মায়াবিনী লেকে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ জুলাই ২০২২, ৭:০৬:৫৯ অপরাহ্ন

চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী
পূবালী অফিসার হেলাল আহমদ এবার আমাদেরকে নিয়ে ছুটলেন পানছড়ি মায়াবিনী লেকে। জেলাশহর খাগড়াছড়ি হতে দশ-বার মাইল দূরে পানছড়ি উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের কাংচাইরি পাড়ায় এক পাহাড়ি নিসর্গ মায়াবিনী লেক। একটি বেবীটেক্সি ভাড়া করে ছুটলাম মায়াবিনীর মায়ায়। রাস্তার দু’পাশে পাহাড়, জনশূন্য প্রান্তর, মাঝে মাঝে পাহাড়ি গ্রাম। থাই চেহারার গাগরাপড়া নারী, লুঙ্গি ও রঙ্গিন সার্ট গায়ে উপজাতীয় পুরুষ চোখে পড়ে। বাঙালি লোকজন নাই বললেই চলে। দু’পাশের উপত্যকায় সবজিক্ষেত, আম্রপলি ও কলাবাগান, ইক্ষু ও ধানক্ষেত। মনে হল এলাকাটা মিনি নেপাল। রাস্তার সমান্তরালে আঁকাবাঁকা বয়ে গেছে এক সুন্দর পাহাড়ি ছড়া, লোকে বলে ভাইবোনছড়ি।
পাহাড়ি জনপদে জনপদে চোখে পড়ে সুরম্য বৌদ্ধমন্দির। দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা উপজাতিরা হাতে টাকা এলেই প্রথমে মন্দির নির্মাণ করেন। তাঁরা ভগবান বৌদ্ধকে রোজগারের একটি বড় অংশ করেন কঠিন চিবর দান। রাস্তার পাশে ক্ষেতের কিনারে কিনারে কিছু ছোট ছোট সমাধি মন্দির চোখে পড়ে। পাহাড়ি জনতারা এসব মন্দিরে তাঁদের প্রিয়জনেদের দেহভস্ম রেখে দেন পরম মমতায়। পাহাড়ি গ্রামে গ্রামে সুঠাম দেহের উপজাতি নরনারী দেখে মনে হল তাঁরা সুখেই আছেন।
আমরা পাহাড়ঘেরা মায়াবিনী লেকের ঘাটে নামলাম। মায়াবিনী লেকে তখন বসন্তের মায়াবী রোদ মধু ছড়াচ্ছে, নাতিশীতোষ্ণ বাতাস বইছে। এত ভিতরে পাহাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলের নির্জন প্রান্তরে বিদ্যুৎ আছে, আছে উন্নত পাকা রাস্তা। ভাবলাম ধীরপদে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একটি চা-ঘর চালান একজন স্বনির্ভরা উপজাতি নারী। আমরা তাঁর হাতের পরিবেশিত চায়ে চুমুক দেই। লেকপারের রাস্তা দিয়ে হাঁটি, টিলায় হেঁটে সিলেটে পাহাড়ে ঘুরার স্বাদ নেই। ওপারে মাইক বাজছে, মাইকের আওয়াজ নির্জন প্রান্তরে মানুষের বিচরণ জানান দিচ্ছে। চেয়ে দেখি লেকের অপর পারে একটি স্থাপনায় হাউজি চলছে। হাউজিতে অংশগ্রহণ করেছেন প্রায় ষাট সত্তুর জন নর-নারী ও শিশু। তাঁরা প্রায় সবাই উপজাতীয় লোকজন, বাঙালি হাতেগুণা। হাউজির লটারি পরিচালনা করছেন বেশ বাকপটু একজন উপজাতীয় ঘোষক। তাঁর প্রতিটি বাক্যে কৌতুক ও হাসির খোরাক রয়েছে। জনতা তাঁর রসালাপ বেশ উপভোগ করছেন।
লেকপারের গাছতলায় সজ্জিত ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে নয়নাভিরাম প্রকৃতি দেখি। লেকের প্রমোদ নৌকায় পর্যটকরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা এবার লেকপারের আম্রপলি বাগানে প্রবেশ করি। এই আম বাগান মায়াবিনী লেক গার্ডেনের একটি অংশ। আট-দশ একর জায়গা জুড়ে আম বাগান। পেয়ারা গাছের মত মাঝারী আকারের আম গাছ লাইন বিন্যাসে লাগানো। পল্লব ঘন প্রতিটি গাছের শাখায় শাখায় অজস্র আম থোকায় থোকায় ঝুলে আছে। আমে নুয়ে পড়া গাছগুলো এত সুন্দর যে প্রাণ ভরে যায়। আম বাগানের একদম উচ্চ পাহাড়ের শেষ সীমানায় পাহারাদারের টং ঘর। এই টং ঘর একটি চা-দোকানও। নাদুসনুদুস থাই চেহারার একজন সুন্দরী উপজাতি যুবতী চা বিক্রি করেন। তিনি এই আমবাগানের পাহারাদারের বউ। এই দম্পতির দুইজনের জীবন ও জীবিকার উৎস এই আম্রকানন। এখানে পাহাড়ি সুন্দরীর তৈরি চা-পান করে আম বাগানের ভিতর হেঁটে হেঁটে আম্রকাননের রূপ সুধা মেখে মেখে নিচের হাউজি ঘরে এসে যাই। মায়াবিনী লেকে সারাটা বিকেল পার করি। অনেক অনেক ছবি তুলি। শেষ বিকেলের মায়াবী আলোয় আবার সেই নির্জন পাহাড়ি পথে ফিরে এলাম খাগড়াছড়ির হোটেল গাইরিং।
শান্ত পাহাড়ি জনপদ, টিপরা ও চাকমা জনতার মধুমাখা মুখ, নান্দনিক বৌদ্ধমন্দির, পাহাড়ি উপত্যকার ক্ষেত বন, সব চৌম্বকের মত আকর্ষণ করে পর্যটক। চাকমারা বৌদ্ধ হলেও টিপরা উপজাতীয়রা সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাঁদের ভাষার মধ্যেও বেশ ভিন্নতা রয়েছে। তবে তাঁদের উভয় জাতির নৃতাত্বিক বৈশিষ্ট্য ও চেহারায় অদ্ভুদ মিল রয়েছে। তাঁরা দুই জাতই ইন্দোচিনা রূপ, বর্ণ ও চেহারা ধারণ করে আছে।
রাতে গ্রীণলাইনে ঢাকায় ছুটলাম এক সর্টকাট পথে, চট্টগ্রাম স্পর্শ না করেই। দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা পার হয়েই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আসে বাস। এক লেনের সংকীর্ণ ঢাকা-সিলেট রোডে প্রাণটা হাতে নিয়ে চলতে হয়। প্রতিটি ওভারটেকে ভয় হয় বাসে বাসে সংঘর্ষ লেগে এই বুঝি জীবনের ইতি হবে। তাই চোখে ঘুম আসেনা। চারলেনের বিশাল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে সাঁ সাঁ করে বাস ছুটে যাচ্ছে। ওভারটেক নাই, তাই ভয়-শঙ্কাও নেই। শীতল বাসে চাদর মুড়ি দিতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যাই। কুমিল্লার আলেখারচর আসতেই গাড়ি রাস্তাপাশের মহাসড়ক রেস্টহাউস ‘হোটেল হক ইনে’ প্রবেশ করে। আমরা ২০ মিনিটের একটি যাত্রাবিরতি পাই। এখানে সৌভাগ্যক্রমে পূবালী ব্যাংকের চট্টগ্রাম বিভাগের প্রধান মহাব্যবস্থাপক নরেশ চন্দ্র সাহার সাথে দেখা হয়। চট্টগ্রামে তাঁর সাথে আমাদের কোন দেখা সাক্ষাৎ না হলেও অলক্ষ্য হতে তিনি আমাদেরকে নানাভাবে সহায়তা করেন। আমরা কমলাপুরে বাস থেকে নামতেই ভোরের আজান শুনি। যীশুর মেসে একটা গভীর ঘুম দিয়ে হেঁটে হেঁটে এসে অফিস ধরি। অনেক বছর পর চট্টগ্রামের এই সফরে গিয়ে অতীতের স্মৃতিমধু ফিরে পাই এবং সেইসাথে জীবনের প্রথমবার খাগড়াছড়ি ভ্রমণ ছিল সত্যই এক আনন্দময় পাহাড়ি এডভেঞ্চার।