মায়ের মুখে ঈদের চাঁদ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুলাই ২০২২, ৬:৫৪:২১ অপরাহ্ন

মাহবুবা ফারুক
অবারিত স্নেহ, মমতার ভাণ্ডার ‘মা’। আমাদের সবার মায়ের বুকেই এ পৃথিবী, এ ভাণ্ডার। আর কোথাও নয়। আমরা নিজেদের কথা ভাবি ওই ছোট্টবেলা থেকে। মায়ের কথা কতটা ভাবি? মায়ের খাওয়া, ঘুম, বেড়ানো, অবসর, ব্যস্ততা, শখ- এসব না হয় আজ না-ই বলি। আজ শুধু মায়েদের ঈদ নিয়েই বলি। কেমন ছিল আমাদের মায়েদের ঈদ? গরিব, ধনী- সব মায়ের কথা বলি। গৃহবধূ অথবা চাকরিজীবী যিনিই হোন, তিনি মা; অল্প বয়সী বা বেশি বয়সের হোন না তিনি। সুস্থ, অসুস্থ, লেখাপড়া জানুন বা না জানুন- যা-ই হয়ে থাকুন, তিনি মা। কারও সঙ্গেই তার তুলনা চলে না, এমনকি বাবার সঙ্গেও না।
মাকে একটু আলাদা করেই দেখি আজ। একটু পেছন দিকে ফিরে যাই। আমি যখন খুব ছোট, সত্তর-আশির দশকের কথা বলছি- তখন মা নিজের হাতে জামা বানিয়ে পরাতেন। ত্রুশ কাঁটার কাজ, সুতার কাজ, কাপড় কেটে নানা রকম ডিজাইন করে মা জামা বানিয়ে দিতেন। এসব কথা পরিবারের সবার কাছে শুনেছি। বড় হয়ে দেখেছি বন্ধুদের মায়েরাও সেটিই করেন। কারণ তখন জামাকাপড়ের এত মার্কেট ছিল না, প্রচারও ছিল না। আর ফ্যাশন সম্পর্কে আমরা তখনো সচেতন হইনি। মা যে জামা বানিয়ে দিতেন, সেটিই আমাদের কাছে খুব আদরের ছিল।
আমি বড় হয়েছি একটি সমৃদ্ধ গ্রামে। কিছুটা শহরের কাছাকাছি বলা চলে। সবার সঙ্গে সবার খুব সুন্দর সম্পর্ক ছিল। তাই মায়েদের মধ্যেও সেটি দেখেছি। নতুন সেলাই বা রান্না নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে শিখতেন, শেখাতেন। যাদের গল্পের বই পড়ার অভ্যাস ছিল, তারা বই বিনিময় করতেন; মাঝে মধ্যে বেড়াতে যেতেন। কাজেই ঈদের সময় তাদের সন্তানদের জন্য কে কী করবেন, এর একটি পরিকল্পনা থাকত। আমরা ঈদের জামা বা কোনো কিছু ঈদের আগে কাউকে দেখাতাম না। মা সেটি বুঝতেন। দিনের বেলায় নানা কাজে ব্যস্ত থাকতেন। আর যে কোনো সময় কেউ বেড়াতে আসতে পারেন, এ জন্য রাতে আমার মা আমাদের জামা সেলাই করতেন। আমাদের গ্রামে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। হারিকেনের আলোয় মা কখনো সেলাই মেশিনে অথবা সুই-সুতা দিয়ে সেলাই করতেন। আমরা ভাইবোন সবাই ঘুমিয়ে যেতাম। ছোট ভাইবোন জেগে উঠলে মা তাকে শান্ত করে আবার সেলাই করতে বসতেন। কত কষ্ট করেছেন, কখনো একটুও ভেবে দেখিনি। শুধু ঈদের আগেই জামা সেলাই করা চাই- এটিই ছিল একমাত্র চিন্তা। একটুও বিরক্ত না হয়ে, রাগ না করে মা নিজের আনন্দেই তা করেছেন। বাবা হয়তো কখনো রেডিমেড জামা কিনে আনতেন। এর পরও মায়ের অনেক কাজ ছিল- কোন ভাইবোনের কোন রকম জামা চাই। আরও কী আমাদের লাগবে, তা নিজে বুঝে এবং আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করে চুলের ফিতা, ক্লিপ- সবকিছুর একটি লিস্ট করতেন। বাবা সেটি নিয়ে ভুলে না যান, মা মনে করে দিতেন। কিনে আনার পর ঈদের দিনের জন্য গুছিয়ে রাখতেন। এ ছাড়া খাওয়ার কথা বলি। কে কী খাবেন, মেহমানের জন্য কী রান্না হবে, কী বাসনপত্র প্রয়োজন, কখন কীভাবে তা দিতে হবে- সবই মা দেখতেন। আমরা শুধু বন্ধুদের ডেকে নিয়ে আসতাম। আর কিছুই করতাম না। একটু বড় হয়ে দেখেছি বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও আমাদের মায়ের মতোই ওই বাড়ির মাও তা করছেন।
রোজার ঈদ হোক বা কোরবানির ঈদই হোক- মায়ের কোনো অবসর ছিল না। কয়েকদিন আগে থেকেই ঘর বাড়ি পরিষ্কার করা, গোছানো, কাউকে দাওয়াত দেওয়া, বাজার করানো- এসব কাজ নিয়ে মা থাকতেন ভীষণ ব্যস্ত। মোট কথা, নিজের নাওয়া-খাওয়া ভুলে সবার মুখের হাসির জন্য মা তার বিন্দু বিন্দু সময়ও কাজে লাগাতেন। এতেই তার আনন্দ, তৃপ্তি। আহা, মা ছাড়া এমন নিঃস্বার্থ আর কে হন! কখনো জিজ্ঞেস করিনি তার ক্লান্ত লাগছে কিনা, মন ভালো আছে কিনা। তার শাড়ি কেনা হয়েছে কিনা। সেটি পছন্দ হয়েছে কিনা। আর কিছু লাগবে কিনা। অন্য বাসার আন্টিদের শাড়ি বা স্যান্ডেলের মতো তারও কিনতে ইচ্ছা করে কিনা। বাবা কখনো জিজ্ঞেস করেছেন কিনা, তাও জানি না।
ঈদের ভোরে গোসল করে নিজের নতুন জামা-জুতা পরে বেড়াতে বের হতাম বন্ধুদের সঙ্গে। মা চুলে ঝুঁটি করে দিতেন। কিন্তু মাকে বলিনি, তুমিও গোসল করে নতুন শাড়ি পরো মা। শুধু নিজেরটাই ভাবতাম। কখনো কাজের ভিড়ে মা বিকাল পর্যন্ত নতুন শাড়িটি পরতে সময় পাননি। এতে আমি কিছু মনে করতাম না। ভাবতাম- মায়েদের ঈদ এমন হয়, কাজ করাই ঈদ।
বড় হয়ে যখন মায়ের মতো আমার কাঁধেও অনেক দায়িত্ব চেপে বসেছে, তখন দেখি মায়ের মতোই আমার জীবন। এই জীবন নদীর আরেকটা ঢেউ মাত্র। আমি আমার সন্তানের কথা ভাবছি, সংসারের সবার কথা ভাবছি। নিজের জন্য ভাবার সময় কমে গেছে। ততদিনে মাকে বুঝতে শিখেছি। কিন্তু কয়জনের মা তখন এ সুখটুকু পাওয়ার জন্য বেঁচে থাকেন? কয়জনের ভাগ্যে হয় মাকে একটু ভালোবেসে সময় দেওয়া? কারও মা হয়তো অসুখে ভুগতে ভুগতে শুধু সুস্থ থাকাকেই বড় পাওয়া মনে করেন। ঈদের আনন্দ অনেকটাই ফিকে হয়ে আসে। শরীরে শক্তি থাকে না বলে কোথাও যেতে পারেন না। অন্যদিনের মতোই কাটে ঈদের দিনটিও। বয়সের ভারে নতুন শাড়ি বা শখের জিনিস নিয়ে আর ভাবতে পারেন না। সব আনন্দ তো মা সংসারে বিলিয়েই দিয়েছেন। যৌথ পরিবারের মা হলে তো কথাই নেই। কত দিক সামলে যে তার চলতে হয়! নিজের সংসারের দায়িত্ব পালন করে মায়েরা তাদের বাবার বাড়িতেও যেতে পারতেন না সব ঈদে।
পৃথিবী প্রতিদিন বদলায়, বদলে যায় আমাদের জীবন। প্রযুক্তির কারণ, করোনার কারণসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের মানুষের জীবনেও নানা রকম পরিবর্তন এসেছে। এর কতটা ভালো, কতটা মন্দ- সময়ই তা বলবে। আমরা শুধু এর ভেতর দিয়ে যাই। কিন্তু বদলায় না মায়ের ভালোবাসা। মা হলেই মেয়েরা ত্যাগ করা শিখে যান। আমাদের সবার মাকে ভালোবাসার সৌভাগ্য হোক। পৃথিবীর স্বর্গ মা। মায়েদের ঈদ শান্তির হোক, আনন্দের হোক। পৃথিবীর সব (মমতাময়ী) মাকে জানাই সালাম।