রাজা ও জাদুকর
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ ডিসেম্বর ২০২১, ৫:২১:৪৬ অপরাহ্ন

রানা কুমার সিংহ
বহুদিন আগে একটি সুন্দর রাজ্যে ছিলেন এক রাজা। রাজার তিনটি ছোট ছেলে ছিল যাদেরকে কোনো শিক্ষকই কিছু শেখাতে পারত না। বিষয়টি রাজা এবং তার রানীকে চিন্তায় রাখত।
একদিন একজন জাদুকর রাজার কাছে এসে বলল- আমি যদি আপনার তিন ছেলেকে লেখাপড়া শিখাই এবং তাদেরকে বড় পণ্ডিত বানাই, তাহলে আপনি আমাকে কী দেবেন?
এই কথা শুনে রাজা বললেন- আমি তোমাকে আমার সম্পত্তির অর্ধেক দেবো।
জাদুকর বলল- আমি এই উপহার চাই না।
তাহলে আমার অর্ধেক শহর আমি তোমাকে দিয়ে দেবো- রাজা বলে উঠলেন।
জবাবে জাদুকর বলল- না, আমি এতেও সন্তুষ্ট নই।
তাহলে তুমি কি চাও- রাজার পাল্টা প্রশ্ন।
জাদুকর বলল- যখন আমি তাদের পণ্ডিত বানিয়ে আপনার কাছে নিয়ে আসব তখন তাদের মধ্যে দুজনকে আপনার জন্য বেছে নেবেন এবং তৃতীয়জন আমাকে দেবেন; কারণ আমি নিঃসন্তান। আমার একটি সন্তান চাই।
রাজা রাজি হলেন।
কথামত জাদুকর রাজপুত্রদের নিয়ে গেল এবং স্বল্প সময়ে তাদের পড়তে, চিঠি তৈরি করতে শিখাল। নানাবিষয়ে তাদের বেশ ভাল পণ্ডিত বানিয়ে তুলল। তারপর সে তাদেরকে রাজার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে বলল- এখানে আপনার বাচ্চারা আছে। তারা সবাই সমানভাবে ভালো পণ্ডিত। এবার আপনি আপনার শর্ত পূরণ করুন।
রাজা তার পছন্দের দুজনকে নিয়ে গেলেন এবং জাদুকর তৃতীয়জনকে নিয়ে গেল, যার নাম ছিল কিজান্না।
জাদুকরের বাড়িটি ছিল খুব বড়। বাড়িতে এসে জাদুকর কিজান্নার হাতে চাবি দিয়ে বলল- যা খুশি খুলে দেখতে পারো। আজ থেকে আমি তোমার বাবা। আমি এক মাসের জন্য বাইরে চলে যাচ্ছি। বাড়িতে তুমি তোমার মতো করে থাকো।
জাদুকর চলে গেলে কিজান্না চাবি নিয়ে বাড়িটি দেখতে শুরু করল। সে একটি দরজা খুলে দেখল, তরল সোনায় ভরা একটি ঘর। সে তার আঙুল দিয়ে তরল সোনা স্পর্শ করতেই সোনা আঙুলে আটকে গেল। সেই তরল সোনা মুছতে পারল না সে। আঙুলে এক টুকরো কাপড় জড়িয়ে রাখল কিজান্না। জাদুকর ফিরে আসার পর জিজ্ঞাসা করলে যে তার আঙুলে কী হয়েছে। কিজান্না তাকে সত্য বলতে ভয় পেল। তাই সে বলল যে সে আঙুল কেটে ফেলেছে।
কদিন পর জাদুকর আবার চলে গেলে কিজান্না বাড়িটিতে অনুসন্ধান চালাতে লাগল। সে সোনার ঘরটির পর যে ঘরটি খুলল তা ছিল ছাগলের হাড় দিয়ে, পরেরটি ভেড়ার হাড় দিয়ে, পরেরটি গরুর হাড় দিয়ে, চতুর্থটি গাধার হাড় দিয়ে, পঞ্চমটি ঘোড়ার হাড় দিয়ে এবং ষষ্ঠটি ছিল পুরুষের মাথার খুলি দিয়ে পূর্ণ। সপ্তম ঘরটিতে ছিল একটি জীবন্ত ঘোড়া।
ঘোড়াটি কিজান্নাকে বলল- তুমি কোথা থেকে এসেছ?
এটা আমার বাবার বাড়ি- কিজান্না বলল।
ওহ, সত্যিই! আচ্ছা, তুমি একজন সুন্দর পিতা পেয়েছ। তুমি কি জানো যে তিনি মানুষ, গাধা, ঘোড়া, গরু, ছাগল এবং সবকিছু যাতে সে হাত দিতে পারে তা কঠিন বস্তুতে পরিণত হয়ে যায়! আর তিনি একজন নরখাদকও। তুমি আর আমিই একমাত্র জীবিত এখানে।- ঘোড়াটি কিজান্নার দিকে তাকিয়ে বলল।
এই কথা শুনে কিজান্না খুব ভয় পেল। মানসিকভাবে সে ভেঙে পড়ল। সে ঘোড়াকে জিজ্ঞেস করল- এখন আমরা কী করতে পারি?
ঘোড়াটি বলল- তুমি আমাকে রশি খুলে মুক্ত কর। কিজান্না ঘোড়াটিকে মুক্ত করল।
মুক্ত ঘোড়া বলতে লাগল- এখন, সোনা দিয়ে ভর্তি রুমের দরজা খুলে দাও। আমি সব সোনা গিলে ফেলব আর একটু দূরে পথের পাশে বড় গাছটির নিচে তোমার জন্য অপেক্ষা করব। যখন জাদুকর বাড়িতে আসবে, সে তোমাকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের জন্য বলবে। তখন তুমি তাকে বলবে এই কাজ তুমি জানো না। তোমার কথা শুনে সে নিজেই কাঠ আনতে যাবে। যখন সে ফিরে আসবে, হুকের উপর একটি বড় বড় পাত্র রাখবে এবং তোমাকে তার নীচে আগুন তৈরি করতে বলবে। তাকে বলবে, কীভাবে আগুন তৈরি করতে হয় তাও তুমি জানো না। পরে সে নিজেই আগুন জ্বালাবে। তারপর সে প্রচুর পরিমাণে মাখন নিয়ে আসবে এবং যখন এটি গরম হবে তখন সে পাশে টাঙানো একটি দোলনা দেখিয়ে তোমাকে দোল খাওয়ানোর কথা বলবে। তুমি বলবে জাদুকর যাতে আগে দোলনায় উঠে দেখায় কীভাবে দোল খেতে হয়। সে যখন তোমাকে এটি দেখাতে উঠবে তখনই তাকে বড় পাত্রের মধ্যে ঠেলে দিতে হবে এবং তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার কাছে ফিরে আসবে।
ঘোড়াটি পথের পাশে বড় গাছটির কাছে চলে গেল।
ওইদিন সন্ধ্যায় জাদুকর তার বাড়িতে একটি নৈশভোজের আয়োজন করল। সে কিজান্নাকে বলল- ‘আসো আমরা কাঠের জন্য যাই।’ কিজান্না জবাবে বলল- ‘আমি কাজটি পারি না।’ এ কথা শুনে জাদুকর নিজে গিয়ে কাঠ নিয়ে এলো।
তারপর সে বড় পাত্র টাঙিয়ে বলল- ‘আগুন জ্বালাও।’
এবারও কিজান্না বলল- ‘আমি জানি না কীভাবে এটি করতে হয়।’ জাদুকর পাত্রের নীচে কাঠ রেখে আগুন জ্বালাল।
এরপর জাদুকর পাত্রে মাখন রেখে কিজান্নাকে এই অবসরে দোলনায় দোল খেতে বলল। সে দোলনা বেঁধে কিজান্নাকে বলল- ‘এখানে উঠে খেলা শিখো।’ কিন্তু কিজান্না বলল- তুমি আগে উঠে আমাকে দেখিয়ে দাও। আমি দ্রুত শিখে নেব।
জাদুকর দোলনাতে বসতেই কিজান্না তাকে বড় পাত্রের মধ্যে ধাক্কা দিলো এবং ফুটন্ত মাখনে জাদুকর সেদ্ধ হয়ে যেতে শুরু করল।
কিজান্না যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ে বড় গাছের কাছে গেল, যেখানে ঘোড়াটি তার জন্য অপেক্ষা করছিল। ঘোড়া কিজান্নাকে নিয়ে দৌড় শুরু করল।
সন্ধ্যায় জাদুকরের অতিথিরা এসে তাকে খুঁজে পেল না।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তারা খুব ক্ষুধার্ত হতে শুরু করল। খাবারের খোঁজে চারপাশে তাকাতেই তারা দেখতে পেল যে, বড় পাত্রের মধ্যে কিছু রান্না করা হয়েছে। তারা সেটাই খাওয়া শুরু করল এবং পাত্রের পুরো খাবারই খেয়ে ফেলল। সমস্ত খাবার খাওয়ার পর তারা তাদের বাড়িতে ফিরে গেল।
এদিকে দৌড়াতে দৌড়াতে কিজান্না এবং ঘোড়াটি একটি বড় শহরের কাছে এসে থামল। ঘোড়াটি তার গিলে ফেলা সমস্ত সোনা মুখ দিয়ে বের করল। যা দিয়ে তারা ক্রীতদাস, গবাদি পশু এবং তাদের প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে নিলো।
অতঃপর তারা সুন্দর নতুন বাড়ি, সমস্ত দাস-দাসি, গবাদি পশু এবং ধনসম্পদ নিয়ে সুখে বাস করতে লাগল। কিজান্না ঘোড়াটিকে নিজের চাইতেও বেশি ভালবাসত।