শান্নাফের কুকুর ছানা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ ডিসেম্বর ২০২১, ৫:০৯:৫৫ অপরাহ্ন

মনিরা মিতু
সকালের মিঠা রোদে নাদুসনুদুস ৬টা কুকুরছানা খেলা করছে। একটা অন্যটার গায়ের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে আর খুনসুটি করছে। কোয়ার্টারের ছোট ছেলে-মেয়েরা দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখছে। শান্নাফের বয়স মাত্র দুই বছর।
কুকুর ছানাগুলো দেখে সবচেয়ে বেশি খুশি সে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই শান্নাফ ছানাগুলোকে দেখতে যায়। কোয়াটারের সামনে বাচ্চাগুলো তাদের মায়ের সাথে থাকে। আজ সকালে ওদের মা খাবারের খোঁজে বাহির হয়েছে আর বাচ্চাগুলো খেলা করছে। খেলতে খেলতে সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায় কিন্তু ওদের মা ফিরে আসেনা। দুধ খাওয়ার জন্য বাচ্চাগুলো। ছটফট করে। মায়ের খোঁজে এদিক-সেদিক যায়। শান্নাফসহ অন্য ছেলে-মেয়েরা বারে বারে এসে দেখে ওদের মা ফিরেছে কী না। সারারাত বাচ্চাগুলো কুতকুত করে মায়ের বুকের ওম খোঁজে কিন্তু পায় না। শান্নাফ গভীর রাতেও মাকে বলে ‘আম্মু ছানাগুলোর মা এসেছে!’ শান্নাফই শুধু কুকুর ছানাগুলোর জন্য কষ্ট পায় না, কোয়ার্টারের অন্য ছেলেমেয়েরাও কষ্ট পায়। তাই তো সকালে ঘুম থেকে উঠেই চঞ্চল হয়ে ছুটে যায় ওদের দেখতে। বাচ্চাগুলোর মা ফিরে আসেনি, ওরা ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে। হীরা দৌড়ে গিয়ে বাসা থেকে ফিডার নিয়ে আসে। বাচ্চাগুলোর মুখের কাছে ফিডার ধরতেই চুকচুক করে খেতে শুরু করে। তারপর থেকে বাচ্চাগুলোকে সকাল-বিকাল পালা করে ফিডার খাওয়ায় ওরা। ছেলে-মেয়েগুলো সারাদিন বাচ্চাগুলোর সাথে খেলা করে, আদর করে। মানুষ আর প্রাণীর ভেতর কি আশ্চর্য ভালোবাসা! শান্নাফ এখন মাছ-ভাত খেয়ে সামান্য একটু ভাত প্লেটে রেখে দেয়, মাছের কাটা রেখে দেয়। কোয়ার্টারের অন্য ছেলে-মেয়েরাও শান্নাফের মতো বাচ্চাগুলোকে খাবার দেয়। শুধু কি মাছ-ভাত! বিস্কুট-কেক-পিজ্জা কিছুই বাদ যায় না। ছেলে-মেয়েদের দেখলেই ছানাগুলো দৌড়ে আসে ওদের পা পেঁচিয়ে ধরে, লেজ নাড়ে। কিন্তু এখন ছয়টা কুকুরছানা নেই। প্রথম ছানাটাকে যেদিন শেয়াল ধরে নিয়ে যায় সেদিন শান্নাফের কী কান্না! দ্বিতীয় আর তৃতীয় বাচ্চাটাকেও শিয়াল কাময়ে দিয়েছিল। অসুস্থ হয়ে একসময় ওদুটো মারা যায়। প্রিয় তিনটা কুকুর ছানা হারিয়ে কোয়ার্টারের বাচ্চারা খুব কষ্ট পেয়েছে। তা আরও কষ্ট পেয়েছে এটা জেনে যে মা কুকুরটাকে সেদিন ‘সিটি কর্পোরেশনের কুকুর নিধন বাহিনী মেরে ফেলেছে। আর তাই সে তার বাচ্চাদের কাছে ফিরতে পারেনি। কথাটা শুনে ওরা-ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলো। সিটি কর্পোরেশনের আঙ্কেলরা শুধু বলেছিল, “আমরা আদেশ মানতে বাধ্য, না মানলে আমাদের চাকরি থাকবে না। শেয়ালের হাত থেকে বাকি ছানাগুলোকে রক্ষা করতে ছেলেমেয়েরা একটা বুদ্ধি বের করেছে। সন্ধ্যার সময় স্কুলের সামনের শুকনো ড্রেনটার ভিতরে ছানাগুলোকে রেখে দু’পাশেই ইট দিয়ে দেয়। এতে করে বাচ্চাগুলো আর বাইরে বের হতে পারে না আর শেয়ালও ওদের খেতে পারে না। শীতের হাত থেকে রক্ষার জন্য ওদের গায়ের ওপর বস্তা দিয়ে দেয় ওরা। এভাবেই যত্নে বেড়ে ওঠে ছানাগুলো। শান্নাফ, তানজিম, তাহমীম, হীরা সবই ছানাগুলোকে আদর করে, ওদের সাথে খেলা করে। ওরা ছানাগুলোকে গোসল করিয়ে দেয়, দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। শুধু ছেলে-মেয়েগুলোই ছানাগুলোকে ভালবেসে ফেলেছে তা কিন্তু না ওদের বাবা-মাও ভালোবেসে ফেলেছেন। তাই তো ছানাগুলোকে নিয়ে খেলা করতে ছেলে-মেয়েদের বাধা দেন না তারা। শুধু খেলা শেষ হলে হাত-পা ভালো করে ধুয়ে ঘরে ঢুকতে বলে। শান্নাফ ছানাগুলোর নাম দিয়েছে- গলু, মলু আর পলু। সাদা-কালো ছানাটার নাম গলু, কালোটার নাম মলু আর লাল ছানাটার নাম পলু। গলু-মলু-পলুকে নিয়ে ভালোই দিন কাটে শান্নাফের। এক ভোরে ছানাগুলোর ডাকে ঘুম ভাঙে শান্নাফের। সে এক লাফে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। কেউ তাড়া করছে গলু-মলুদের। শান্নাফসহ সবাই দৌড়ে নিচে নেমে দেখে সিটি কর্পোরেশনের আঙ্কেলরা। ওনাদের দেখেই সবার বুকের ধুকপুক বেড়ে যায়। ছানা তিনটিকে মারার কথা বলতেই সবাই ঘিরে ধরে ওনাদের, কিছুতেই গলু-মলুদের মারতে দেবে না তারা। ফিরে যায় সিটি কর্পোরেশনের লোকজন তবে বলে যায় কুকুর মারার হুকুম এসেছে। আজ অথবা কাল এদের মারতেই হবে। গলু-মলু-পলুকে মেরে ফেলবে এটা যেন কিছুতেই ভাবতে পারে না শান্নাফ। ওর খাওয়া-ঘুম সব বন্ধ হয়ে যায়। মাকে বারবার বলে ‘আম্মু ওদের কেন মেরে ফেলবে? কি করেছে ওরা?’ ছেলের কথার কোনো উত্তর দিতে পারেন না শান্নাফের মা। সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি প্রায়ই আসে কিন্তু ওদের মারতে গেলেই কোয়ার্টারের ছেলে-মেয়েগুলো বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ওদের কাকুতি-মিনতির সামনে হেরে যায় তারা। এক সকালে গলু-মলু-পলুর চিৎকারে সবাই নিচে নেমে আসে। এসেই আঁতকে ওঠে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে আর মলু চিৎ হয়ে পড়ে আছে। সবাইকে আসতে দেখে দ্রুত চলে যায় সিটি কর্পোরেশনের গাড়িটি। মলুর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে সেখানে, সবার চোখে পানি। শান্নাফের কান্না দেখে ওর বাবাও গোপনে চোখ মোছে। সিটি কর্পোরেশনের লোকজন যাবার আগে এক দিনের সময় দিয়েছে এর ভেতর গলু আর পলুকে সরাতে হবে নইলে ওদেরকেও বাচানো যাবে না।
অবশেষে সবাই সিদ্ধান্ত নেয় গলু-পলুকে সিটি কর্পোরেশনের বাইরে কোথাও রেখে আসা হবে কিন্তু সমস্যা কে এই কঠিন কাজটি করবে! সবাই ওদের ভালোবাসে, ওদেরকে ফেলে দিতে কারো মন চাইছে না। কিন্তু কি আর করা! গলু-পলুকে ফেলে দিলে ওরা হয়ত কষ্ট পাবে কিন্তু প্রাণে বেঁচে যাবে। কমলা রঙের আলো আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। লাল থালার মতো সূর্যটা মায়ের কপালের টিপের মতো জ্বলজ্বল করছে। পাখিরা ফিরে যাচ্ছে তাদের নীড়ে। পাতা ঝরা ন্যাড়া গাছগুলো থিরথির করে কাপছে। বাতাস গুনগুন আওয়াজ তুলে শীতের আমেজ বাড়িয়ে তুলছে। শান্নাফ মুখ লুকিয়ে আছে মায়ের বুকে কোয়ার্টারজুড়ে নীরবতা। শুধু বস্তাবন্দি গলু-পলুর আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছে গোধূলির সন্ধ্যা। এক সময় ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ হতে হতে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় সে আর্তনাদ।