রাজনৈতিক দলের ধর্মীয় প্রভাব
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ৬:২৪:২৬ অপরাহ্ন

মোহাম্মদ আব্দুল হক
মোগল সাম্রাজ্যে জনগণের অংশগ্রহণে শাসন চলতো না। তখন জনগণের রাজনীতি ছিলো না। জনগণের নির্বাচিত শাসক ছিলো না। বাদশাহ, সম্রাট, নবাবদের ইচ্ছার প্রাধান্য চলতো সাধারণ জনগণের উপর। এরপরও বিভিন্ন বিদেশি হস্তক্ষেপ চলে। চলে দখল ও বিতাড়ন। শেষে ইংরেজদের শাসনামলে আমরা ভারত উপমহাদেশের মানুষ শাসিত হই শোষিত হই।
যখন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন আর ঠেকানো গেল না, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের পতনের পরে ধীরে ধীরে তখন আমাদের পরিচয় আমরা ব্রিটিশ-ভারতীয়। ব্রিটিশরা শাসন করেছে, নির্যাতন করেছে ও সম্পত্তি লুটে নিয়েছে ও ভালোমন্দ শিখিয়েছে এবং আমরা তাদের নিকট থেকে শিখেছি। যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ডের দখলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিলো পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো সাম্রাজ্য। আমার আলোচনার বিষয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গুরুত্ব নিয়ে নয়। আমি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করছি ভারত উপমহাদেশের মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতার প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্রিটিশ-ভারত উপমহাদেশে প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। ১৮৮৫ খ্রীষ্ট্রিয় সালের ২৮ ডিসেম্বর বম্বে অর্থাৎ বর্তমান মুম্বাইয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। দলটির প্রথম সভাপতি হয়েছিলেন উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি। প্রতিষ্ঠাকালীন এই রাজনৈতিক দল ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে গড়ে উঠলেও মুসলমানদের উপস্থিতি ছিলো স্বল্প সংখ্যক। তবে এ কথা সত্য ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কংগ্রেস অনন্য ভূমিকায় ছিলো।
সময় গড়িয়ে যায়। ব্রিটিশ-ভারতের মানুষ রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠে। তৎকালীন বঙ্গ অঞ্চল ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। বঙ্গভঙ্গ, বঙ্গভঙ্গ ঠেকানো ইত্যাদি আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদেরকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক মঞ্চে খুঁজতে থাকে। মুসলমানরা নানান কারণে কংগ্রেসের প্রথম সারির হিন্দু নেতৃবৃন্দের কৌশলে পিছিয়ে পড়ে। বিশাল ভারতের শিক্ষায় ও রাজনীতিতে এগিয়ে থাকা তখনকার স্বল্প সংখ্যক মুসলমান অবহেলাটা বুঝতে পারেন।
তৎকালীন পাঞ্জাবে ১৯০৬ খ্রিস্টিয় সালের ফেব্রুয়ারিতে মুসলিম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক সংস্থা গড়ে উঠে। ভারতজুড়ে মুসলিম বিদ্বেষের ঝড় উঠে। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বিচলিত হন। তিনি সর্বভারতীয় মুসলিম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি ভারতের সর্বত্র থাকা বিশিষ্ট মুসলিম নেতৃবৃন্দের নিকট পত্রালাপে তাঁর ইচ্ছার কথা জানালেন এবং ২৮-৩০ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় শিক্ষা সম্মেলনে প্রায় আট হাজার প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন। ওই সম্মেলনে স্যার সলিমুল্লাহ ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফেডারেন্সী’ অর্থাৎ সর্বভারতীয় মুসলিম সংঘ গড়ার প্রস্তাব দেন। নামের বিষয়ে কিছু প্রতিনিধির আপত্তি উঠলে কনফেডারেন্সী শব্দ বাদ দিয়ে লীগ সংযুক্ত করা হয়। এভাবেই ওই সম্মেলনে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ যা নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠিত হয় স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে। সেদিনের ঢাকার শাহবাগের সম্মেলনে বঙ্গভঙ্গ সমর্থন এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নিন্দা করা হয়। তৎকালীন নেতৃবৃন্দের মধ্যে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিমুদ্দিন, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগণ ছিলেন। আমরা পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাই মুসলিম লীগের রাজনীতিতে।
এখন কথা হলো, ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ-ভারতের সময় থেকে প্রথমে ‘ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’ এবং পরে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ গঠনের মাধ্যমে একই সাথে রাজনীতি ও ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতির শুরু। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ এই দুটি দল ভারত উপমহাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। অতীতে অনেক বিপ্লব, অনেক সংগ্রামী জীবনের ত্যাগ হয়েছে ভারতের স্বাধীনতার জন্যে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসকের সাথে সংলাপ ও সমঝোতা করে কংগ্রেস ও লীগ নেতৃবৃন্দের দ্বারা ভারত ভাগের মাধ্যমেই ব্রিটিশরা নিজেরা চলে যায়। সে আরেক অধ্যায়। এখানে ভারতের রাজনৈতিক দলের প্রসঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এখনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে। কিন্তু ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ ভাঙতে ভাঙতে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কোথাও আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু; এমন একটা ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দলের এমন শোচনীয় পরিণতি হলো কেন? আমি মনে করি, ওই সময় ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বের মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণের বিপরীতে ‘মুসলিম’ শব্দযোগে রাজনৈতিক দল গঠন না- করে অন্য কোনো নাম দিয়ে সকল ধর্মের আরো আরো প্রগতিশীল চিন্তার মানুষের অংশগ্রহণের সুবিধা রেখে কংগ্রেসের ওই সময়ের ভুল রাজনীতির জবাব দিলে ভালো হতো। কারণ, আমাদের সেকালে এবং একালে এ অঞ্চলের কোনো দেশই শুধু মুসলমানদের দেশ নয়। এখানে সকল দেশেই অন্য ধর্মের মানুষের বসবাসের শতভাগ অধিকার আছে এবং এ কারণে অন্য ধর্মের মানুষের মনে মুসলিম বা ইসলাম নাম যুক্ত রাজনৈতিক দলের বিষয়ে অন্তর্গত দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এমনকি আমাদের পররাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়তে হলেও বিষয়টির অন্তর্গত প্রভাব পড়ে।
সকল ধর্মের মানুষের বসবাসের ও রাজনীতি করার অধিকার আছে যে দেশের সংবিধানে, সেখানে আমি একজন মুসলিম হিসেবে বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক দলের নামের সাথে ‘ইসলাম’ অথবা ‘মুসলিম’ শব্দ যোগ না করেও শান্তির পথে অধিক জনতার সমর্থন নিয়ে মুসলিম নেতৃবৃন্দের শাসনে ইসলামী বিষয়ের প্রাধান্য তুলে ধরা যায়। দেখুন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এই দুটি বৃহৎ দলের নামের সাথে ‘ইসলাম’ বা ‘মুসলিম’ শব্দ যুক্ত নাই। তারপরও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ২০২২ খ্রীস্টিয় সালে এসেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ না দিয়েই রাজনীতি করে যাচ্ছে। আমাদের এ অঞ্চলে এসব হচ্ছে ব্যাপক মানুষের মেজাজ বুঝে ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল। এই দুটি দল দিনে দিনে আরও জনসম্পৃক্ত এবং জনতার আশার জায়গা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাথে যেমন মুসলমান ও হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মের সম্পৃক্ততা আছে, তেমনি বিএনপির সাথে সকল ধর্মের মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও যোগাযোগ চলে। এখানে মানুষ আমেরিকা, রাশিয়া, বৃটেন, চীন, জাপান, ভারত ও ইউরোপের দিকে ঝুঁকে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে; ওইসব দেশের ডলার, পাউন্ড, ইউরোপ এবং তাদের চিকিৎসা, শিক্ষা, বিনোদন, ঝলমলে জীবন এবং খাদ্য ও বিলাসী পণ্যের জন্যে।
আমার লেখার সাথে কেউ ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ খুঁজবেন না। আমি বিশ্বাস করি, কোথাও প্রকৃত অর্থে ইসলামী শাসন সকল ধর্মের মানুষের বসবাসের জন্যে শান্তির। আমাদের সামনে আছে ঐতিহাসিক মদিনা রাষ্ট্র এবং মক্কা বিজয়। এ অঞ্চলে তেমনি করে উগ্রতামুক্ত রাজনীতি কোথায়? আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই ব্রিটিশ-ভারতের অর্থাৎ তৎকালীন সর্বভারতের উদর থেকে সময়ের প্রয়োজনে বের হওয়া গুরুত্বপূর্ণ তিনটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরাসরি ধর্মের নাম নিয়ে গড়া প্রতিটি রাজনৈতিক দলের চিত্র এমনটি-ই ভাবায়।
লেখক : কলামিস্ট ও সাহিত্যিক।