শুকপরি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৪:২৬:৪৬ অপরাহ্ন

কাজী কেয়া
চাঁদের দেশের পরিরাজ্য। রূপোর পাহাড় বেয়ে নেমেছে সোনালি ঝরনা। সেই ঝরণার সোনারং জল বয়ে গেছে নদী হয়ে। নদীর নাম সোনালিকা। নদীপারে নীল নীল পাহাড়ের কাছেই পরিরানির ঝলমলে প্রাসাদ। পরিরানির কথামতো রাজ্য চলে। রানির মনে অনেক মায়া। রাজ্যের সবাই তাকে ভালোবাসে, ভক্তি করে। সবার কাছে তিনি রানিমা।
রানিমার তিন মেয়ে। বড় মেয়ে শুকপরি। আলো দিয়ে বোনা দুটি ডানা। মেজ মেয়ে ফুলপরি। গোলাপের পাপড়ির মতো ফিনফিনে ডানা তার। আর ছোট মেয়ে মেঘপরি। ডানা দুটি তার মেঘ দিয়ে রাঙানো যেন। রানিপরি তার গুণবতী এই তিন কন্যাকে নিয়ে রাজ্য চালান। পরিরাজ্যের সবাই খুশি রানির এই তিন কন্যার কাজে।
শুকপরির মন মোমের মতো। কারও দুঃখ সে সইতে পারে না। রাজ্যের সবার সুখ-দুঃখে কাছে থাকে। বিপদে এগিয়ে যায়। সেবা ও শান্তির প্রতীক শুকপরি। রাজ্যজুড়ে সুখ-শান্তি বজায় রাখতে খেয়াল রাখে সব সময়। রানিপরির সুখের রাজ্যে দেও-দানবের উপদ্রবও কম নয়। শুকপরি মন্ত্র পড়ে দেও-দানবদের তাড়িয়ে দেয়।
ফুলপরির কাজ ফুল ফোটানো। ফুল না ফুটলে পরিরাজ্য মলিন হয়ে যেত। পাখি গান গাইত না। প্রজাপতি রঙিন ডানা মেলে নাচত না। কোনো উৎসবই জমত না ফুলের অভাবে। ভোরের অনেক আগেই ফুলপরি উড়ে যায় বনে বনে। নদীপারে, পাহাড়ে পাহাড়ে। তার ডানার শব্দেই ফুলমেয়েরা পাপড়ি মেলে হেসে ওঠে।
সবার ছোট মেঘপরি। মেঘপরি রঙিন মেঘের ফুলে শরতের আকাশ সাজায়। গ্রীষ্মে অসহ্য গরমে স্বস্তি আনে বৃষ্টি ঝরিয়ে। বর্ষায় রিমঝিম বৃষ্টির সুরে ময়ূর পেখম মেলে নাচে। বৃষ্টি নামে বলেই পরিরাজ্যের মাঠে মাঠে ফসলের হাসি। মেঘপরির অনেক কাজ। সারা রাজ্য উড়ে উড়ে দেখে নেয়, আবহাওয়া কোথায় কেমন।
তবে রানি পরির নির্দেশেই রাজ্য চলে। তার তিন কন্যারও দায় অনেক। রাজ্যের সবার খোঁজখবর রাখা তাদের নিত্যদিনের কাজ। কারও কোনো অভাব-অসুবিধা থাকলে নিরসনের ব্যবস্থা করতে হয়। সুখে-শান্তিতেই দিন কাটে সবার। রানিমার রাজ্যে সবাই নিরাপদ। রানিমাকে সবাই ভালোবাসে। শ্রদ্ধা করে।
হঠাৎ রাজ্যজুড়ে খবর ছড়াল, রানিমা অসুস্থ। ঘুম নেই চোখে। দৃষ্টি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে। কিছুই খেতে পারেন না। সবার মন তাই খুব খারাপ। রাজ্যের সেরা কবিরাজ-বদ্যি রানিমাকে দেখতে ছুটে আসে। ওষুধপথ্যি দেয়। কাজ হয় না। সপ্তাহ যায়, মাস যায়। চোখে তিনি এখন আর মোটেই দেখতে পান না।
তিন কন্যার মন ভালো নেই। রাজ্যজুড়ে দুঃখ দুঃখ ভাব। সবার মধ্যে ভয় ধরেছে, রানিমার যদি কিছু হয়ে যায়? সব শেষে এল রাজজ্যোতিষ। হাত দেখে বলে, রানিমা সেরে উঠবেন। ওর কথায় তিন কন্যার হাসি ফুটল। জ্যোতিষ বলল, তবে কথা আছে। কী কথা? শুকপরি জানতে চাইল। জ্যোতিষ চোখ বুজে ভাবতে থাকে।
রানিমার পাশে জ্যোতিষ। জ্যোতিষকে ঘিরে তিন কন্যা শুকপরি, ফুলপরি, মেঘপরি। জ্যোতিষ চোখ খুলল। ফুলপরি জানতে চাইল, তো কী করতে হবে এখন? জ্যোতিষ বলল, চাই মউল ফুলের মউ। কোথায় পাব মউল ফুল? মেঘপরি প্রশ্ন করল। জ্যোতিষ জানায়, সবুজ গ্রহে। মানে পৃথিবীতে। সেখানে মানুষের বাস।
ফুলপরি বলল, আমি যাব। গন্ধ চিনে বুঝব আমি কোন বনে ফোটে সে ফুল। মেঘপরি বলল, না, আমি যাব। মেঘের দেশ পেরিয়ে সেই সবুজ পৃথিবী। শুকপরি ওদের থামিয়ে বলল, তোমরা ছোট, থাকো মায়ের কাছে। আমি গিয়ে খুঁজে আনব সেই সবুজ বনের মউল ফুল। জ্যোতিষ বলল, সময় কম, ফিরতে হবে তিন সন্ধ্যা না পেরোতেই।
আজ গেলে মাঝে থাকে মাত্র এক সন্ধ্যা। আর দেরি নয়। শুকপরি বলল, আমি যাই। উড়াল দিল আলোয় বোনা মিহি ডানায় ভর করে। ফুলপরি, মেঘপরি বসে থাকে মায়ের পাশে। প্রাসাদের বাইরে ভিড় করে রাজ্যের সাধারণ পরিরা। সবার মনে উদ্বেগ। অপেক্ষায় থাকে কখন মউল ফুল নিয়ে ফিরবে শুকপরি। সবার চোখ সবুজ গ্রহের দিকে।
কোথায় সেই মউলবন? শুকপরি শত নদী পেরিয়ে, কত মাঠ পেরিয়ে, নীল সাগরের পাড়ে গিয়ে থামে। পুরো দুসন্ধ্যা পেরিয়ে আর এক সকাল। ফিরতে হবে আজ সন্ধ্যার আগেই। শুকপরি আবার ছোটে আরও সামনে। তারপর দেখতে পায় পূবের নীল পাহাড়টা। পাহাড়ের উত্তরে দেখে এক সবুজ বন। সেই বনে হন্যে হয়ে খোঁজে মউল বৃক্ষ। খুঁজে পায় দুপুর গড়ালে। এক আঁচল মউল ফুল নিয়ে শুকপরি তড়িঘড়ি উড়াল দেয় চাঁদের দেশে। মায়ের কাছে।
শুকপরির মিহি ডানা আটকে যায় ভারী মেঘে। বৃষ্টি ভিজিয়ে দেয় সোনালি চুল। শত বাধা ঠেলে ঠেলে শুকপরি ছোটে মায়ের কাছে। হায়, সন্ধ্যা তো ঘনিয়ে এল। শুকপরির ডানা কেমন নেতিয়ে পড়ে। চাঁদের কিনারে পৌঁছতেই ভেতর থেকে আহাজারি ভেসে এল, রানিমা নেই। থমকে যায় তার ডানা। তার চোখ থেকে শোকের ধারা গড়িয়ে পড়ে।
মা যখন নেই, তখন আর দেশে ফিরে কী হবে। সে সারা জনম ওখানেই থেকে গেল।
তোমরা সাঁঝের বেলায় চাঁদের পাশে যে উজ্জ¦ল তারাটা দেখতে পাও, ওটার নাম সন্ধ্যাতারা। সারা রাত জ্বলতে জ্বলতে শেষ রাতে সেই তারা যখন নিবু নিবু ম্লান আলো ছড়াতে থাকে, তখন তাকে আমরা বলি শুকতারা। হ্যাঁ, ওটাই সেই শুকপরি।