শরৎচন্দ্র ও বাংলা উপন্যাস
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৫:৩৫:৫৮ অপরাহ্ন

সৈয়দা মানছুরা হাছান মিরা
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় এবং বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। তাঁর অনেক উপন্যাস ভারতবর্ষের প্রধান ভাষাগুলোতে অনূদিত হয়েছে।
অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের প্রেসিডেন্সি বিভাগের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতা ভুবনমোহিনী দেবী। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে শরৎচন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। শরৎচন্দ্রের ডাক নাম ছিল ন্যাঁড়া। দারিদ্র্যের কারণে মতিলাল স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন বলে শরৎচন্দ্রের শৈশবের অধিকাংশ সময় এই শহরেই কেটেছিল। শরৎচন্দ্রের বয়স যখন পাঁচ বছর তখন মতিলাল তাকে দেবানন্দপুরের প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন, যেখানে তিনি দু-তিন বছর লেখাপড়া করেন। এরপর ভাগলপুর থাকাকালীন তার মামা তাকে স্থানীয় দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তিতে ভর্তি করিয়ে দেন।
১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র ভাগলপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মতিলালের চাকরি চলে গেলে তিনি তার পরিবার নিয়ে দেবানন্দপুরে ফিরে গেলে শরৎচন্দ্র জেলা স্কুল ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই সময় তিনি হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে দারিদ্র্যের কারণে স্কুলের ফি দিতে না পারায় তাকে এই বিদ্যালয়ও ত্যাগ করতে হয়। এই সময় তিনি ‘কাশীনাথ’ ও ‘ব্রহ্মদৈত্য’ নামে দু’টি গল্প লিখেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে মতিলাল পুনরায় ভাগলপুরে ফিরে গেলে প্রতিবেশী সাহিত্যিক তথা তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায় লেখাপড়ার প্রতি শরৎচন্দ্রের আগ্রহ দেখে তাকে তার বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। এই বিদ্যালয় থেকে ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিভাগে এনট্রান্স পরীক্ষা পাস করে তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হন। এই সময় তিনি তার মাতামহের ছোটো ভাই অঘোরনাথের দুই পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে প্রতি রাতে পড়াতেন, তার বিনিময়ে অঘোরনাথ শরৎচন্দ্রের কলেজে পড়ার প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাতেন। এতৎসত্ত্বেও এফ.এ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পারায় তিনি পরীক্ষায় বসতে পারেননি।
কলেজ ত্যাগ করার পর শরৎচন্দ্র ভাগলপুর শহরের আদমপুর ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে খেলাধুলা ও অভিনয় করে সময় কাটাতে শুরু করেন। এই সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে একটি সাহিত্যসভার আয়োজন করেছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে তিনি ‘বড়দিদি’, দেবদাস, ‘চন্দ্রনাথ’ ইত্যাদি উপন্যাস এবং ‘অনুপমার প্রেম’, ‘আলো ও ছায়া,’ হরিচরণ ইত্যাদি গল্প রচনা করেন। এই সময় তিনি বনেলী রাজ এস্টেটে কয়েকদিন চাকরি করেন। কিন্তু পিতার ওপর কোনো কারণে অভিমানবশত তিনি সন্ন্যাসী সেজে ঘর ছেড়ে চলে যান। এই সময় তার পিতার মৃত্যু হলে তিনি ভাগলপুর ফিরে এসে পিতার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করে কলকাতা যাত্রা করেন। সেখানে তিনি কলকাতা উচ্চ আদালতের উকিল লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে হিন্দি বইয়ের ইংরেজি তর্জমা করার জন্য মাসে ত্রিশ টাকা বেতনের চাকরি পান। এই সময় তিনি ‘মন্দির’ নামে একটি গল্প লিখে ‘কুন্তলীন’ প্রতিযোগিতায় পাঠালে তা বিজয়ী ঘোষিত হয়। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে বার্মার পাবলিক ওয়ার্কস অ্যাকাউন্টস অফিসের ডেপুটি একজামিনার মনীন্দ্রনাথ মিত্রের সাহায্যে শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে এই অফিসে চাকরি পান ও পরবর্তী দশ বছর এই চাকরী করেন।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে শরৎচন্দ্র এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে ফিরে এলে ‘যমুনা’ নামে পত্রিকার সম্পাদক ফনীন্দ্রনাথ পাল তাকে পত্রিকার জন্য লেখা পাঠাতে অনুরোধ করেন। সেই অনুযায়ী, শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে ফিরে গিয়ে ‘রামের সুমতি’ গল্পটি পাঠিয়ে দেন, যা ‘যমুনা’ পত্রিকায় ১৩১৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার জন্যেও লেখা পাঠাতে শুরু করেন। ফনীন্দ্রনাথ পাল তার উপন্যাস বড়দিদি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স ও গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স তাঁর উপন্যাসগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন।
উপন্যাস হলো বড় গল্প, আখ্যান বা নভেল। আমাদের বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাকে গদ্যশৈলীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন ঔপন্যাসিক। সেদিক থেকে বলা যায়, উপন্যাস হচ্ছে আমাদের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। শরৎচন্দ্র এমনই একজন লেখক তথা কথাশিল্পী যিনি সুনিপুণভাবে তৎকালীন সমাজ বাস্তবতার চিত্র তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। আমরা যখন তাঁর কোনো লেখা পড়ি তখন এমনভাবে এর মধ্যে প্রবেশ করি যেন মনে হয় চোখের সামনে ভেসে উঠছে তাঁর লেখার বিষয়বস্তুটি। আর এটাই হচ্ছে একজন লেখকের সার্থকতা। তাছাড়া সমাজের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি, কুসংস্কার, তিনি তাঁর উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। শরৎচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘পণ্ডিতমশাই’- যা কিছুদিন আগে আমি পড়ছিলাম। এই উপন্যাসটিতেও একজন নারীর ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন। যার নাম কুসুম, সেই কুসুমকে ঘিরে তিনি তৎকালীন সমাজের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন। এছাড়া এই উপন্যাসের আর একটি জিনিস আমাকে খুবই আপ্লুত করেছে, সেটা হচ্ছে, কুসুমের বাল্যকাল থেকে তার বিয়ে পর্যন্ত সময়কাল অনেক ঘটনাবহুল এবং তাঁর স্বামীকে দেখানো হয়েছে একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে। যিনি তখনকার সময়ে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিচ্ছিলেন। কিন্তু কুসুমের সাথে তার স্বামীর সংসার করা হয়নি, সবশেষে যখন তিনি রিক্ত এবং শূন্য, ঠিক তখনই তার পাশে এসে কুসুম দাঁড়িয়েছিল অনেকটা জোর করে, আর এই চিত্রটি হলো একজন আদর্শ বাঙালি রমনীর রূপ। আর এই বিষয়টি তৎকালীন সমাজের চিত্র, আমি তা পড়ে অভিভূত হয়েছি।
বড়দিদি (১৯১৩), পল্লীসমাজ (১৯১৬), দেবদাস (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), শ্রীকান্ত (চারখন্ডে-১৯১৭-১৯৩৩), দত্তা (১৯১৮), গৃহদাহ (১৯২০), পথের দাবী (১৯২৬), পরিণীতা (১৯১৪), শেষ প্রশ্ন (১৯৩১) ইত্যাদি শরৎচন্দ্র রচিত বিখ্যাত উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তার দরুণ তিনি ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ নামে খ্যাত।
শরৎচন্দ্র বার্মা রেলের হিসাব পরীক্ষক হিসেবে পঁচাত্তর টাকা মাইনের কেরানিগিরি চাকরি লাভ করেন ১৯০৫ সালে। তখন রেঙ্গুনের উপকণ্ঠে বোটাটং পোজনডং অঞ্চলে কলকারখানার মিস্ত্রিদের পল্লীতে বসবাস করতেন। তাঁর বাসার নিচে শান্তিদেবী নামে এক ব্রাহ্মণ মিস্ত্রির কন্যা বাস করতেন। তার পিতা তার সঙ্গে এক মদ্যপের বিয়ে ঠিক করলে শান্তিদেবী শরৎচন্দ্রকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে অনুরোধ করায় শরৎচন্দ্র তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হন। তাদের এক পুত্র সন্তানেরও জন্ম হয়। কিন্তু রেঙ্গুনের প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তিদেবী ও তার এক বছরের সন্তান মৃত্যুবরণ করেন। এর অনেককাল পরে শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে কৃষ্ণদাস অধিকারী নামে এক ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তির অনুরোধে তার ১৪ বছরের কন্যা মোক্ষদাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি মোক্ষদার নাম রাখেন হিরন্ময়ী দেবী। তারা নিঃসন্তান ছিলেন।
শরৎচন্দ্রের সাহিত্যকর্মকে ঘিরে ভারতীয় উপমহাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশটি চলচ্চিত্র বিভিন্ন ভাষায় নির্মিত হয়েছে। তার মধ্যে ‘দেবদাস’ উপন্যাসটি বাংলা, হিন্দি এবং তেলেগু ভাষায় আটবার তৈরি হয়। বিভিন্ন সময়ে ‘দেবদাস’ বাংলা ও হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন প্রমথেশ বড়ুয়া, কাননদেবী, উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দিলীপ কুমার, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, সুমিত্রা মুখার্জি, শাহরুখ খান, ঐশ্বর্য রাই বচ্চন, মাধুরী দীক্ষিত প্রমুখ। এছাড়া সন্ধ্যারাণি ও উত্তমকুমার অভিনীত বিখ্যাত বাংলা ছবি ‘বড়দিদি’, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও মৌসুমি চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘পরিণীতা’ ছবি নির্মিত হয়। ‘পরিণীতা’ উপন্যাস দু-বার চলচ্চিত্রায়িত হয়, বাংলা ছবি উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘চন্দ্রনাথ’, রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত’। উত্তমকুমার ও মাধবী মুখার্জি অভিনীত ‘বিরাজ বউ’ ঋষিকেশ মুখার্জির হিন্দি ছবি ‘মাঝলি দিদি’ অন্যতম। স্বামী (১৯৭৭) চলচ্চিত্রের জন্য ফিল্মফেয়ার সেরা লেখকের পুরস্কার পান। ‘বিন্দুর ছেলে” অবলম্বনে ‘ছোটি বহু’ (১৯৭১) নামে বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এছাড়া তাঁর ‘নববিধান’ উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ‘তুমহারি পাখি’ নামে একটি ভারতীয় টিভি ধারাবাহিক নির্মিত হয়।
মধ্যবয়সে শরৎচন্দ্র হাওড়া জেলার পানি ত্রাস (সামতাবেড়) গ্রামের বাড়িতে বাস করতেন। সামতাবেড়ের বাড়িটা রূপনারায়ণ নদের তীরে এবং মনোরম পরিবেশে অবস্থিত। পাশাপাশি দুটো পুকুরে সানের ঘাট, বাগান, ডালিম, পেয়ারা গাছে ঘেরা। পরবর্তীতে শরৎচন্দ্র শিবপুরেও থাকতেন। শিবপুর ব্যাতাইতলা বাজার থেকে চ্যাটার্জিহাট পর্যন্ত রাস্তা শরৎচন্দ্রের নামেই চালু আছে।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে শরৎচন্দ্র প্রায়শই অসুস্থ থাকতেন। এই সময় তার যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ে, যা তার পাকস্থলী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বিধানচন্দ্র রায়, কুমুদশঙ্কর রায় প্রমুখ চিকিৎসক তার অস্ত্রোপচারের পক্ষে মত দেন। চিকিৎসার জন্য তাকে প্রথমে দক্ষিণ কলকাতার সাবার্বান হসপিটাল রোডের একটি ইউরোপীয় নার্সিং হোমে ও পরে ৪ নম্বর ভিক্টোরিয়া টেরাসে অবস্থিত পার্ক নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়। ১৯৩৮ খ্রিস্টাদের ১২ জানুয়ারি শল্য চিকিৎসক ললিতামোহন বন্দোপাধ্যায় তাঁর দেহে অস্ত্রোপচার করেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। চারদিন পর ১৬ জানুয়ারি সকাল দশটায় শরৎচন্দ্র শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
বাংলা সাহিত্যকে যারা অনন্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর শ্রেষ্ঠ সব উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা ভাষাভাষীদের মনে চির স্মরণীয় আছেন। তাঁর সৃষ্টিকর্ম তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে। তাইতো তিনি বাঙালির কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। যতদিন বাংলা সাহিত্য থাকবে ততদিন বেঁচে থাকবেন এই অমর কথা সাহিত্যিক।