মানবজীবনে দারুল কিরাতের গুরুত্ব
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ এপ্রিল ২০২২, ১১:৫৪:০৯ অপরাহ্ন

মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
মানবমুক্তির দর্পণ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। আল-কুরআন চর্চা মানবমুক্তির পূর্বশর্ত। যে বিষয়টির চর্চা না করলেই নয়; যে বিষয়টির চর্চা না করলে মানবতার মুক্তির কোনো সুযোগ নেই-সেটিই হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। সেই মহাগ্রন্থ আল-কুরআন চর্চার প্রাথমিক পর্যায় হচ্ছে বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত শিক্ষা লাভ করা। কুরআন বুঝতে হলে, বুঝাতে হলে কুরআনের আয়াতের সঠিক মর্ম উপলব্ধি করতে হলে সর্বপ্রথম সেই কুরআনের বিশুদ্ধ তেলাওয়াত শিক্ষা লাভ করতে হবে। সালাত আদায় করা সকল মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ। সেই সালাত বিশুদ্ধ হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে কুরআন তেলাওয়াত বিশুদ্ধ হওয়া। বিশুদ্ধ কুরআন তেলাওয়াত ছাড়া কখনও সালাত বিশুদ্ধ হবে না। বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত শিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘দারুল কিরাত’। ‘দারুল’ আরবী শব্দ। এর মানে ঘর, বাড়ি প্রতিষ্ঠান। ‘কিরাত’ আরবী শব্দ। এর মানে কুরআনে পাঠের বিশেষ নিয়ম, পাঠ করা, তেলাওয়াত করা। এখানে ‘দারুল কিরাত’ প্রতিষ্ঠান অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। যে প্রতিষ্ঠানে বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করার নিয়ম-পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া হয়, সেই প্রতিষ্ঠানকে ‘দারুল কিরাত’ বলে। বিশুদ্ধভাবে কুরআন শিক্ষা করা সকলের উপর ফরজ। তাই মানবজীবনে দারুল কিরাতের গুরুত্ব অপরিসীম।
আমাদের জীবনে সমস্যার অন্ত নেই। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য আমরা সব ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি; কিন্তু কোনো সমাধান পাইনি, কারণ এসব পরিকল্পনা আমাদের মনগড়া। ব্যক্তিগত, দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই আমাদের এসব পরিকল্পনা। এ জন্য এসব পরিকল্পনায় আমাদের সকল সমস্যার প্রকৃত সমাধান পাইনি, আর পাবো না। প্রশ্ন হলো, আমাদের সমস্যাবলীর সমাধানের প্রকৃত গাইডলাইন কি আমরা খুঁজেছি? আর এই গাইড লাইনের চর্চা কি আমরা করেছি? না, আমরা আমাদের মুক্তির গাইডলাইন খুঁজিও নাই এবং এর মোটেই চর্চা করি নাই। মানবতার চিরশান্তি ও চিরমুক্তির জন্য প্রকৃত গাইডলাইন প্রদান করেছেন এই বিশ্বনিয়ন্তা একমাত্র আল্লাহ। বিশ্বনিয়ন্তা মহান আল্লাহ মানবজাতির মুক্তির গাইডলাইন স্বরূপ নাজিল করেছেন মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। ইরশাদ হচ্ছে (১) ‘কিতাবে কোনো কিছুই আমি বাদ দেই নাই’ (সূরা আনআম ঃ আয়াত-৩৮)। (২) ‘আমি তোমার প্রতি এই কিতাব (কুরআন) নাজিল করেছি, যাতে রয়েছে সকল সমস্যার সুস্পষ্ট সমাধান’ (সূরা নাহল ঃ আয়াত-৮৯)
কুরআনের বিধান মানুষ যাতে সহজভাবে বুঝতে পারে সেজন্য আল্লাহপাক কুরআনের প্রতিটি বিধান সহজ, সুন্দর ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে ‘কুরআনকে আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, কে আছে উপদেশ গ্রহণের জন্য?’ (সূরা কামার ঃ আয়াত-১৭, ২২, ৩২, ৪০)। পবিত্র কুরআনে প্রতিটি বিষয় আল্লাহপাক অত্যন্ত সুন্দর, সহজভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আমরা কুরআন বুঝিনা, কুরআন চর্চা করি না, কুরআন চর্চার চেষ্টাও করি না। যদি মনোযোগ দিয়ে আমরা কুরআন চর্চা করতাম তাহলে কুরআনের বিধান সহজে বুঝতে পারতাম এবং জীবন দিয়ে হলেও আমরা কুরআনের বিধান জীবনের সকল ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতাম। সেই মহাগ্রন্থ আল-কুরআন চর্চার প্রথম পর্যায় হচ্ছে বিশুদ্ধ কুরআন তেলাওয়াত। আর বিশুদ্ধ কুরআন তেলাওয়াত শিক্ষার জন্য অতি প্রয়োজন দারুল কিরাতের প্রতিষ্ঠান।
কুরআনের বিধান অমান্য করার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। ইরশাদ হচ্ছে ‘রাসূল বলবেন, হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় তো এই কুরআনকে পরিত্যাজ্য করে রেখেছিল’ (সূরা ফুরকান ঃ আয়াত-৩০)। যারা বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করে না, যারা কুরআন চর্চা করে না, যারা কুরআনের বিধান মানে না, তাদের ভয়াবহ পরিণামের কথা উক্ত আয়াত দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে গেল। ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির জন্য অবশ্যই বিশুদ্ধ করে কুরআন তেলাওয়াত শিখতে হবে, কুরআন চর্চা করতে হবে, কুরআনের আইন জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে হবে। কুরআন চর্চার জন্য আল্লাহপাক আমাদেরকে বারবার তাগিদ দিচ্ছেন। ইরশাদ হচ্ছে ‘তবে কি তারা কুরআন সম্বন্ধে অনুধাবন করে না। ইহা যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো (বাণী) হতো তবে তারা ইহাতে অনেক অসংগতি পেত’ (সূরা নিসা ঃ আয়াত-৮২)। আরও ইরশাদ হচ্ছে ‘তবে কি তারা কুরআন সম্বন্ধে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করে না? না উহাদের অন্তর তালাবদ্ধ?’ (সূরা মুহাম্মদ ঃ আয়াত-২৪)। আল-কুরআন বিশুদ্ধ করে শিক্ষা লাভ করা, কুরআন বুঝা এবং বুঝানো মানব জীবনের জন্য এমন একটি অপরিহার্য বিষয় যা থেকে কখনও দূরে থাকা যাবে না। কুরআন চর্চা থেকে দূরে থাকা মানেই গোটা মানবজীবনকেই ধ্বংস করে দেয়া। আল-কুরআন মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মানব জীবনের মূল চালিকা শক্তিই হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। মূল অঙ্গ ছাড়া যেমন মানুষ অচল তেমনি পবিত্র কুরআন ছাড়া মানবজীবন সম্পূর্ণ অচল। তাই মানবজীবনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কুরআন চর্চার বিকল্প নেই।
আমরা মুসলমান। ইসলাম আমাদের ধর্ম। ইসলাম সর্বজনীন ধর্ম। আমরা বিশ্বের দরবারে সভ্য জাতি। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন আমাদের ধর্মগ্রন্থ। আমরা শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠ উম্মত। আমাদের ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনই শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ। মহাগ্রন্থ আল কুরআন নিয়ে আমরা গর্ব করি। কুরআন নিয়ে আমরা গর্ব করি বটে-দুঃখজনক বাস্তব ঘটনা হলো, আমরা সবাই মুখে কুরআনের কথা বলি কিন্তু আমাদের অন্তরে কুরআন নেই। অন্তর দিয়ে আমরা কুরআন মানি না। বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারেন এমন মুসলমান আছেন কয়জন?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারেন এমন মুসলমান প্রতি হাজারেও একজন পাওয়া যাবে না। আর কুরআনের আয়াতের অনুবাদ করতে পারেন এমন মুসলমান প্রতি লাখে একজন পাওয়া যাবে না। যারা বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে জানে না, যারা কুরআনের আয়াতের অনুবাদ জানে না তারা কুরআনের বিধান জীবনে কিভাবে বাস্তবায়ন করবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে উচ্চ শিক্ষা দেয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করি। এত টাকা ব্যয় করার পরও আমাদের ছেলে-মেয়েরা নৈতিকতা শিক্ষা বলতে কিছুই পায় না। এই লক্ষ লক্ষ টাকা বিফলে চলে যায়। কিন্তু আমাদের সন্তানরা কুরআন শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করুক এবং এতে আমরা অতি সামান্য টাকা ব্যয় করি-এ ব্যাপারে আমরা মোটেই রাজি হই না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। যে শিক্ষা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের কোনো কাজে আসে না, সেই ব্যর্থ-বিফল শিক্ষার জন্য আমরা লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করতে মোটেই কুন্ঠাবোধ করি না। অথচ কুরআন শিক্ষা হচ্ছে সর্বজনীন শিক্ষা। সেই কুরআন চর্চায়ই রয়েছে মানবতার প্রকৃত মুক্তি। কুরআন শিক্ষাই হচ্ছে মানবজাতির মৌলিক শিক্ষা। সকল কল্যাণ নিহিত রয়েছে সেই কুরআন শিক্ষায়। এই কুরআন শিক্ষায় টাকা ব্যয় করতে আমাদের সকল অনীহা। এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কি হতে পারে? কুরআন চর্চায় এত অনীহা আর কতকাল?
ইহ-পরকালীন কল্যাণে বিশুদ্ধ করে কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। সর্বদা তারতীলের সাথে, বিশুদ্ধভাবে কুরআন পাঠ করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘কুরআন পাঠ কর ধীরে ধীরে, সুস্পষ্ট ও সুন্দরভাবে’ (সূরা মুজ্জাম্মিল ঃ আয়াত-৪)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে ‘যাদেরকে কিতাব দিয়েছি তাদের যারা ইহা তেলাওয়াত করে যথাযথভাবে তারাই ইহাতে বিশ্বাস করে, আর যারা ইহা প্রত্যাখ্যান করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত’ (সূরা বাকারা ঃ আয়াত-১২১)। বিশুদ্ধভাবে কুরআন শিক্ষা করা এবং শিক্ষা দেওয়ার গুরুত্ব বর্ণনা করে হযরত ওসমান (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম, যে কুরআন শিক্ষা করে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়’ (বুখারী শরীফ ২য় খন্ড ঃ পৃষ্ঠা-৭৫২)।
কুরআন চর্চা ছাড়া মানবতার মুক্তি সম্ভব নয়। সেই কুরআন চর্চার প্রথম ধাপ হচ্ছে বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত শিক্ষা লাভ করা। এ জন্য অতি প্রয়োজন দারুল কিরাত প্রতিষ্ঠা করা। অতএব স্থানে স্থানে দারুল কিরাতের প্রতিষ্ঠান তৈরি করে বিশুদ্ধ কুরআন শিক্ষায় এগিয়ে আসা আমাদের সকলের উচিত।