মুগ্ধতা ছড়ায় মেঘালয় পাহাড়ের বৈচিত্র্য
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জানুয়ারি ২০২১, ৩:১২:৪১ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের সুন্দর গ্রাম পানতুমাই
আহমাদ সেলিম:
ভারতে না গিয়েও সিলেটের একটি গ্রাম থেকে মেঘালয় পাহাড়ের বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য্য খুব কাছ থেকে দেখা যায়। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় ভারতের গহীন অরণ্য থেকে বেরিয়ে আসা মায়াবি ঝর্ণা। প্রাণভরে দেখা যায় পাহাড়ী জনপদ, ভারতের বাড়িঘর। সেই গ্রামের নাম পানতুমাই। পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের ছোট এই গ্রামকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম বলা হয়।
সিলেট থেকে ৬৪ কিলোমিটার দূরে পানতুমাই গ্রাম। গ্রামে প্রবেশ করেই বাংলাদেশের সুন্দর গ্রামের উপমা খুঁজে না পেয়ে যেকোনো পর্যটক হোঁচট খেতে পারেন। গ্রামের প্রথম দৃশ্যগুলো কাউকে গভীরভাবে আকৃষ্ট না ও করতে পারে। অবশ্য তাতে হতাশ হবার কোনো কারণ নেই। পাঁচ থেকে সাত মিনিট পর হেঁটে যেতে যেতে যখন মেঘালয় পাহাড়ের দেখা মিলবে; তখন দূর হয়ে যেতে পারে সব ক্লান্তি, মিলে যাবে মনের হিসেব নিকেষ। অর্থাৎ, ছোট গ্রামটির শেষ অংশে ভারতের মেঘালয়। যার নয়নাভিরাম পরিবেশ পরম এক মায়ায় আচ্ছন্ন করবে যে কাউকে, বিশেষ করে প্রকৃতিপ্রেমিদের। আর মেঘালয়ের সেই রূপবৈচিত্র্যই ঐশ্বর্য দিয়েছে পানতুমাই গ্রামকে।
বলা যায়, শিল্পীর রং তুলিতে আঁকা চমৎকার একটি গ্রাম। কোথাও কোনো শব্দ নেই। ছিমছাম আকাবাঁকা পথ। চারপাশে পত্র পল্লবে ঘেরা সবুজ এক সাম্রাজ্য। বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে হয়তো বাংলাদেশের অনিন্দ্য সুন্দর বলা হয়েছে পানতুমাইকে। তার মধ্যে প্রথম হচ্ছে অপরূপ ঝর্ণাধারা। ভারতের গহীন অরণ্য থেকে এ ঝর্ণাধারা নেমে এসেছে। ঝর্ণাটির স্থানীয় নাম মায়ামতি। কেউ ফাটাছড়ি, কেউ আবার বড়হিল ঝর্ণা বলে ডাকেন। পানতুমাই থেকে কান পাতলে সেই ঝর্ণার জলধারার শব্দ ভেসে আসে। তারপর যার শব্দ দেখা না গেলেও অনুভব করা যায়, সেটি হচ্ছে হিমশীতল হাওয়া। ঝর্ণার চারপাশে সারি সারি সবুজ বৃক্ষ, যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। সেই বৃক্ষগুলো দুই দেশের সীমানা ভাগ করে দিয়েছে। তবে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে না পারলেও মনকে একটু বাড়ালে ঠিকই সব স্পর্শ করা যায়।
গ্রামের তরুণ সমাজসেবক আমির উদ্দিন জানান, ‘গ্রামের মানুষ খুবই আন্তরিক, অতিথিপরায়ণ। কেউ বেড়াতে আসলে সবাই সহযোগিতা করেন। এটাই মনে হয় পানতুমাই গ্রামের বৈশিষ্ট্য। আমরা সেটি ধরে রাখতে চাই। তারা আরো বলেন, ঝর্ণাটি প্রতিবেশী দেশ ভারতের মধ্যে পড়লেও পিয়াইন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে খুব কাছ থেকে উপভোগ করা যায় তার অপূর্ব ধারা। তবে বর্ষার সময় সেই ঝর্ণা তার পরিপূর্ণ লাবণ্য মেলে ধরে।’ ঝর্ণার পাশে রয়েছে একটি ব্রীজ। কাছ থেকে দেখা যায় মানুষের জীবনযাত্রা। আছে বিজিবি’র পাহারা। তাই সীমানার কাছাকাছি যাওয়া বিপজ্জনক। তবে নিরাপদ দূরত্ব রেখে এর অপরূপ সৌন্দর্য্য অবলোকন করা শ্রেয়।
একটি প্রাইমারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, একটি মাদরাসা এবং পাচটি মসজিদ-এই হচ্ছে পানতুমাই গ্রাম। আহারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি আব্দুল করিম জানান, ‘গ্রামটি ছোট হলেও দেশ-বিদেশের অনেক বড় বড় মানুষ গ্রামটি দেখতে আসেন।’
পানতুমাই গ্রামের ভেতর বড় দু’টি দৃষ্টিনন্দন খেলার মাঠ রয়েছে। প্রথমটি ঘেঁষেই রয়েছে পিয়াইন নদী। স্থানীয়ভাবে এ মাঠকে ‘বড়হিল’ মাঠ বলা হয়। অপরটি কয়েক গজ অদূরে। অনেকের কাছে সেটি ‘চিলির মাঠ’ নামে পরিচিত। তবে প্রথম মাঠের মাহাত্ম অনেক। বছরে বছরে এ মাঠে ফুটবলের বড় আসর বসে। নাইজেরিয়া, আফ্রিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়রা এ মাঠে খেলতে আসেন। অপর মাঠের পাশে রয়েছে বিজিবি ক্যাম্প। গোয়াইনঘাট বিশ্ববিদ্যালয় এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী হুমায়ুন কবীর আলমগীর বলেন, আমাদের খেলার মাঠের সুনাম আছে। সিলেট বিভাগের অধিকাংশ খেলোয়াড় এ মাঠে এসেছেন। বিদেশী খেলোয়াড়রাও বড় আসরে নিয়মিত আসে।’ মেঘালয় পাহাড়ের কাছাকাছি হওয়ায় বড় ম্যাচগুলো দূর থেকে উপভোগ করেন ভারতের ফুটবলপ্রেমি অনেকে।
পানতুমাই গ্রামে পান চাষের সুনাম রয়েছে। দশ থেকে বারোটি পরিবার বাণিজ্যিকভাবে পান চাষ করে থাকেন। কথা হয় খলিল আহমদ নামে এক চাষীর সাথে। প্রায় আটশ’ পান গাছ রয়েছে তার। কথা হলে তিনি জানান, ‘বছরে প্রায় দুই লক্ষ টাকা লাভ আসে।’
গ্রামের আরেক যুবক মখছুছ আহমদ। তিনি জানান, ‘পঞ্চাশ থেকে ষাটটি পরিবার বসবাস করছেন গ্রামে। এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষের পূর্বপুরুষের বসবাস সিলেটের বিয়ানীবাজার এবং গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। প্রায় শতাধিক বছর আগে বাণিজ্যিক কারণে তারা সেখানে বসতি স্থাপন করেন।’