু পরেই এটা বিড়াল থেকে কুকুর হয়ে গেলো। আমি কি করব তখন বুঝতে পারছি না। কুকুর হয়ে সেটা দুটো ঘেউ ঘেউ করলো। তারপর এটা কুকুর থেকে বাঘ হয়ে গেলো। বাঘ দেখে তো আমি ভয়ে দৌড় দিতে চাইলাম। কিন্তু আমি খেয়াল করলাম ঐ সময় আমি কোন কথাও বলতে পারছিলাম না। এমন কি নড়াচড়াও করতে পারছিলাম না। তারপর সেই বাঘটা হঠাৎ একটা সাদা শাড়ী পড়া বয়স্ক বুড়ী হয়ে গেলো। কেমন যেন কুচকানো মুখ। চোখ দুটো লাল। বড় বড় সাদা দাঁত। হাঁটতে হাঁটতে আমাকে ধরতে আসছে। যেই বুড়ীটা আমার কাছে এলো আমি ধপাশ করে চেয়ার থেকে মাটিতে পড়ে গেলাম।তাঁরপর আমার আর হুশ ছিলো না। শুনেছি তখন আমার শাশুড়ি আর তোর দাদা নাকি আমাকে ঘরে এনে মাথায় পানি ঢেলে ডাক্তার দেখিয়ে ভাল করেছিল।
শাকিব ভয়ে জড়োসড় হয়ে যায়। ওর শরীরের সব লোম দাড়িয়ে যায় ভয়ে। সে কাচুমাচু হয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরে। ভয়ে ভয়ে সে দাদীকে বলে, তারপর কি হয়েছিল দাদী। ভূতটা কি তোমাকে আর যন্ত্রণা দিয়েছিলো?
যন্ত্রণা দিবে না? ওটা তো ছিলো দুষ্টু ভূত। আমার মনে হয় ভূতটা ছিলো মেছো ভূত। কেন বলছি ওটা ছিলো মেছো ভূত সেটা তোকে বলছি। দাদী এবার আস্তে আস্তে গলার স্বর নিচু করে বললো, একদিন হলো কি আমি রান্না ঘরে মাছ রান্না করছি। ভূতটা কেমনে কেমনে যেন বুঝে ফেলেছে আমি মাছ রান্না করছি। সে আমার কাছে এসে বললো, আমাকে কিছু মাছ দাওনা? আমি তাকে বললাম, তুমি কে? সে বললো, আমি শেফালির চাচাতো ভাই। আমি বললাম, না মাছ দেওয়া যাবেনা। আমার স্বামী আর শাশুড়ী বকা দিবে। ভূতটা তখন রেগে গেলো। রেগে গিয়ে যেতে যেতে বললো, মাছ দিবেনা আমাকে। তোমাকে মজা বুঝিয়ে ছাড়ব। আমি শেফালির ভাই না। আমি মেছো ভূত। বলেই সে পালালো।
তাঁর দুই দিন পর আমি আবারো মাছ ভাজি করছি। রান্না ঘরে তখন ভূতটা আবার এলো। আমি রান্না ঘরের ভিতর থেকে ভূতটাকে দেখলাম। বাপরে বাপ কি যে বড় দাঁত, গা ভর্তি পশম। মাথা ভর্তি চুল। চেহারা কি বিশ্রী আর ভয়ানক। আমার কাছে যখন মাছ চাইলো আমি সব মাছ ভয়ে মেছো ভূতটাকে দিয়ে দিলাম। রাতে তোর দাদা আর আমার শাশুড়ী তো দিলো আমাকে ভীষণ বকা। ভূতে মাছ খেয়েছে সেটা তাঁরা বিশ্বাসই করলো না। তোর দাদা তো আমাকে বললো, আমি নাকি বোকা। ভূত বলতে নাকি পৃথিবীতে কিছু নাই।বকা ঝকা শুনে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যে ভাবেই হোক ভূতটাকে আমার সাইজ করতে হবে। ওকে যথেষ্ট শাস্তি দিতে হবে।
শাকিব একটু সাহসী হলো। সে দাদীকে বললো, নিশ্চয় কড়া শাস্তি দিয়েছিলে ভূতটাকে। কি শাস্তি দিয়েছিলে দাদী? ভূতটা বেঁচেছিলো নাকি তোমার শাস্তি পেয়ে মরে গিয়েছিলো?
শোন বলছি। আমি তখন ভাবলাম একটা কুড়াল পুড়া দিব।পুড়া দিব রান্নার চুলোয়। পুড়ে লাল টকটকে যখন হবে তখনই করব কাজটা। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনদিন পর আবারো মাছ আনলো বাড়ীতে। আমি রান্না ঘরে গিয়েছি মাছ রান্না করতে। চুলোয় দিয়ে রেখেছিলাম কুড়ালটা। এটা পুড়ে লাল টকটকে হলো। তখনি মেছো ভূতটা এলো। এসেই বললো, আমায় মাছ দে। আমি বললাম সত্যিই মাছ খাবি? ভূতটা বললো, মাছ খেতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমি বললাম, আজকের মাছটা তো ভীষণ বড়।তুই বড় করে হা করতে পারবি? ওমা তাই নাকি। তাহলে তো দারুণ হয়। আমি বড় করেই হা করব। ভূতটা বললো। এই ফাঁকে আমি আগুনে পোড়া লাল টকটকে কুড়ালটাকে চুলা থেকে বের করলাম।তাঁরপর মেছো ভূতটাকে বললাম, এবার হা করতো বড় করে। ভূতটা তাঁর সমস্ত শক্তি দিয়ে তাঁর মুখটা হা করলো। আমি এবার হঠাৎ লাল টকটকে কুড়ালটাকে ভূতের মুখে দিয়ে দিলাম। ভুতটাতো ও মাগো, ও বাবাগো বলে কাঁদতে কাঁদতে আর ছটফট করতে করতে রান্না ঘরের পিছনে মারা গেলো। আমি আর রাত করে ভয়ে সেখানে যাইনি। সকালে গিয়ে দেখি সেখানে একটা কাক মরে পড়ে আছে।
শাকিব বললো, ভূত মরলে কি কাক হয়ে যায়? দাদী বললো, মাঝে মাঝে ভূতেরা মরে কাক হয়ে যায়। সেই মেছো দুষ্টু ভূতটাতো মরে কাকই হয়েছিলো। দাদীর কথা আর গল্প শুনে শাকিব তাঁর সাহসী দাদীর কপালে একটা চুমো দিয়ে দিলো।