মধুমাসের গল্প
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুন ২০২১, ৯:৫১:২৬ অপরাহ্ন

শেখ একেএম জাকারিয়া
জ্যৈষ্ঠ মাস বাংলা বর্ষপঞ্জি ও গ্রীষ্ম ঋতুর দ্বিতীয় মাস। গ্রেগোরীয় বর্ষপঞ্জির ১৫ মে থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত যার কালপর্ব। এখন জ্যৈষ্ঠ মাস। এ মাসে পত্রিকায় চোখ রাখলে প্রায় সময়ই দেখতে পাওয়া যায় ‘মধুমাস’ শিরোনাম। এছাড়া কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক কারণেও জ্যৈষ্ঠ মাসকে ‘মধুমাস হিসেবে। (পোস্টার-ব্যানারে লিখে কিংবা মাইকিং করে)চালিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু কেন তারা এমনটা করছেন? তারা কি আদতেই জেনেবুঝে কাজটি করছেন? না কি ফলের মাস ভেবে না বুঝেই মধুমাস হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছেন।
আবার কিছু লেখক আছেন যারা তাদের গদ্য বা পদ্যে লিখছেন জ্যৈষ্ঠ মাস মধুমাস।
কেউ কেউ আবার তাদের রচিত নিবন্ধে চৈত্রকে মধুমাস আর জ্যৈষ্ঠকে ফলের মাস বলে উল্লেখ করেছেন।
এখন পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে- মধুমাস আসলে কোনটি? এ প্রশ্নের জবাব বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান থেকে পাওয়া যায়, চৈত্র মাস মধুমাস। পুরনো বইপত্রাদি ঘাঁটাঘাঁটি করলেই দেখতে পাওয়া যাবে, যুগে যুগে আমাদের দেশীয় সাহিত্যে চৈত্রমাসই মধুমাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দুঃখের কথা এটাই যে, হঠাৎ করেই জ্যৈষ্ঠ মাসের ফলে ঘ্রাণে গণমাধ্যমগুলো একে মধুমাস বানিয়ে দেয়। আর, সেই থেকেই বর্তমানে জ্যৈষ্ঠ মাসই মধুমাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইদানীং পত্রিকা খুললেই কিছু শিরোনাম চোখে পড়ে। যেমন জ্যৈষ্ঠ মাস মধুমাস, জ্যৈষ্ঠ মাস রসে ভরা মধুমাস, জ্যৈষ্ঠ মাস মিষ্টি ফলের রসভরা মধুমাস। আর এভাবেই এ সময়ে জ্যৈষ্ঠ মাসের সঙ্গে মধুমাস শব্দটি বিশেষভাবে যুক্ত হয়ে গেছে। হাট-বাজারে এখন মিষ্টি ফলের সুবাস। গ্রাম-শহরের বাজারগুলোতে ব্যবসায়ীরা ফলের দোকান সাজিয়ে বসেন। মফস্বল ও জেলা শহর থেকে প্রতিদিন-ই রাজধানীতে আসতে থাকে নানা জাতের ফল। ফলের মিষ্টি ঘ্রাণে ভরে উঠেছে ফলের আড়তগুলো। এসব দৃশ্য অবলোকন করে দেশীয় সংবাদকর্মী কিংবা লেখকগণ বোঝাতে চান- জ্যৈষ্ঠ মাসে আম, জাম, কাঠাল, লিচু, আনারস, তরমুজ, বাঙ্গি, বেল, ডেউয়া লটকন, গোলাপজাম, বেতফল, গাব, জামরুল, কাঁচা তাল, জাম্বুরা, আতাফল, খেজুর, কাউফল, শরীফা, করমচা, ফুটি, কামরাঙা প্রভৃতি ফল পাওয়া যায়। এসব ফলের ম-ম ঘ্রাণে জ্যৈষ্ঠ মাস তাদের কাছে হয়ে উঠেছে মধুময়। তা ছাড়া জ্যৈষ্ঠ নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক কবিতা ও গান। এ মাস এলেই মনে পড়ে পল্লীকবি জসীম উদদীনের সেই হৃদয় হরণকরা পদ্য-আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা/ ফুল তুলিতে যাই/ফুলের মালা গলায় দিয়ে/মামার বাড়ি যাই/মামার বাড়ি ঝড়ের দিনে/আম কুড়াতে সুখ/পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. মোহাম্মদ আমীন তার একটি নিবন্ধে লিখেন, “মধুমাস শব্দের অর্থ চৈত্র মাস। অনেকে জ্যৈষ্ঠ মাস অর্থে শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। এটি অশুদ্ধ। মধুমাস কেবল চৈত্র মাসকে বোঝায়। অন্যদিকে মধুফল বলে কোনো শব্দ বাংলা অভিধানে নেই। তবে বৃন্দাবনের একটি বনের নাম মধুবন। কিন্তু মধুফল নামের কোনো ফল কোথাও নেই। পত্রিকাদি ঘেঁটে জানা যায়, দেশীয় গণমাধ্যমে আশির দশক থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসের আরেক নাম ‘মধুমাস’ শব্দটির ঢালাও প্রয়োগ শুরু হয়েছে। আর এ কারণেই মধুমাস’ শব্দটির আভিধানিক বা আসল অর্থ আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্ধেকের বেশি গবেষকদের ধারণা, জ্যৈষ্ঠ মাসে আমজাম-কাঁঠাল-লিচুসহ অনেক সুস্বাদু ফল পাওয়া যায় বিধায় কিছু সংবাদকর্মী বা লেখক মধুমাস শব্দটির আভিধানিক বা ঠিক অর্থ। না জেনেই ধরে নিয়েছেন, মধুমাস মানেই জ্যৈষ্ঠ ১ করা হয়, সর্বপ্রথম দৈনিক বাংলাই জ্যৈষ্ঠ মাস অর্থে মধুমাস শব্দটি চালু করেছে। অথচ দৌলত উজির বাহরাম খান, প্রাচীন কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, কবিকঙ্কণ চণ্ডীদাস প্রমুখ কবিগণ তাঁদের কাব্যে। চৈত্রমাস অর্থেই মধুমাস শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যেমন দৌলত উজির বাহরাম খান তার কাব্যে বলেন,
‘মধুমাসে উতলা বাতাসে, কুহরে পিক;
যদি সে কমল শিশিরে দহল কি করিব মধুমাসে।’
কবির উপযুক্ত কাব্য পক্তিতে চৈত্র মাসের কথাই ফুটে উঠেছে। কারণ জ্যৈষ্ঠ মাসে আমরা কখনও কোকিলের ডাক শুনি না। অপরদিকে কবি মুকুন্দরাম তাঁর কাব্যে লিখেন,
‘মধুমাসে মলয় মারুত মন্দ মন্দ। মালতীর মধুকর পিয়ে মকরন্দ।’
এদিকে কবিকঙ্কণ চণ্ডীদাস তার কাব্য লিখেন, ‘মধুমাস আপায় মাধব পরশে।’ এখানে আপায় মানে গত হওয়া। তিনিও চৈত্র মাস বা বসন্তকাল অর্থে মধুমাস শব্দটি ব্যবহার করেছেন। লোকমুখে চলিত খনার বচনেও মধুমাস বলতে চৈত্র মাসকেই বোঝানো হয়েছে। যেমন,
মধুমাসে প্রথম দিনে হয় যেই বার
রবি শেষে মঙ্গল বযে, দুর্ভিক্ষ বুধবার।
সোম শুক্র শুরু আর
পৃথ্বী সয় না শস্যের ভার॥
পাঁচ শনি পায় মীনে
শকুনি মাংস না খায় ঘুণে।’
অর্থাৎ চৈত্র মাসের প্রথমদিন রবিবার হলে অনাবৃষ্টি, মঙ্গলবার হলে বৃষ্টি, বুধবার হলে দুর্ভিক্ষ হয়। সোম, শুক্র আর বৃহস্পতিবার হলে প্রচুর শস্য এবং চৈত্র মাসে পাঁচ শনিবার হলে মড়ক হয়। শনির অবস্থাভেদে চৈত্র মাসের ফল সম্বন্ধে খনার বচন থেকে আরো জানা যায়,
‘মধুমাসের ত্রয়োদশ দিনে যদি রয় শনি।
খনা বলে সে বৎসর হবে শস্যহানি।’
এদিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গানে লিখেন,
‘আজি মধু সমীরণে নিশীথে কুসুম বনে তাহারে পড়িছে মনে। বকুল তরল।’
অথবা আজি উম্মাদ মধুনিশি ওগো চৈত্রনিশীথশশী । তুমি এ বিপুল ধরণীর পানে কী দেখিছ একা বসি চৈত্রনিশীথশশী। মধু শব্দের অর্থ যে বসন্ত বা বসন্তকাল উল্লিখিত গানেই তার প্রমাণ মিলে।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার ‘মেঘনাদবধ কাব্যে বসন্তকাল অর্থেই মধুকাল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন: ‘নাদিল দানব-বালা হুহুঙ্কার রবে, মাতঙ্গিনী-যুথ যথা মত্ত মধুকালে।’ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ আর জ্ঞানেন্দ্রমোহন। দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’ বইয়ে মধুমাস বলতে চৈত্রমাসি বলা হয়েছে।
এছাড়া হিন্দি ‘বাহারী’ শব্দের বাংলা অর্থ- মধুকাল বা মধুমাস। আবার হিন্দি ‘বাহারকে দিন’ শব্দের অর্থ বসন্তকাল। ফারসিতে প্রায় একই শব্দ ‘বহার’ অর্থ বসন্তকাল আর ‘বহারী’ অর্থ বাসন্তী। বা বসন্তকাল সম্বন্ধীয়। উল্লিখিত শব্দগুলোর অর্থ বিশ্লেষণের পর বলাই যায় যে, সংবাদ মাধ্যম বা বর্তমানের কিছু পুস্তিকাতে যে মধুমাস পালন করা বা লেখা হচ্ছে সেটা মূলত না জানারই কারণ।
উপযুক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, ফাল্গুন ও চৈত্র মাস মিলে যে বসন্তকাল আমরা পাই তাই মধুমাস বা মধুকাল। মোটকথা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বইয়ে মধুকাল বলতে ফাগুন-চৈত্রের বসন্তকালকেই বোঝানো হয়েছে।
তবে এটাই চিরন্তন যে, সময়ের নিরিখে যে কোনো শব্দের অর্থ বদলে যেতেই পারে। যুগে যুগে কতকিছুই তো বদল হয়েছে। গতিশীল এ পৃথিবীতে বদলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। নতুন ‘মধুমাস’ এরই দলিল। পরিশেষে এটাই বলতে চাই, মধুমাসের আভিধানিক বা পুরনো অর্থ মনে করে দুঃখ পেয়ে আর কী লাভ। এক সময় দেখা যাবে নতুন শব্দটিই মানুষের কল্পনায়-বাস্তবে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।