রবীন্দ্রনাথের কাদম্বরী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুন ২০২২, ৫:১৯:৫১ অপরাহ্ন

অমিত রহমান
বংশতালিকা ঘাঁটলে দেখা যায়, কাদম্বরী দেবীর পূর্বপুরুষদের সঙ্গে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের যোগাযোগ বেশ পুরনো। গোবিন্দরাম ঠাকুর ছিলেন কুশারী বংশের জয়রাম ঠাকুরের কনিষ্ঠ সন্তান। গোবিন্দরাম আবার দ্বারকানাথ ঠাকুরের পিতামহ নীলমণির ভ্রাতা। গোবিন্দের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল খুলনার দক্ষিণডিহী গ্রামের নন্দরাম গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে রামপ্রিয়া দেবীর। গোবিন্দ মারা গেলে আদালতে গিয়ে রামপ্রিয়া স্বামীর সম্পত্তি বুঝে নেন। ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে রামপ্রিয়ারও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। যা হোক, এরপর তিনি ভ্রাতুষ্পুত্র জগন্মোহন গাঙ্গলিকে প্রতিপালন শুরু করেন। কলকাতার হারকাটা গলিতে তাকে একটা বাড়িও করে দেন। এ রামপ্রিয়া উদ্যোগ নিয়ে জগন্মোহনকে বিয়ে দেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের মামা কেনারাম রায়চৌধুরীর মেয়ে শিরোমনির সঙ্গে। সংগীতের ভক্ত, সমঝদার হিসেবে জগন্মোহনের খ্যাতি হয়েছিল। তার দ্বিতীয় ছেলের নাম রসিকলাল। এ রসিকলালের দুই মেয়ের বিয়ে হয় দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভাগ্নে ও দাদার পৌত্রের সঙ্গে। জগন্মোহনের চতুর্থ সন্তান শ্যামলাল বিয়ে করেন ঠনঠনের শশিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে ত্রৈলোক্য সুন্দরীকে। শ্যামলাল-ত্রৈলোক্য সুন্দরীর ঘরে এসেছিল চার কন্যা। এদের মধ্যে তৃতীয়জন ছিলেন কাদম্বরী দেবী-জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী, রবীন্দ্রনাথের বৌঠান।
কাদম্বরীর পিতা শ্যামলাল কলকাতা মহানগরেই বাস করতেন। তার কন্যা কাদম্বরীর জন্ম সিপাহি বিদ্রোহের দুই বছর পর, ১৮৫৯ সালের ৪ জুলাই; ১২৬৬ বঙ্গাব্দের ২১ আষাঢ়। তার বড় দুই বোন বরদা ও মনোরমা, আর ছোট বোন শ্বেতাম্বরী। এখানে উল্লেখ্য, পিতার গৃহে তার নাম ছিল কাদম্বিনী। বিয়ের পরে ঠাকুরবাড়িতে এসে হন কাদম্বরী।
দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদম্বরীর বিয়ে হয়েছিল ১৮৬৮ সালের ৫ জুলাই। নয় বছরের কাদম্বরীর বিয়ে হলো ১৯ বছরের জ্যোতির সঙ্গে। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সাত বছর।
গৌরবর্ণের অধিকারী না হলেও কাদম্বরী রূপবতী ছিলেন। শ্যামবর্ণা কাদম্বরীর চোখ আর চুলের সৌন্দর্যের খ্যাতি ছিল। ইন্দিরা দেবী তার কাকিমাকে নিয়ে বলেছেন, “তার বড় বড় চোখ আর দীর্ঘ ঘন কেশ ছিল…।” আর রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘নতুন বৌঠানের চোখ দুটো এমনভাবে তার মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে গেছে যে মানুষের ছবি আঁকতে বসলে অনেক সময়েই ঐ চোখ দুটো তার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে।’
গাছপালা-পাখির প্রতি টান ছিল কাদম্বরীর। সারদা দেবীর মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর বাড়ি ছেড়ে দিলেন। তিনতলায় ছাদের ঘর এবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথের হলো। কাদম্বরী ছাদে বাগান গড়ে তুললেন। তার হাতে বাগানে শোভিত হলো চামেলি, গন্ধরাজ, করবী, রজনীগন্ধা, দোলনচাঁপা। আর দেখা গেল সারি সারি জাম গাছের টব। পশ্চিমের বারান্দায় জায়গা হলো নানা দেশের পাখির। এর মধ্যে একটি চৈনিক শ্যামাও ছিল।
লক্ষণ থেকে বোঝা যাচ্ছে, কাদম্বরী দেবীর মধ্যে সৌন্দর্যবোধের, শৌখিনতার ভাব ছিল। তার স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনীপ্রণেতা মন্মথনাথ ঘোষ লিখেছেন, গৃহসজ্জার প্রতি কাদম্বরী দেবীর প্রখর দৃষ্টি থাকত, নিখুঁতভাবে তিনি সাজাতেন সবকিছু, বাগান আর নানা রকম গাছের ছিল শখ।
আবদুশ শাকুর তার রবীন্দ্রজীবনে উল্লেখ করেছেন, কাদম্বরীর অক্ষরজ্ঞান ছিল কিনা তা বলা কঠিন। কারণ বিয়ের পর তার জন্য ধারাপাত এবং ‘প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ দুইখানা পুস্তক’ কেনা হয়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষার বড় সুযোগ না পেলেও তিনি ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। রবীন্দ্রনাথের কথায়, “সাহিত্যে বউঠাকুরানীর প্রবল অনুরাগ ছিল। বাংলা বই তিনি যে পড়িতেন কেবল সময় কাটাইবার জন্য, তাহা নহে-তাহা যথার্থই তিনি সমস্ত মন দিয়া উপভোগ করিতেন। তাঁহার সাহিত্যচর্চায় আমি অংশী ছিলাম।”
সন্ধ্যার সময় এই ছাদের বাগানে বসত সাহিত্য আর সংগীতের আসর। জ্যোতির সহপাঠী অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী এ ছাদবাগানের নাম দিলেন ‘নন্দনকানন’। আসরের মধ্যমণি ছিলেন আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত কাদম্বরী। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী আসতেন কবিতা পড়তে। কাদম্বরী তার গুণমুগ্ধ ছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যায়, কবির ‘সারদামঙ্গল’ পড়ে তার ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন কাদম্বরী। প্রিয় কবিকে তিনি স্বহস্তে বুনে একটি আসন উপহার দেন। এ আসনের নাম ছিল ‘সাধের আসন’। ‘সাধের আসন’-এ সুতার অক্ষর বুনে ‘সারদামঙ্গল’ থেকে কয়েকটি লাইন তুলে দিয়েছিলেন কাদম্বরী। অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে আসতেন তার স্ত্রী লেখিকা শরত্কুমারী। অতিথিদের নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতেন কাদম্বরী। সবাই তার রান্নারও ভক্ত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও কাদম্বরীর রান্নার প্রশংসা করেছেন, ‘বৌঠাকরুন রাঁধতে পারতেন ভালো, খাওয়াতে ভালোবাসতেন।’
জ্যোতির উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছিল মাসিক পত্রিকা ‘ভারতী’। এতে অংশগ্রহণ ছিল কাদম্বরীর। সুব্রত রুদ্রের বইতে পাওয়া যায়-“ভারতীর প্রাণ ছিলেন কাদম্বরী, তাকে পত্রিকাগোষ্ঠীর মধ্যমণি বলা যেতে পারে। স্বর্ণকুমারী দেবী বলেছিলেন, ‘প্রায় সমবয়সী বলে তাদের বন্ধুতা গাঢ় ছিল। কাদম্বরী সব সময়ে সাহিত্য আলোচনায় আনন্দ পেতেন।’ সন্ধে হলে প্রতিদিন বাড়িতে বসতে শুরু করল সাহিত্যের আসর, আলোচনা, কবিতাপাঠ, গান।”
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সমাজ সংস্কারকে থোড়াই কেয়ার করে স্ত্রীকে অন্তঃপুর থেকে বাইরে আনলেন। কাদম্বরীকে ঘোড়ায় চড়া শেখালেন। তারপর দুজন ঘোড়ায় চেপে যেতেন গড়ের মাঠে। সেখানে স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি ঘোড়া ছোটাতেন। এ ঘটনা স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক ঔত্সুক্যের জন্ম দিয়েছিল।
স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সেবাযত্নে ত্রুটি রাখতেন না কাদম্বরী। জ্যোতি যখন জমিদারি তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্ব পান, তখন দুপুরে তাকে কাছারিতে যেতে হতো। সে সময় কাদম্বরী স্বামীর জন্য ফল কেটে যত্ন করে রূপার রেকাবিতে সাজিয়ে পাঠাতেন। সঙ্গে দিতেন নিজের হাতে তৈরি করা মিষ্টান্ন, এর উপরে ছড়িয়ে দিতেন গোলাপের পাপড়ি। আরো দিতেন গ্লাসভরা ডাবের পানি বা ফলের রস, কখনো বরফে ঠাণ্ডা করা কচি তালশাঁস। বিভিন্ন ধরনের নতুন পদ রান্না করার শখ ছিল কাদম্বরীর।
ঠাকুরবাড়ির এত হাসি-গানের ঝরনাতে শেষমেশ ট্র্যাজেডি হয়ে মিশে গিয়েছে কাদম্বরীর জীবন। ২৫ বছরে আত্মহত্যাতে ফুরিয়েছে তার জীবন। এর আগেও নানা ঘটনায় বেদনার্ত হয়েছেন। তার মধ্যে একটি ঘটনার উল্লেখ করে এ লেখার ইতি টানা হবে। নিঃসন্তান কাদম্বরী, স্বর্ণকুমারীর ছোট মেয়ে ঊর্মিলাকে সন্তানজ্ঞানে পালন করতেন। মেয়েকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো তিনিই করতেন। ঊর্মিলাকে তেতলায় নিজের কাছে রাখতেন। স্কুলে ভর্তির দুই মাসের মাথায় ছাদের বাঁকা সিঁড়ি দিয়ে একা নামতে গিয়ে মারা যায় কন্যাটি। এ ঘটনা কাদম্বরীর বুকে শোকের পাথর চেপে দিয়েছিল।