শিশু একাডেমি ও অরবিন্দ দাসগুপ্ত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জুন ২০২২, ৫:৫৮:৪৬ অপরাহ্ন

জামান মাহবুব
১৯৮১ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সিলেট জেলা শাখার জেলা সংগঠক (বর্তমানে জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা) পদে যোগদান করি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি অর্জনের পরপরই এ পদে যোগদান আমার জন্যে দারুণ চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াল। একই সাথে সরকার সিলেটসহ পুরাতন ২০টি জেলায় শিশু একাডেমি স্থাপন করে শিশু প্রতিভা বিকাশে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। নতুন অফিস, নতুন কার্যক্রম। পঁচিশ বছর বয়সী এক নবীন কর্মকর্তার অনভিজ্ঞতা পদে পদে বিড়ম্বনা সৃষ্টি করতেই পারত। কিন্তু শিশু একাডেমির পদাধিকার বলে সভাপতি জেলা প্রশাসক এএইচএম সিরাজুল হক, পরিচালনা কমিটির সদস্য অধ্যাপক বাহাউদ্দিন জাকারিয়া এবং শিশুবান্ধব ও নাট্যজন হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের সস্নেহ সহযোগিতায় আমি তখন দারুণ উদ্দীপ্ত, অনুপ্রাণিত। ফলে সামনে কোনো বাধা, কোনো জটিলতাই আমার কাছে অন্তরায় মনে হয়নি।
প্রথমে স্কাউট বিল্ডিং-এর একটি জরাজীর্ণ ভবনের সুপরিসর কক্ষে, পরে আম্বরখানার ‘বনশ্রী’ আবাসিক এলাকার দ্বিতল ভবনের নিচতলায় এবং সবশেষে সিলেট অডিটোরিয়াম (বর্তমানে কবি নজরুল অডিটোরিয়াম)-এর দোতলায় শিশু একাডেমি স্থানান্তর করি। ১৯৮২ সালের ১ জুলাই অফিস স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে শিশুদের আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের প্রস্তুতি শুরু হয়। আবৃত্তিতে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য, সংগীতে রামকানাই দাস এবং নৃত্যে সুদত্তা পুরকায়স্থ (রূপু) প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। কিন্তু উপযুক্ত প্রশিক্ষক না পাওয়ায় চিত্রাঙ্কন ক্লাস শুরু করা সম্ভব হলো না। এ বিষয়টি ছিল আমার জন্যে অত্যন্ত পীড়াদায়ক।
পরিচালনা কমিটির সদস্য এবং আবৃত্তি বিভাগের প্রশিক্ষক হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য (যিনি স্বেচ্ছায় সম্মানী গ্রহণ করতেন না) প্রশিক্ষণ ও অনুষ্ঠান-সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্মে আমাকে আন্তরিক সহযোগিতা করতেন। মাস কয়েক পরে একদিন বিকেলে তিনি আমাকে জেল রোডে অবস্থিত ‘সাগর আর্ট’-এ নিয়ে গেলেন। বিশাল একটা সাইনবোর্ডে তুলির শেষ আঁচড় দিতে দিতে সাগর সিংহ বললেন, ‘বাবুল, কী ব্যাপার। হঠাৎ এমন অসময়ে তুমি?’ হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের ডাকনাম বাবুল। আমাকে ইঙ্গিত করে বাবুলদা বললেন, ‘ওকে তো চেনোই-মাহবুবুজ্জামান চৌধুরী।
উনসত্তর-সত্তর সালে সমস্বর লেখক ও শিল্পী সংস্থায় কিশোর-কর্মী হিসেবে আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এখন সে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সিলেট জেলা শাখার জেলা সংগঠক। সাগর সিংহ আমাদেরকে বসতে বললেন। ছোট্ট কক্ষে চারপাশে ছোটোবড়ো সাইনবোর্ড, ব্যানার, পোর্ট্রেট। হাসিমুখে বললেন, ‘আমি কী সাহায্য করতে পারি?’ বাবুলদা বললেন, ‘আমার বিবেচনায় বর্তমানে তুমিই সিলেটের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী। আমরা চাই শিশু একাডেমির চিত্রাঙ্কন প্রশিক্ষণ ক্লাসে প্রশিক্ষক হিসেবে তুমি যোগ দেবে।’ সাগর সিংহ বাবুলদার দিকে এক খিলি পান এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বাবুল, তুমি ভুল করছ। আমি মুখ্যসুখ্য কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। শিক্ষকতা আমার ধাতে সইবে না।’ বাবুলদা নাছোড়বান্দা, ‘আমরা তোমাকে চাই।’ সাগর সিংহ বললেন, ‘তুমি আমার বাল্যবন্ধু। সবই তো জানো, বোঝো।’ আমি উৎসুক হয়ে বললাম, ‘কিছু বলছেন?’ সাগর সিংহ বললেন, ‘আমার এক পুরাতন ছাত্র অরবিন্দ দাসগুপ্ত। ছেলেবেলায় আমার কাছেই আর্টে ওর হাতেখড়ি। বছর ছয়েক আগে বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর অব ফাইন আর্টস-এ ডিগ্রি অর্জন করে সিলেটেই আছে। শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রশিক্ষক হিসেবে ও-ই সবচে উপযুক্ত।’ বাবুলদা ও আমি সাথে সাথেই সম্মত হই। বাবুলদা বললেন, ‘বেশ। সঙ্গে আমার ছোটো গাড়িটা রয়েছে। তোমাকে নিয়েই অরবিন্দ দাসগুপ্তের বাসায় গিয়ে কথা বলে আসি।’
মিরাবাজার বড়ো দিঘির পাড়েই বাসা। গেটের সামনে যাঁর সাথে দেখা, তিনি অরবিন্দ দাসগুপ্তের পিতা নরেন্দ্রচন্দ্র দাসগুপ্ত। সরকারি চাকুরে। বাড়ি কিশোরগঞ্জে। হবিগঞ্জের আজমীরিগঞ্জের কুমুদিনী দাসগুপ্তকে বিয়ে করে তিনি বর্তমানে সিলেটেই থিতু হয়েছেন। সাগর সিংহ, হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য ও আমাকে দেখে তিনি অবাক। কুশল বিনিময়ের পর সাগর সিংহ বললেন, ‘অরবিন্দের কাছে এসেছিলাম। ও কি ঘরে আছে?’ নরেন্দ্রবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, আসুন। ঘরেই আছে।’ কক্ষে দুটো কাঠের চেয়ার, টেবিল ঘেঁষে একটা শোবার খাট। ঘরময় ছবি, বইপত্র আর ছবি আঁকার সরঞ্জাম। আমাদেরকে কোথায় বসতে দেবেন, কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। বাবুলদা বললেন, ‘আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না, বসুন।’ অরবিন্দ দাসগুপ্ত হাত কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। বললেন, ‘স্যারসহ হঠাৎ আপনারা কী মনে করে?’ হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য বললেন, ‘আপনার মতো গুণী শিল্পী ঘরে পড়ে থাকবেন, এ হয় না। আপনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সিলেট জেলা শাখার চিত্রাঙ্কন ক্লাসের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নিন। সিলেটের শিশুরা আপনার মতো যোগ্য শিক্ষকের নিকট প্রশিক্ষণ লাভ করে চিত্রকর্মে পারদর্শী হয়ে উঠুক, এটাই আমরা চাই।’
অরবিন্দ দাসগুপ্ত হঠাৎ মুখ কঠিন করে বললেন, ‘দাদা, এ আদেশটুকু করবেন না।’ সাগর সিংহ বললেন, ‘অরবিন্দ, আমাদেরকে ফিরিয়ে দিচ্ছো?’ অরবিন্দ বললেন, ‘স্যার, মার্জনা করবেন। কিছুদিন আগে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ছেলেমেয়েদেরকে ছবি আঁকা শেখাতাম। এখন আর ভালো লাগে না।’ তাঁর কথায় হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য ও সাগর সিংহ অনেকটা হতাশা হলেন। প্রথম দেখা। তবু অনেকটা দাবি খাটিয়ে বলি, ‘দাদা, শিশু একাডেমিতে আমরা আপনাকে দিয়েই চিত্রাঙ্কন প্রশিক্ষণের ক্লাস চালু করতে চাই। আপনি মাস খানেক কাজ করুন। ভালো না লাগে, চলে আসবেন। এক্ষেত্রে আপনার পুরো স্বাধীনতা থাকবে।’
চায়ের কাপ সবাইকে এগিয়ে দিতে দিতে অরবিন্দ দাসগুপ্ত হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি রাজি। তবে শর্ত রইল, যদি ভালো না লাগে তবে আটকে রাখতে পারবেন না।’ আমরা সানন্দে সম্মত হই।
বাইরে এসে তিনজনই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
সাগর সিংহ বললেন, ‘জামান সাহেব, দেখবেন অরবিন্দ সিলেটের চিত্রকলায় একটা বৈপ্ল¬বিক আন্দোলন গড়ে তুলবে।’ তিরাশি সালের মাঝামাঝি সময়ে শিশু একাডেমিতে চিত্রাঙ্কন প্রশিক্ষণের ক্লাস শুরু হলো। গুটি কয়েক ছাত্রছাত্রীকে নিয়েই অরবিন্দ দাসগুপ্ত ছবি আঁকা শেখানোয় মেতে উঠলেন। এক ঘণ্টার ক্লাস কোন দিক দিয়ে দু ঘণ্টা পেরিয়ে যেত তিনি টেরও পেতেন না। মাস দুয়েকের মধ্যে প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। অভিভাবকেরা এক পাশে দাঁড়িয়ে, কেউ বা চেয়ারে বসে ব¬্যাকবোর্ডের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। সামান্য একটা রেখা ধীরে ধীরে রাজহাঁসে পরিণত হচ্ছে! চকের আঁকিবুকিতে মানুষের মুখাবয়ব ক্রমে পরিস্ফুট হচ্ছে! অরবিন্দ দাসগুপ্ত ক্লাসে নিজে যেমন, তেমনি ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকেরাও আর্টের নেশায় মশগুল হয়ে থাকতেন। মাস দুয়েক পর অরবিন্দ বললেন, ‘শিশু একাডেমি ছেড়ে যাচ্ছি না। এখানে কাজ করতে ভালোই লাগছে।’ আমার মুখে তখন স্বস্তির হাসি।
আমরা পরিকল্পনা করলাম, ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে দুইদিনব্যাপী বাৎসরিক নাটক ও শিশুদের চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করব।
হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের পরিচালনায় শিশুতোষ নাটক ‘কাকাজু’ মঞ্চায়ন এবং অরবিন্দ দাসগুপ্তের সার্বিক তত্ত্বাবধানে শিশুদের চিত্রপ্রদর্শনীর প্রস্তুতি একই সাথে শুরু হলো। মুহূর্তগুলো ছিল দারুণ উত্তেজনায় ভরপুর। চলছে শিশুশিল্পী ও কর্মীদের ছুটোছুটি। নিচে অডিটোরিয়ামের মঞ্চে নাটকের মহড়া, দোতলায় অরবিন্দ দাসগুপ্ত তাঁর সিনিয়র ছাত্র শাহ আলম, বায়েস কাদির ও অন্যান্য নবীন শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিশুদের আঁকা বাঁধাই-করা ছবি দেওয়ালে পেরেক পুঁতে সাজিয়ে রাখছেন একের পর এক। কৌতূহলী দর্শকদের দূরে সরিয়ে রাখার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অফিস-সহায়ক তফজ্জুল আলী ও মো. মুক্তার মিয়া। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে চিত্রকর্মগুলো দেখছেন বিমুগ্ধ অভিভাবকেরা। গোটা সিলেট অডিটোরিয়াম ও শিশু একাডেমি জুড়ে কদিন ধরে চলল উৎসবমুখর পরিবেশ। তখন ছিল সামরিক শাসন আমল। সিলেট অঞ্চলের উপআঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম রব্বানী। তাঁকে ‘কাকাজু’ নাটক ও শিশুদের বার্ষিক চিত্রপ্রদর্শনী উদ্বোধনের আমন্ত্রণ জানাতেই তিনি হাসিমুখে রাজি হলেন। নির্দিষ্ট দিন সন্ধ্যায় সামরিক প্রটোকলসহ সস্ত্রীক শিশু একাডেমিতে তিনি যখন এসে উপস্থিত হন, তার আগেই পৌঁছে গেছেন জেলা প্রশাসক এএইচএম সিরাজুল হক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন) মো. নিজাম উদ্দিনসহ সিলেট শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। এঁদের মধ্যে ছিলেন অধ্যক্ষ কৃষ্ণকুমার পাল চৌধুরী, প্রফেসর এএনএএ মাহবুব আহমদ, অধ্যাপক বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, অধ্যক্ষ রাবেয়া খান আহমদ, সিএম কয়েস সামি, সাংবাদিক আবদুল ওয়াহেদ খান, ছায়া আহমেদ, হুস্নে আরা আহমদ, সুরাইয়া রাজা চৌধুরী, ফাতেমা চৌধুরী, লাভলী চৌধুরী, গৌসুল আলম, এম মুহিবুর রহমান প্রমুখ।
নাটক দেখার আগে শিশু একাডেমির করিডোরে চিত্রপ্রদর্শনী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন প্রধান অতিথিসহ অন্য অতিথিবর্গ। আমার পাশে থেকে সলাজ হাসিতে প্রতিটি চিত্রকর্ম বিশ্লে¬ষণ করছেন অরবিন্দ দাসগুপ্ত। ব্রিগেডিয়ার রব্বানী মন্তব্য করলেন, ‘যোগ্য শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শিশুরা যে অপূর্ব সৃজনী প্রতিভার পরিচয় দিতে পারে, আজকের এই চিত্রপ্রদর্শনী তারই প্রমাণ।’ অন্যান্য অতিথির কণ্ঠেও মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ।
সেকালে শিশু একাডেমি এবং সিলেট অডিটোরিয়ামকে কেন্দ্র করে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, এনজিওকর্মীসহ নানা শ্রেণি পেশার লোকজনের ব্যাপক আনাগোনা ছিল। তখন সিলেট শহরে বিনোদনের ক্ষেত্র ছিল সীমিত। শিশু একাডেমি ছিল মিলনস্থল। পরে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতেও জমজমাট আড্ডা হতো। চিত্রশিল্পী হিসেবে অরবিন্দ দাসগুপ্ত এ অঙ্গনেই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। বিভিন্ন স্কুল, সংস্থা ও সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিতব্য বই, ম্যাগাজিন ও ব্রুশিয়ারের প্রচ্ছদ আঁকা, লোগো তৈরি ইত্যাদির বায়না ক্রমাগত আসতে শুরু করে।
ফলে ১৯৮৪ সালে তিনি বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘ডিজাইন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯০ সালে তিনি জেলা শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা প্রশিক্ষক নিযুক্ত হওয়ায় তাঁর কর্মব্যস্ততা আরো বৃদ্ধি পায়।
শিশু একাডেমিতে প্রথমদিকে দু-বছর মেয়াদি এবং পরে তিন বছর মেয়াদি চিত্রাঙ্কন প্রশিক্ষণ ক্লাস চালু হয়। শত শত ছাত্রছাত্রী অরবিন্দ দাসগুপ্তের দক্ষ প্রশিক্ষণে জেলা, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখায় বহু অভিভাবক বাসায় প্রাইভেট শেখানোর জন্য তাঁকে নিযুক্ত করেন। ফলে অরবিন্দ দাসগুপ্ত খানিকটা আর্থিক স্বচ্ছলতার মুখ দেখেন। ২০০২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন চারুশিল্প প্রতিষ্ঠান ‘চারুকলি শিশু চারুবিদ্যালয়’। মূলত শিশু একাডেমিতে তিন বছর মেয়াদি কোর্স সম্পন্ন করে প্রশিক্ষণার্থীরা চারুকলিতে ভর্তি হয়ে আরও অধিকতর পারদর্শিতা লাভ করত। এঁদের মধ্যে অনেকেই জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণপদক, রৌপ্যপদক ও ব্রোঞ্জপদক লাভ করেছে। কেউ কেউ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সম্মাননা পেয়েছে। এর পেছনে ছিল অরবিন্দ দাসগুপ্তের নিরলস পরিশ্রম ও সাধনা।
সিলেটে আধুনিক চিত্রকলা প্রসারের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব অরবিন্দ দাসগুপ্তের হাত ধরেই অসংখ্য প্রতিভাবান শিল্পী দেশে-বিদেশে সুনাম ও সম্মানের অধিকারী হয়েছেন। শিল্পী হিসেবে তিনি নিজের সৃজনশীলতাকে যতটা কাজে লাগিয়েছেন তার চেয়েও বেশি শ্রম দিয়েছেন শিল্পী তৈরিতে। এক্ষেত্রে তিনি সার্থক শিল্পগুরু। অরবিন্দ দাসগুপ্ত শুধু চিত্রশিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন কবি, রম্যরচয়িতা ও প্রবন্ধকার। প্রকাশিত গ্রন্থ-‘চারুকলার সামাজিক ইতিবৃত্ত’ ও ‘পবনে স্বপন বুনি (কবিতা)’। তাঁর অপ্রকাশিত পাণ্ডলিপির সংখ্যা ১০। চারুশিল্পে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ২০১৩ সালে রাগীব-রাবেয়া একুশে সম্মাননা’, ২০১৪ সালে ‘সিলেট জেলা শিল্পকলা একাডেমি পদক’ এবং ২০১৭ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সিলেট জেলা শাখা কর্তৃক ‘গুণীজন সম্মাননা’ লাভ করেন। হবিগঞ্জের আজমীরিগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কুমুদিনী দাসগুপ্ত ও নরেন্দ্র চন্দ্র দাসগুপ্তের ঔরসে ১৯৫৩ সালের মার্চে যে শিশুসন্তানটি ভূমিষ্ঠ হয়, উত্তরকালে তিনিই আপন সৃষ্টি-মহিমায় সিলেটের আধুনিক চিত্রকলার জগতকে উদ্ভাসিত করে তুলবেন, কে ভেবেছিল! অবশেষে করোনা আক্রান্ত হয়ে অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় সিক্ত শিল্পী অরবিন্দ দাসগুপ্ত ২০২১ সালের ১৮ জুলাই আলোর খেয়ায় ভেসে হারিয়ে গেলেন অনন্তলোকে। মর্ত্যলোকে পড়ে রইল তাঁর হাতে গড়া চিত্রকলার নন্দিত ভুবন।