শায়খুল হাদিস আল্লামা হবিবুর রহমান (র.)-এর জীবন ও কর্ম
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ৪:৪৫:৪৫ অপরাহ্ন

সৈয়দ মবনু
শায়খুল হাদিস আল্লামা হাবিবুর রহমান (র.) ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২২ খ্রিস্টাব্দ সন্ধ্যা ৬ টা ১০ মিনিটে তাঁর নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন আমার বন্ধু মাওলানা আব্দুল আউয়াল হেলালের পিতা। আব্দুল আউয়াল হেলাল বর্তমানে যুক্তরাজ্য প্রবাসী এবং একজন গবেষক আলেম। তাঁর সাথে আমার লেখালেখির সূত্রে পরিচয় বা বন্ধুত্বের সূচনা ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ বা এর কিছুদিন পূর্বে। দীর্ঘদিন দেশে-বিদেশে এক সাথে চলাফেরা হয়েছে। বন্ধুর বাবা হিসাবে শায়খুল হাদিস আল্লামা হাবিবুর রহমান (র.)-কে আমি হৃদয় থেকে অনুভব করতাম।
শায়খুল হাদীস আল্লামা হাবিবুর রহমান (র.)-এর নামের সাথে আমার পূর্ব পরিচয় থাকলেও সরাসরি প্রথম দেখা হয়েছিলো যখন ১৯৯৩ বা ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে বৃহত্তর সিলেটে ব্যাপক বন্যা হয়েছিলো। সেই সময় জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের এমপি ছিলেন শায়খুল হাদিস আল্লামা উবায়দুল হক উজিরপুরী (র.)। আমরা এমপি সাহেবের নেতৃত্বে জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের বন্যা দূর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণে গেলে তিনি আমাদেরকে নিয়ে জকিগঞ্জের ইছামতি মাদরাসায় যান তাঁর সহপাঠি বন্ধু শায়খুলহাদিস আল্লামা মো. হবিবুর রহমান সাহেবের সাথে দেখা করতে। সেদিন আমরা নিরব দর্শক হয়ে দেখেছিলাম তাদের দুই বন্ধুর অনেক মজাদার গল্প। আমাদের জন্য অনেক আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। সেদিনের দুজনের আলোচনায় বুঝতে পারি যে এমপি উবায়দুল হক উজিরপুরী (র.) এবং তাঁর বন্ধু শায়খুলহাদিস আল্লামা মো. হবিবুর রহমান দুজনই তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন এবং ইলমী মানুষ। দুজনই সাধক।
শায়খুল হাদিস আল্লামা মো. হবিবুর রহমান সাহেবের সাথে আমার দ্বিতীয় দেখা আজ থেকে বেশ আগে সম্ভবত ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে বার্মিংহামের হেনসওয়ার্থের ব্রড ষ্ট্রিট জামে মসজিদের এক ইসলামী সম্মেলনে। তিনি সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন নেজামে ইসলাম পাটির নেতা এডভোকেট মাওলানা আব্দুর রকিব। এই মসজিদের খতিব ও ইমাম ছিলেন রাকিব সাহেবের ভাগিনা। নাম স্মরণ হচ্ছেনা। বক্তা হিসাবে আমারও দাওয়াত ছিলো। শায়খুল হাদিস আল্লামা মো. হবিবুর রহমান সাহেবকে সামনে রেখে আমি প্রায় পনেরো মিনিট বক্তব্য রাখি, যা সেই সময় আমার জন্য বেশ ভয়েরই কারণ ছিলো। আমার বক্তব্যেও শেষে বক্তব্য রাখেন এডভোকেট মাওলানা আব্দুর রকিব, এই ফাঁকে আল্লামা মো. হবিবুর রহমান সাহেবের সাথে আমার কিছু কথা হয় এবং তিনি আমার বক্তব্যের প্রশংসা করেন। সেদিন আমার বক্তব্যের বিষয় ছিলো ‘মুসলিম উম্মাহের ঐক্য এবং বর্তমান অনৈক্যের কারণ।’ এরপর তাঁকে দূর থেকে বেশ ক’বার দেখেছি। বন্ধুর বাবা হিসাবে শ্রদ্ধায় দূরত্ব বজায় রেখেছি চললেও নিয়মিত তাঁর খবর রেখেছি।
শায়খুলহাদিস আল্লামা মো. হবিবুর রহমান (র.)-এর জন্ম সিলেটের জকিগঞ্জে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর পিতা মাওলানা মুমতায আলী (র.)। তিনি এলাকায় প্রাইমারি শেষে প্রথমে জকিগঞ্জের পাশে ভারতের বদরপুর সিনিয়র মাদরাসায়, পরে কানাইঘাটের সড়কের বাজার আহমদিয়া মাদরাসায়, এরপর সিলেটের গাছবাড়ি জামেউল উলূম মাদরাসায় ভর্তি হন। এই মাদরাসা থেকে তিনি পূর্ব পাকিস্তান মাদরাসা এডুকেশন বোর্ডের অধীনে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে আলিম পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বাদশ স্থান লাভ করে প্রথম বিভাগে, ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ফাযজিল পরীক্ষায় বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান লাভ করে প্রথম বিভাগে, ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে হাদিস বিভাগে কামিল পরীক্ষায় বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বাদশ স্থান লাভ করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
শায়খুল হাদিস আল্লামা মো. হবিবুর রহমান (র.) ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ছামতি দারুল উলূম সিনিয়র মাদরাসায় সহকারী মাওলানা পদে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফুলবাড়ি আজিরিয়া মাদরাসায় শিক্ষক হিসাবে যোগদেন। তবে এবছরই তিনি প্রধান মুহাদ্দিস হয়ে চলে যান সৎপুর দারুল হাদিস মাদরাসায়। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি তিনি ইছামতি দারুল উলুম মাদরাসায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। এরপর কিছুদিন সৎপুর দারুল হাদিস মাদরাসায় অধ্যক্ষের দায়িত্ব আদায় করেন। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আরব আমিরাতে ছিলেন। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে দেশে আবার ইছামতি মাদরাসার অধ্যক্ষ পদে যোগদান করে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বৃটেন-আমেরিকা সহ বিশ্বের বেশকিছু দেশ সফর করেছেন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি নেজামে ইসলাম পার্টি এবং বাংলাদেশ আঞ্জুমানে আল-ইসলাহ’র সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। আধ্যাত্মিকতায় তিনি আল্লামা আব্দুল লতিফ ফুলতলী (র.)-এর খেলাফতি লাভ করেন। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি জকিগঞ্জের থানাবাজারে হিফজুল কুরআন মাদরাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
শায়খুল হাদিস আল্লামা মো. হবিবুর রহমান (র.)-এর লেখালেখিতেও প্রচুর অবদান রয়েছে। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের দিকে তাঁর সম্পাদনায় সিলেট শহর থেকে ‘মাসিক শাহজালাল’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যা ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চালু ছিলো। তাঁর লেখা ১৭টি বই প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায়; ১. আল কাউলুল মাকবুল ফী মিলাদির রাসুল (১৯৭৭ খ্রি.), ২. দোয়ায়ে মাসনুনা ও তেত্রিশ আয়াতের ফজিলত (২০১০খ্রি.), ৩.মাসআলায়ে উশর : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ (২০০৬ খ্রি.), ৪.দুরূদ শরীফের ফযীলত ও ওযীফা (১৯৯৯ খ্রি.), ৫. যিয়ারতে মদীনা মুনাওয়ারা (১৯৯৯ খ্রি.), ৬. আসহাবে বদর (১৯৯৮ খ্রি.), ৭. ওযীফা (১৯৯৮ খ্রি.), ৮. হজ্জ ও যিয়ারত (১৯৯৯ খ্রি.), ৯. হাদিয়াতুল লাবীব ফী নাবযাতিম মিন সীরাতিন নাবিয়্যিল হাবীব (আরবী ভাষায় লেখা সংক্ষিপ্ত সীরাতের কিতাব, ২০১১ খ্রি.), ১০. যাখীরাতুল আহাদীসিল আরবাঈন ফী ফাদায়িলি সায়্যিদিল মুরসালীন (২০১১খ্রি.), ১১. কানযুল আহাদীসিল আরবাঈন ফী মানাকিবি আহলি বাইতিন নাবিয়্যিল আমীন (২০১১খ্রি.), ১২. তুহফাতুল লাবীব বিআসানীদিল হাবীব (১৯৮৫ খ্রি.), ১৩. আত তুহফাতুল লাতীফাহ ফী আহাদীসিল মুসালসালাতিল মুনীফাহ (২০০৯ খ্রি.), ১৪. দালাইলুল খাইরাত (২০১০ খ্রি.), ১৫. আল হিযবুল আযম (২০১৬ খ্রি.), ১৬. দারসে হাদীস-১ (২০১৮ খ্রি.), ১৭.সালাতুত তারাবীহ (২০১৯ খ্রি.)।
আল্লামা হবিবুর রহমান (র.)-এর ইন্তেকালের কিছুদিন পূর্বে (৩০ জানুয়ারি ২০২২ খ্রিস্টাব্দে) তাঁর স্ত্রী ইন্তেকাল করেন। তিনিও বার্ধক্যজনিত কারণে অনেকদিন ধরে শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২২ খ্রিস্টাব্দ সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটের দিকে তিনি নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৯ বছর। ৪ ছেলে ৩ মেয়েসহ তাঁর অসংখ্য ভক্ত, অনুসারী, মুরিদান, শিক্ষার্থী ও শুভাকাংখী রয়েছেন। তিনি জীবদ্দশায় অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। মৃত্যুর প্রায় ২ মাস পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিয়মিত হাদিসের দরস দিয়েছেন।
আল্লামা হবিবুর রহমান (র.)-এর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে হাজার হাজার মানুষ এক নজর তাঁকে দেখার জন্য সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গিয়ে উপস্থিত হন জকিগঞ্জে তাঁর বাড়িতে। ৮ ফেব্রুয়ারী মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় জকিগঞ্জের থানাবাজার সংলগ্ন মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। কম হলেও পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার মানুষ তাঁর জানাজায় উপস্থিত হয়েছিলেন। জানাজায় ইমামতি করেন আল্লামা হবিবুর রহমানের বড় ছেলে মাওলানা আব্দুল আউয়াল হেলাল। জানাজায় দেশের শীর্ষ আলেম, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তাসহ দেশের বিভিন্ন পেশার মানুষ অংশ নেন। জানাজা শেষে তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত রারাই গ্রামস্থ আল-হাবীব জামে মসজিদের উত্তর পাশে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
শায়খুল হাদিস আল্লামা মো. হবিবুর রহমান (র.)-এর প্রতি আমাদের হৃদয়ের গভীরে অনেক প্রেম-ভালোবাসা ছিলো। তাঁর মৃত্যুতে আমরা সিলেটবাসী সত্যই একজন দ্বীনি অভিভাবক হারালাম। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচু মাকাম দান করুন।