ষোলআনা চৌধুরীর বয়ান
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুলাই ২০২২, ৭:২৪:১২ অপরাহ্ন

সালেহ আহমদ খসরু
‘ষোলআনা চৌধুরী’ নামটি আমাকে প্রথমেই প্রশ্ন জাগিয়েছিল যে, এটি কে, বা কোথায় তাঁর নিবাস! পড়তে গিয়ে দেখি আরে এ-যে আমারই প্রায় চারিপাশ না হলেও দু-পাশ তো বটেই, সাথে লেষ্টার লেষ্টা আরও শাখা প্রশাখা এই সমাজের বিরাট অংশ জুড়ে বিদ্যমান। যা লেখকের মনকে ছুঁয়ে গেছে বলেই ছাড় দেন নি বটে, তবে পাশ কেটে গিয়েছেন কতক ক্ষেত্রে। হতে পারে তিনি সৈয়দ বলে চৌধুরীদের সাথে নাড় চেপে আছে, তাই সবটুকু বলা হয়নি। আর সবটুকু কে বলে ভাই! কর্নেল সাহেব বলে ভয়ডর কম, তাই কিছুটা পেরেছেন।
আসি ষোলআনায় আতুয়াজান চৌধুরী মাহবুব চৌধুরীর জীবনবোধ এবং তাঁর চলমান জীবনধারণ পড়তে পড়তে কখনো কখনো নিজেকে মাহবুব চৌধুরী মনে হচ্ছিল। এটি হতে পারে চৌধুরী বংশের লৌহ কণিকা ও শানবাঁধানো ঘাটের পরে বসে সময় বাহিত করা আমিও এক চৌধুরী যার না আছে খেতাব না রয়েছে পাথরে মোড়া প্যাচানো বাঁধানো ঘাট বাট।
আতুয়াজান জমিদারের দর্শন একেবারে ফেলনা বলে যে কেউ হুট করে বলে দিতেই পারে, কিন্তু এর ভেতরের বিষয় বিবেচনা করে যদি কথা বলি তবে মানতে আমি একটুও বিলম্ব করবো না যে, আতুয়াজান চৌধুরীকে যাই বলিনা কেন মূলত এখন সমাজে যা লেখকের ভাষায় ‘সিকি আধুলি’ বা নিতাই গঞ্জের চৌধুরীগণ একটি ব্রান্ডের মতো সৃষ্টি করেছেন, তা মূলত চৌধুরীতে নয় বরং অনাহুত অহমিকা তৈরি করে মূল চৌধুরীর খাসলত বলুন বা দাপট বলি তাকে একেবারে হরিহারি চুড়িয়া আর লাল দোপাট্টায় নামিয়ে এনেছে! কেউ বলবেন কেন ভাই, চৌধুরী কি এমন শান আর শাওকত যে রঙের বাজারে ওরা রঙিলা এ কথা বলতে হলেও ঠাটবাট বজায় রেখে বলতে হবে! এইখানেই ষোলআনা চৌধুরী পড়লে আসল চৌধুরীর সব ভাব ও রস বোঝা কষ্টকর নয় বরং সহজে বোধগম্য। এবং কেমন করে সেই ঠাটবাট আজিকার দিনে পানসে অথবা ফিকে হয়ে গেছে। এই ফিকে হওয়া রঙের মাঝেও আতুয়াজান চৌধুরী জনাব মাহবুব চৌধুরীর জীবন দর্শন নিকট অতীত না হলেও স্মৃতি রোমন্থন করে অনুধাবন করা যায় চৌধুরী কোন্ জাত৷ এই জাত শব্দ ব্যবহার করায় আমার উপর না আবার কেউ নাখোশ হন ‘কোন্ জাত’ বলে তাঁদের না কুলমানে আঘাত করে দিলাম! ভাবতে পারেন বহুকিছু-কিন্তু চৌধুরী পরিবার সে কি! তা সৈয়দ রক্ত তিলেতিলে বুঝেছেন তাঁদের চলমান অতীত দিনপঞ্জিতে, তাই কি-না কথা আছে সৈয়দ আর চৌধুরীর মাঝে ঠান্ডা লড়াই সেই কালে যুৎসই ছিলো বটে। যা আজ কেবলই স্মৃতি তর্পণ ছাড়া আর কিছু বললে তখন সমস্বরে আওয়াজ আসতেই পারে ক’জন চৌধুরী ও সৈয়দ বিচরণ করেন সমাজে এবং সে প্রশ্ন ওঠতেই পারে। তখন আবার নতুন কথা পাড়ি দিয়ে কোন কুলে আমি ভেসে যাই, তাই ওদিকে নজর না দিয়ে বরং ষোলআনাতেই থাকি।
শুধু কি ফয়সল চৌধুরী এবং সাদিয়া ঘিরে আবর্তিত এই ষোলআনা চৌধুরী! মোটেই নয়, বরং আলীম চৌধুরীর চতুর্থ তরফার স্ত্রীর ঘরে জন্ম নেয়া কন্যার জন্যে বিয়ের প্রস্তাবে মাহবুব চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া এবং দারোগা সাহেবের অবস্থান পাঠককে নিয়ে গেছে চৌধুরীদের শানে ও ঠাটে। এই যেমন মফিজ চৌধুরী নতুন দারোগা দেখে এসে ফেরার পথে মাহবুব চৌধুরীর সাথে কথোপকথন জানান দেয় তৎকালীন দারোগা সাহেবের অবস্থান এবং সেই সময়ে গড়ে ওঠা পুলিশ ফ্রেন্ড আর কিছু নয় নিছক থানার দালাল, যা তখনো ছিলো এখনও আছে- কেবল ঠাটবাট ও চরিত্র বদলেছে। কথোপকথন বিবেচনায় নিলে মাহবুব চৌধুরী যে আগাগোড়া চৌধুরী তাতে পাঠকের সন্দেহ থাকবেনা বা থাকার কথা নয়।
আখতারি বেগমের সাথে মাহবুব চৌধুরীর ছেলের বিয়ে নিয়ে কথামালা আমলে নিলে উপন্যাসের শেষ দৃষ্টিতে মাহবুব চৌধুরীকে পরাজিত না বললেও আপাত ব্যার্থ পিতা বলা অনুচিত নয়-সে কথা পরে না হয় বলছি।
আবদুল করিম ঘটকের আগমনে বাহার চৌধুরী সংক্রান্ত ধ্যান ধারণা তথা পুনরায় আখতারি বেগমের সাথে কথোপকথন এবং এতে দেশের দুই স্বাধীনতার ফসল কে কেমন করে লুটে নিয়েছে তা নিয়ে আতুয়াজান চৌধুরী সাহেবের বর্ণনা মূলত আজকের দেশেরই বহু কালো অধ্যায়ের একটি রুপ ফুটে ওঠে, এতে কারও প্রশ্ন থাকলেও আমার পঞ্চইন্দ্রিয় জানান দেয় তাই সঠিক।
উজানি চৌধুরী এবং অদ্য চৌধুরী লিখতে গিয়ে উপন্যাসের এক জায়গায় ঔপন্যাসিক যথার্থই বলেছেন মাহবুব চৌধুরীর বয়ানে – ‘রক্ত শোধন হতে তিন পুরুষ লাগে, আলিমুল্লাহর ছেলে কলিমুল্লাহ ধনী হয়েছে।’ মাহবুব চৌধুরীর জীবন দর্শনে ‘ভদ্রলোক কিরান কামলা- মানুষের ভাগ। মাঝখানে দোকানদার গরু পাইকার ফড়িয়া আড়তদার।’ এবং এরা অর্থ বিত্তের মালিক হয়। এখানে মাহবুব চৌধুরী বলছেন- ‘টাকা দিয়ে জাত কিনেও অভিজাত হতে পারে না’ এই যে আতুয়াজান চৌধুরীর বোধ এটিকে যে যাই বলুক বা সমালোচনা করুন না কেন এটি তখনও যেমন বাস্তবতা এখনও বিদ্যমান।
এখানে নিতাইগঞ্জের আলীম চৌধুরীর চার স্ত্রীর মধ্যে নানান কথা রসবোধের সৃষ্টি করলেও তাঁদের গোসলের সময় কথা-বার্তা উজাই চৌধুরী বা অর্থ বিত্তের শানে এই চৌধুরীগণ কোন পর্যায়ে জীবনের আনন্দ খুঁজে একাধিক রঙ্গের পসরা সাজিয়ে থাকতেন তাও স্পষ্ট। তবে হুসনা খানম ও ছোট বউয়ের কথোপকথন পরস্পরের প্রতি জ্বালা ও দাপট প্রকাশের যে চেষ্টা তা চৌধুরীদের জীবনে বহু কল্পকথা বা বাস্তবিকতায় বিভিন্ন ইতিহাস উপন্যাসে কিঞ্চিৎ হলেও চিত্রিত।
এতে রস আছে,ক্ষোভ ছিল এবং এটি ঔপন্যাসিকের সুরুচি-সম্মত রসবোধের প্রকাশ ঘটেছে।
সাদিয়া-ফয়সল উচ্চশিক্ষায় আলোকিত হয়ে জীবনের যে মাত্রা নিজেদের জীবনে ছড়িয়েছে তা ষোলআনা চৌধুরীদের আঘাত করেছে বটে কিন্তু সমাজকে বার্তা দিয়েছে নতুন করে যে, বদলে দিতে হলে একটি শিক্ষিত প্রজন্মই পারে। এবং তারা যেভাবে নষ্টামি ভাবনায় না গিয়ে বরং আরেকজন শিক্ষকের ছায়ায় ভবিষ্যতের সোপান গড়েছে তা হতে বহু পজিটিভ ভাবনার অবকাশ আছে। তবে আমি সাধারণ পাঠক হিসেবে মাহবুব চৌধুরীর সর্বশেষ অবস্থানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এটুকু বলতে কুণ্ঠিত নই-চৌধুরীদের যতই টিটকারি করা হোক না কেন এটিও একটি আদর্শের চারণভূমিতে বিচরণ করে যাওয়া আতুয়াজান চৌধুরী সাহেব যার বিচ্যুতি হয়নি ভাবনায় ও স্থিরতায়। তিনি প্রমাণ করেছেন, ষোলআনা চৌধুরী মরবে কিন্তু ডুববে না।
গোলাম আজাদ অধ্যক্ষ হয়েও সেই সময়কার সমাজ ব্যবস্থায় চৌধুরীদের উপর কোন প্রভাব বা আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হতেন না বলে যে চিত্র ফুটে ওঠেছে তা একেবারে সত্যি কথা, অন্তত ইতিহাস ঘাটলে তাই খুঁজে পাওয়া যায়। তাই বলা যায় ঔপন্যাসিক আপন আলোয় নিজেকে অতীতে ঘুরিয়ে এনেছেন। তবে জীবন ও সমাজ পরিবর্তনে এই উচ্চ শিক্ষিত মানুষগুলো অতি যতনে মানসিকতার পরিবর্তন করতে সহায়ক ছিলেন এবং চৌধুরী সৈয়দ পাঠান তালুকদার যাই বলুন না কেন এরাই ছিলেন সমাজ সংস্কারক।
মাহবুব চৌধুরীর এই যে ভাবনা কতেক অশিক্ষিত এমপি মন্ত্রীকে স্যার স্যার না জপে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির চাকুরী বা প্রাইভেট চাকুরি যে আরও সম্মানের এই ভাবনায় বহুলাংশে একমত না হবার অবকাশ নেই। যদিও এমপি মন্ত্রী আসে যায় সরকারি চাকুরি থেকে যায়,তবে আমলাদের আধিপত্য সমাজকে কিছুই দেয় না তা আজকের দিনে প্রকাশিত সত্য। মূলত দেশের সমাজও অনেকটা বিভ্রান্তিকর এবং এই সুযোগ নিচ্ছে একদল রাজনৈতিক বেপারী ও আমলা কামলা। যাক, এ নিয়ে অন্য কোনো পরিসরে কলম রেখাপাত করবে- আজ নয়।
সিকি চৌধুরী আধুলি চৌধুরী বিষয় নিয়ে যে কাহন ঔপন্যাসিক জুড়েছেন তাতে ষ্পষ্ট বলা যায় আজকাল এই আধুলি ও সিকিদের তোড়ে আতুয়াজান চৌধুরীদের না আছে শান না পাবেন চাকচিক্য, আছে কেবল ঠাটবাট তাই নিয়ে সুখে না হলেও এবং আভিজাত্যপূর্ণ না থেকেও অভিজাত মননের উৎকর্ষতায় জীবনে টিমটিমে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে, তাই বা কম কিসে মাহবুব চৌধুরীর জীবনে।
খেয়াল করে দেখুন ফয়সল আহমদ চৌধুরীকে আতুয়াজান চৌধুরী ফসিল আহমদ চৌধুরী উল্লেখ করে এক লক্ষ টাকার সালামি চেক উপহার দিয়ে যে অভিমত দিয়েছেন অথবা ফসিল আহমদের বিয়েতে সাদিয়ার সালাম নিয়ে ফুফু না খেয়ে যাওয়ার সময় যেভাবে বললেন – ‘তুমি আতুয়াজান চিনো না’ এমন অভিমত এটিই জানান দেয় ষোলআনা চৌধুরী মরে, ডুবে না। হ্যা কিছু আছে যারা চৌধুরীদের ফসিল হয়ে ডোবায়, তারাই আজ সাদিয়া সাদেকাদের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে না চৌধুরী না জমিদার হয়ে আমলা কামলা বা কোন আড়তদারি সামলে নিচ্ছে জীবনের প্রয়োজনে। এবং এখন অধিকাংশ ফসিল বেশি-চৌধুরী কম।
পুরো কাহিনী বিস্তারে গোলাম আজাদ চরিত্রের কোন তুলনা হয় না এ কারণে যে-তিনি যেমন সংস্কারে হাত দিয়েছেন অলক্ষ্যে হলেও, আবার চিন্তার গভীরে গিয়ে এটি অস্বীকার করেন নি যে, মাহবুব চৌধুরীর বংশীয় অহমিকা শাশ্বত। বরং মায়া অনুভব করেছেন এবং নিন্দা করার মতো কোন কারণ খুঁজে পাননি। এই যে লেখকের মনন ও চিন্তার দুরদর্শিতা এটিকে আজও সমাজের সৌন্দর্যের গতিপ্রকৃতিতে ফেলে দেয়া যাবে না বলেই আমার মন সায় দেয়। শিক্ষিত সমাজব্যবস্থায় সুন্দর আভিজাত্যপূর্ণ মেজাজের সমন্বয় হতে পারে এবং হলে পরে একটি পরিপূর্ণ সমৃদ্ধ সামাজিক মূল্যবোধ তৈরি হতে পারে! মতের সাথে হয়তো দ্বিমত থাকবে, কেননা উদাম সমাজ ব্যবস্থাকেও কেউ কেউ মনে করে আধুনিক মানসিকতা এবং সেটিও উত্তরাধিকার হতে বহমান।
এখন এটিকে উপন্যাস বলতে যদি কেউ খটকা খান তবে তিনি হয়তো গল্প বলবেন, আমি কিন্তু এটিকে উপন্যাস বলবো এবং ইতিহাসের চলমান ধারায় একটি জলজ্যান্ত ঘটনার উপন্যাসিক বয়ান।
লেখক কি সুচতুরভাবে খাঁ বংশের প্রতি একটু অবহেলা করলেন কি-না তা আমি ভাবছি। কারণ আতুয়াজান চৌধুরীদের শেষ নায়েব হিসেবে পরাগল খাঁ এনেছেন ও তাঁর বয়ানে বহমান আতুয়াজান চৌধুরী সাম্রাজ্য। উপন্যাসের শুরুতে বারিকউল্লাহ ও মছই যারা চৌধুরীদের হুক্কা সাজাবে এবং ফুটফরমাস পালন করেছে কাহিনীতে, তা কারও মনে কষ্টের উদ্রেক হলেও এটিও তখন চরম বাস্তবতা ছিলো বলেই জানা যায়। অথবা এই তিন যুগ আগেও গেরামের ঠাটবাটে এইসব নামগুলো এখনো বিস্মৃত হয়ে যায় নি। বরং আমারও মনে পড়ে পাখি-টিয়া-বতই এইসকল নামও কোন কোন স্থানে বিদ্যমান ছিলো- তাই বলে আমি বলছি না, এইসব সুন্দর নামে কোন খ্যাতিমান মানুষ নেই। বরং কোথাও হয়তো এই নামেই বহু শান জড়িত থাকতে পারে, তবে তা কম শোনা গেছে।
হয়তো আরও কেউ এ নিয়ে ভাববেন,পাশাপাশি সৈয়দ বংশের শানবাঁধানো সব ঘাট ঘটনা চৌধুরীদের সাথে ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে যা ইতিহাসে আছে-গল্প উপন্যাসে বিদ্যমান। সেদিকে এই চরিত্র বদলেছে বিভিন্ন রূপে ও অবয়বে, কিন্তু লেখক সৈয়দ বলেই কি-না হয়তো এড়িয়ে গেছেন। তবে এক্ষেত্রে কলমের মুন্সিয়ানায় মনেই হয়নি আতুয়াজান চৌধুরী বাড়িতে আর কেউ জরুরী।
ষোলআনা চৌধুরী পড়ার পরে যদি কোনো ‘সিকি আধুলি চৌধুরী’ নিজেকে দশ আনা ভেবে ষোলআনা বলে প্রতিষ্ঠিত করতে সৈয়দ সাহেবের উপর ক্ষেপে যান তাতে আমি অবাক হবো না বরং এমন হলে লেখকের ষোলআনা যদিচ পনের আনায় ঠেকেছে, সেক্ষেত্রে উপন্যাস খানা ষোলআনা সফল হয়ে সার্থকতা খোঁজে পাবে।
বইটির প্রচ্ছদ চোখ টানেনা, কিন্তু গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলে ষোলআনা চৌধুরীর মতোই – চাকচিক্য নেই, প্রাচুর্য নেই কিন্তু ঠাটবাট বোঝা যায় হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করলে।
এখন দেখার বিষয় পাঠক্রমে ষোলআনা চৌধুরী বিস্তৃত হলে চৌধুরী সৈয়দের লড়াই হয় কি-না।