মহাকাব্যিক ডিসকোর্সের স্রষ্টা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ মে ২০২২, ৬:০৬:১৭ অপরাহ্ন

মাসুদুজ্জামান
‘সমাজবিজ্ঞান, দর্শন বা মনস্তত্ত্ব মানুষকে যতটুকু দেখাতে পারে, সাহিত্য তো আমি মনে করি আরেকটু এগিয়ে দেখাতে পারে,’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসই একবার বলেছিলেন এ রকম কথা। সাহিত্য, বোঝা যায়, ইলিয়াসের কাছে ছিল অন্তর্র্দশী উন্মোচক শিল্পমাধ্যম। উপন্যাসের শক্তি এই টোটালিটিতেই মনে করেছেন তিনি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বলা বাহুল্য, আমাদের একক প্রধান কথাসাহিত্যিক।
শুধু আমাদের নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে যদি বিবেচনা করি, তাহলে তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর পাশাপাশি তাঁর নাম সর্বাগ্রে উচ্চারণ করতে হবে। বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর স্থান এখন প্রায় শীর্ষে। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, কয়টি উপন্যাস আর গল্পই বা লিখেছিলেন তিনি? উপন্যাসের সংখ্যা মাত্র দুই, গল্পের সংখ্যা ২৭-২৮। সব মিলিয়ে স্বল্পপ্রসূ লেখকই বলা যায় তাঁকে। কিন্তু সংখ্যায় নয়, গুণগত বিচারে তিনি সবাইকে প্রায় ছাড়িয়ে গেছেন।
ইলিয়াসের আবির্ভাবকালটিও আমাদের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে। তিনি যে বছর জন্মগ্রহণ করেন তার চার বছরের মাথায় ভারত বিভক্তি ঘটে যায়। রাজনৈতিকভাবে ‘স্বাধীনতা’র নামে তখন দেশভাগ হয়ে যায় ঠিকই, তবে অমানবিক বিপর্যয়ের শিকার হতে হয় পূর্ব আর পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু আর মুসলমানদের। ইলিয়াসের রচনাসমগ্রেও এর তীব্র, গভীর প্রভাব পড়েছে।
ইলিয়াস আমাদের মধ্যে আরেক বিস্ময়কর গৌরবদীপ্ত অনুভবের জন্ম দিয়েছেন। সেটি হলো, তিনিই হচ্ছেন বাংলাদেশের প্রথম সচেতন কথাশিল্পী রাজনৈতিক পটভূমিতে, যাঁর রচনায় উপজীব্য হয়েছে বৃহত্তর জনমানুষের জীবন। ১৯৬০-এর দশকে তিনি যখন লেখালেখি শুরু করেন, তত দিনে বাংলা উপন্যাস ও ছোটগল্প সাবালকত্ব অর্জন করে ফেলেছে। বাংলাদেশের প্রথম দিককার উপন্যাসগুলো লেখা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে কিংবা তার ঠিক পর পর। এরই মধ্যে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র পেরিয়ে আবির্ভাব ঘটে গেছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তিন আধুনিক ঔপন্যাসিক ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর। বাঙালি মুসলমান লেখকদের পদচারণে বাংলাদেশের কথাসাহিত্য তখন মুখরিত। প্রবল না হলেও বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে যুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তরের ধাক্কা বেশ ভালোভাবেই এসে লাগে। সেই সঙ্গে তীব্রতা পায় পাকিস্তান আন্দোলন, বেধে যায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ঘটে দেশভাগ। কিন্তু ওই সময়ে ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে যাঁরা উপন্যাস লিখছিলেন-আবুল ফজল, শওকত ওসমান, আবু রুশদ, আবু ইসহাক, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, রশীদ করীম, সরদার জয়েনউদ্দিন-তাঁদের কারো রচনায়ই ওই সময়ের তীব্রমোথিত ঘটনার প্রতিফলন পড়েনি। গ্রামের যে চেহারা পাওয়া গেল, তা সামন্তশাসিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বিবর্ণ, দুর্ভিক্ষপীড়িত, স্থবির গ্রাম। দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ রাজনীতির পটভূমিতে ব্যক্তিক অস্তিত্বের অন্তর্গত সংকটকে কোনো ঔপন্যাসিকই তাঁদের রচনার বিষয় করে তুলতে পারলেন না।
জীবনের ছবি নয়, জীবনাভিজ্ঞানই যে উপন্যাসের মর্মকথা, সে কথা আমাদের শুনিয়েছেন আধুনিক নন্দনতাত্ত্বিক ইতালির উমবার্তো একো। কিভাবে এই অভিজ্ঞানকে ছুঁয়ে দেওয়া যাবে? আমাদের আরেক প্রধান কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন, ‘একমাত্র সজ্ঞান ও সচল প্রয়াস ছাড়া’ অর্জন করা যাবে না সেই শিল্পসিদ্ধি। ইলিয়াসের ছিল এই সচেতন অভিপ্রায়, বিস্ময় এখানেই। দুটি উপন্যাসেই তাঁর প্রতিভার অবিস্মরণীয় বিচ্ছুরণ ঘটল কী বিষয়বস্তুতে, কী শৈলীসম্পাতে। চলমান রাজনীতির ধারাপ্রবাহের পটভূমিতে ব্যক্তির অস্তিত্বমোথিত এমন গাথা তিনি রচনা করলেন, যা শুধু বাংলা সাহিত্যেই অনন্য হয়ে ওঠেনি, বিশ্বসাহিত্যেরও হয়ে উঠেছে প্রতিস্পর্ধী। প্রথমেই ইলিয়াসের এই উপন্যাস প্রসঙ্গ।
২.
কী রকম হওয়া উচিত সমকালীন উপন্যাস? অন্যান্য শিল্পের মতো একক কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে এর প্রকৃত চিহ্নায়ন সম্ভব নয়। তবু মিলান কুণ্ডেরা একবার বলেছিলেন, উপন্যাসে ‘ব্যক্তির আত্মসত্তার অন্তর্গত জীবনের উন্মোচন’ ঘটিয়ে থাকেন ঔপন্যাসিক। ইলিয়াসও এটি জানতেন, “কথাসাহিত্যচর্চার সূত্রপাত মানুষ যখন ব্যক্তি হয়ে উঠছে এবং আর দশজনের মধ্যে বসবাস করেও ব্যক্তি যখন নিজেকে ‘একজন’ বলে চিনতে পারছে তখন থেকে। ” ইলিয়াসও খুঁজছিলেন এই ব্যক্তিকে। আখ্যানের মধ্য দিয়ে গেঁথে তুলতে চাইছিলেন ‘ব্যক্তির অস্তিত্বের বোধ আর প্রাতিস্বিকতা’কে। কিন্তু ফ্রেডেরিক জেমিসন যেমন বলেছেন, পুঁজিবাদী বিশ্বরাষ্ট্র পুঁজিবাদের অন্তিমপর্বে ‘ব্যক্তিকে আমুণ্ড গিলে খেয়ে ফেলেছে’, তখন সেই ব্যক্তির ওপর ভর করে উপন্যাস লেখা হবে কী করে? ইলিয়াসের উপন্যাস আলোচনা প্রসঙ্গে হাসান আজিজুল হক জানাচ্ছেন, এই শূন্যতার মাঝে উপন্যাস রচনায় সাহিত্যতত্ত্ব যেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে সাহায্য করেনি, তেমনি ‘উপন্যাসের বুর্জোয়া মডেল’ও নয়। বাংলা ঔপন্যাসিকদের কাছ থেকেও কোনো সাহায্য পাননি তিনি। উপন্যাস রচনার বিকল্প পথের ধারণাটা তাঁর এসেছিল লাতিন আমেরিকা আর আফ্রিকার কথাসাহিত্য থেকে-‘চিলেকোঠার সেপাই’ রচনার সময়ে যেমন, তেমনি ‘খোয়াবনামা’র সময়েও। এই আখ্যানদ্বয়ে পশ্চিমী ঘরানার ব্যক্তি নয়, ইতিহাস নয়, জনপদই হয়ে উঠল উপন্যাসের নায়ক। ইউরো-মার্কিন উপন্যাসের পুরনো ধারাকে এভাবেই অস্বীকার করেছিলেন ইলিয়াস, বিশেষ করে ‘খোয়াবনামা’য় : ‘সে কি বাংলার এই প্রাচীন ভূমি, তার ইতিহাস, তার স্মৃতি-বিস্মৃতি নয়? তার ভাঙাগড়ার অবিরল প্রক্রিয়ার ভেতর জনপদগুলো-সেই সব জীবন্ত জনপদ, সেই সব নিশ্চল জনপদ, সেই সব ইতিহাসহীন বা ইতিহাসবিচ্যুত জনপদ, মানুষের টাটকা রক্ত, বাসি রক্ত। এই বাস্তব আর ইতিহাস মিলে লিখিত হলো খোয়াবনামা (হাসান আজিজুল হক)। ’
‘খোয়াবনামা’ আর ‘চিলেকোঠার সেপাই’ এই প্রেক্ষাপটেই হয়ে উঠেছে এপিক। আখ্যানের বুনন আর ভাষারীতিই যে কথাশিল্পের মূলকথা নয়, সে তো অনেক আগেই জেনে গেছি আমরা জেমস জয়েসের সূত্রে। সমকাল কিভাবে জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে, দেখিয়ে গেছেন জয়েস। এ কারণেই ‘চিলেকোঠার সেপাই’য়ের বয়ানভঙ্গি ও চরিত্র চিত্রণের সঙ্গে জয়েসের ‘ইউলিসিসে’র মিল খুঁজে পাওয়া যায়-এর ডিটেলস ও মনোজাগতিক জৈবরসায়নে। এরপর মার্কেজের মধ্য দিয়ে কিংবদন্তি আর ইতিহাস কিভাবে আঁশটে নোনাধরা অতীত থেকে উঠে এসে সমকালকে স্পর্শ করতে পারে, সেও তো জানা হয়ে গিয়েছিল। ‘খোয়াবনামা’য় তো ঘটল এই বয়ানভঙ্গি ও আখ্যান গঠনের মৌলিক দ্যুতিময় বিচ্ছুরণ।
ইলিয়াস এভাবেই ইতিহাসমোথিত সময়, মানুষ আর সমাজকে উপজীব্য করেছেন তাঁর উপন্যাসে। তিনি যথার্থই জানতেন ঔপন্যাসিকের এটিই মূল কাজ, ‘সমাজের বাস্তব চেহারা তাঁকে তুলে ধরতে হয় এবং শুধু স্থিরচিত্র নয়, তার ভেতরকার স্পন্দনটিই বুঝতে পারা কথাসাহিত্যিকের প্রধান লক্ষ্য।’ কিন্তু কিসের টানে এই কাজটি করবেন তিনি? লক্ষ্য সেই ‘ব্যক্তির স্বরূপসন্ধান’ আর সমকালকে এই সময়ের পাঠকের কাছে মূর্ত করে তোলা। তবে ব্যক্তির যে বিকাশ ও পরিণতি তাঁর অন্বিষ্ট ছিল, তার সবই ঘটেছে ‘ব্যক্তিপ্রেক্ষিত, সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি’র প্রেক্ষাপটে। ইলিয়াস মনে করেছেন, যে সমাজ অনড়, অচল, স্থবির, গতি নেই, সেই ধরনের স্পন্দনহীন সমাজের রূপকার নন ঔপন্যাসিক। সমাজ উপন্যাসে ‘রক্তমাংস নিয়ে হাজির হয়’ কি না আর ব্যক্তি সেই সমাজের মধ্যে ‘উপযুক্ত প্রেক্ষিত পায়’ কি না, সেই দিকগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ প্রেক্ষিতনির্ভর ব্যক্তির এই গতিময় ডিটেলসমৃদ্ধ জীবনযাপনের কথা না থাকলে কোনো উপন্যাস সম্পূর্ণতা পায় না, এ রকমই ভাবতেন ইলিয়াস। আর এই ভাবনার প্রেক্ষাপটেই তিনি মনে করেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ই ছিলেন ‘আন্তর্জাতিক’ মাপের কথাসাহিত্যিক। লক্ষণীয়, ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’য় বিভিন্ন চরিত্রের সামাজিক জীবন এবং ব্যক্তির জীবনযাপনের যে অণুসূক্ষ্ম ডিটেলসমৃদ্ধ গতিশীল বর্ণনা পাই, তার পূর্বসূত্র শুধু খুঁজে পাওয়া যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে। এরই সঙ্গে তাঁর উপন্যাসে এসে মিশেছিল মার্কেজের মহাকাব্যিক মেজাজ। কিংবদন্তি, লোককথা, লোকগান, প্রবাদ-প্রবচন, পুরাণ আর সমাজের অনুপুঙ্খ বর্ণনার সঙ্গে অবিমিশ্র হয়ে গিয়েছে ইতিহাস ও রাজনীতি।
৩.
শুধু কি উপন্যাস রচনায় অদ্বিতীয় হয়ে আছেন ইলিয়াস? একেবারেই নয়। তাঁর গল্পগুলোও বাংলা গল্পঘরানার উল্টো দিক থেকে রচিত। বাংলা কথাসাহিত্য সামগ্রিকভাবে মধ্যবিত্তের রচনা, মধ্যবিত্তই এর পাঠক, মধ্যবিত্তের রুচি, মনমানসিকতাই প্রতিফলিত হয়ে আসছে বাংলা ছোটগল্পে। কী এর ভাষা, কী এর বিষয়-আশয়, মধ্যবিত্তের গণ্ডি ছাড়িয়ে কখনো কখনো নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ বা কৃষকজীবনকে স্পর্শ করলেও বাংলা ছোটগল্প ওই মধ্যবিত্তের গণ্ডিতেই আটকে ছিল। কিন্তু ইলিয়াসই ফ্রথম ভেঙে দিলেন সেই বৃত্ত। বিষয়ের এই অভিনব উদ্ভাসের ফল হিসেবেই তাঁর গল্পের ভাষারীতিকে যাবতীয় ছুঁতমার্গ থেকে মুক্তি দিতে পেরেছেন। মধ্যবিত্তের রুচি আর দেখার চোখটিকেও বদলে দিয়েছেন তিনি।
মধ্যবিত্তের বৃত্তাবদ্ধ ব্যক্তিজীবন, স্বরচিত নৈঃসঙ্গ্য, কুণ্ডলায়িত আত্মরতি অথবা তীব্রমোথিত রোমান্টিকতা আর স্বপ্নলোকের কথায় ভরা ছিল বাংলা সাহিত্য। নিম্নবিত্তের জীবনকে যে তা ছুঁতে চায়নি, তা নয়। কিন্তু সেই ব্যক্তিজীবনকে গল্পকাররা প্রত্যক্ষ করেছেন কিছুটা আর্দ্র, করুণ রঙিন চোখে। এই দৃষ্টিকোণ নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের উঁচু-নিচু অবস্থাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এসব ক্ষেত্রে লেখক কখনোই যে ব্যক্তি মানুষকে উপজীব্য করতে চান, সেই সমতলে নেমে আসতে পারেননি। কিন্তু ইলিয়াস নিম্নবৃত্তের সেই স্তরে নেমে এসেছেন, যেখান থেকে চরিত্রগুলোকে তাদের নিজস্ব পরিমণ্ডল থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। তাদের একজন হয়ে ওঠা যায়। বাংলা ছোটগল্পে যে ‘রূপকথা-লোলুপতা’ ছিল, সেখান থেকে তিনি সরে এসে কর্কশ, তিক্ত, ‘ফাঁস লাগানো’ বাস্তবতাকেই গল্পের পর গল্পে উপস্থাপন করে গেছেন। বিষয়ের এই টানে নতুন এক ভাষারীতি ও বর্ণনাভঙ্গিও তিনি আবিষ্কার করে নিয়েছিলেন। এ কারণে অনেকের কাছেই মনে হতে পারে তাঁর গল্পের ভাষা অশ্লীল, খিস্তিখেউড়ে ভরা, অমার্জিত, শ্লেষ মিশ্রিত। উল্লিখিত বিষয়ের টানে ইলিয়াসের গল্পের ভাষাও হয়ে উঠেছে অনন্য। ভাষাই হচ্ছে তাঁর গল্পের প্রধান শক্তি।
নিম্নবিত্তের মানুষের জীবনকে এভাবে তুলে আনা প্রকৃতপক্ষে ইলিয়াসের জীবনাদর্শের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল। ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ প্রবন্ধে তিনি এ কারণেই আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন, ‘আজ মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।’ কিন্তু যে মধ্যবিত্ত আজ তাদের ‘মুক্তির জন্য স্থিরসংকল্প’, তাদের ‘শ্রমজীবী নিম্নবিত্তের সঙ্গে যোগাযোগ’ রাখতে হবে। তিনি এও জানতেন শিল্পসিদ্ধির চাবিকাঠি আসলে কী : ‘নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর সংস্কৃতি শিল্পীর হাতে নতুন ব্যঞ্জনা পায়, এই সংস্কৃতি শিল্পে উত্তীর্ণ হয়ে সর্বজনীনতা লাভ করে।’ ইলিয়াসের এই অবস্থান বিস্ময়কর হলেও ইতালির প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী ভাবুক আন্তোনিও গ্রামসির ভাবনার সঙ্গে মিলে যায়। গ্রামসিও চেয়েছিলেন নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীরা যদি যুক্ত না হতে পারেন, তাঁদের জীবনযাপনের সমতলে যদি নেমে না আসতে পারেন, তাহলে জনমানুষের সার্বিক মুক্তি অর্জন করা কখনোই সম্ভব হবে না।
বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে যে গল্প রচনার প্রায় শুরু থেকেই তিনি একজন পরিণত লেখক। অনেক প্রস্তুতি নিয়ে, দীর্ঘদিনের নেপথ্য অনুশীলনীর মাধ্যমে পরিণতির একটা পর্যায়ে পৌঁছনোর পরেই যে তিনি গল্প রচনায় হাত দিয়েছিলেন, সেটি তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ থেকে ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’ পর্যন্ত সংকলিত গল্পগুলো পড়লেই তা বোঝা যাবে। ‘জীবনের শেষ গল্পের শেষ বাক্যে কলম থামা পর্যন্ত তিনি সর্বাংশে প্রস্তুত পরিণত এবং অমোঘ একটি কলমের অধিকারী ছিলেন।’ তাঁর ন্যারেটিভের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চরিত্রের ক্রিয়াশীলতা, ভাবনা, পরিপ্রেক্ষিত, সংলাপ, বর্ণনা এবং মতাদর্শ সামগ্রিক ঐক্যে গ্রোথিত হয়ে একেকটা রচনাকে মহৎ শিল্পকর্মে রূপান্তরিত করেছে। বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো লেখক তাই সত্যি বিরল। দুই বিপরীত বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে উপন্যাস ও ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে পৌঁছতে চেয়েছেন ব্যক্তিসত্তার গভীরে। মানুষকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন, তাঁর রচনায় এই বিষয়টি সুস্পষ্ট। ব্যক্তির জীবনপরিসরকে কিংবদন্তি, ইতিহাস আর সমকালের এমন অভাবনীয় পটে মেলে ধরেছেন যে তার প্রতিটি রচনাই হয়ে উঠেছে আমাদের জীবনের অস্তিত্বগাথা, একই সঙ্গে বর্তমান ও ভবিষ্যতের মহাকাব্যিক ডিসকোর্স। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের স্থান যে শীর্ষে অধিষ্ঠিত থাকবে, আমার অন্তত তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।