সাফল্য ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ মে ২০২২, ৫:১৪:৪৭ অপরাহ্ন

এএইচএম ফিরোজ আলী
বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, মিঃ শেখ মুজিব! আপনার যোগ্যতা কি? বঙ্গবন্ধুর তড়িৎ উত্তর ছিল, ‘আমি আমার জনগণকে ভালবাসি,। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার অযোগ্যতা কি? বঙ্গবন্ধুর সহজ সরল উক্তি ছিল, ‘আমি আমার জনগণকে বেশি ভালবাসি,। বাঙালির প্রতি জাতির পিতার বেহিসাবি ভালবাসার প্রকাশ পায় এ দুই বাক্যে। চার দশক পর সেই ডেভিড ফ্রস্ট ২০০৮ সালে শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি কি আবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চান? শেখ হাসিনার উত্তর ছিল, ‘আওয়ামীলীগ জনগণের দল, জনগণ যদি চায়, তবেই হতে পারি,। এদেশের মানুষের প্রতি অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস রেখেই এমন কথা বলেছিলেন শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট হত্যাকান্ডেরসময় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা জার্মানিতে থাকায় তারা ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। দীর্ঘ ৬বছর তিনি ভারতে অবস্থান করেন এবং ১৭ মে (১৯৮১) দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। যে কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৭ মে একটি ঐতিহাসিক দিন।
১৯৮১ সালের ১৩-১৪ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সম্মেলনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাঁকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শেখ হাসিনাকে দেশে নিয়ে আসা এবং সভাপতির পদ গ্রহণে রাজী করাতে দিল্লিতে গিয়ে একাধিক বৈঠক করেন আওয়ামীলীগের নেতারা। ক্ষমতায় থাকা জিয়াউর রহমান ও তার দল বিএনপি, পাকিস্তানপন্থি কয়েকটি রাজনৈতিক দল শেখ হাসিনার দেশে আসা ঠেকাতে প্রতিরোধের ডাক দেয় এবং দেশব্যাপী লিফলেট, হ্যান্ডবিল বিতরণ ও তাদের কর্মীদের শক্তি বাড়াতে থাকে। আকাশ বাণী কলকাতা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর আগে-বাগে প্রকাশ করে দেয়। ১৭ মে দিনটি ছিল রবিবার, সেদিন প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি ও তুফান ছিল। সাথে ছিল বর্জ্রপাতের বোমার মত গর্জন। ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা ঝড়-তুফানের চেয়ে শক্তিশালী মনোবল নিয়ে রাজধানী ঢাকার রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িঁয়েছেন। শহরের চেয়ে গ্রামঞ্চলের হাজার হাজার নেতাকর্মী দুই-তিনদিন আগে ঢাকা চলে যান। অভাবী নেতাকর্মীরা হাঁস, মোরগ, গরু, মহিষ ও ঘরের ধান-চাল বিক্রি করে দল বেধে প্রিয়নেত্রীকে একনজর দেখতে ও বরণ করতে ঢাকায় চলে যান। দেশের মানুষের মধ্যে ছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা যে, আদৌ কি শেখ হাসিনা কি দেশে ফিরতে পারবেন? সেদিন জনতার মুখে শ্লোগান ছিল, রাজপথ ছাড়ি নাই, শেখ হাসিনার ভয় নাই, আমরা আছি লাখ ভাই,বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরিনাম বাংলা হবে ভিয়েতনাম, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা। নেতাকর্মীদের মধ্যে আনন্দ উচ্ছাসের মাঝে বেদনা ও আতংকের ছাপ ছিল চেহারায়। এমন ঐতিহাসিক ঘটনার আমিও একজন কর্মী হিসেবে সাক্ষী ছিলাম।
ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ৭০৭ বোয়িং বিমানটি দুপুর ১২টায় অবতরন করে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে জনস্রোতে বিমানবন্দরের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছিল। সাদা রঙের কালো ডোরা কাটা শাড়ি পড়া শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু হলে হাজার হাজার নেতাকর্মী হাউমাউ বিলাপ করতে থাকেন। চোখের জল আর মুষলধারের বৃষ্টি ঢাকার বুকে যেন শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের আবেগ শ্রদ্ধা আর ভালবাসার বন্যা বয়েছিল। মিছিলের গাড়ীর বহর বনানী হয়ে মানিক মিয়া এভিনিউতে আসতে সময় লাগে তিন ঘন্টা। অনেক বৃদ্ধ লোক বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় পড়ে সিজদা করতেও দেখা যায়। ৭২সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মতো অবস্থা হয়েছিল সেদিন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মঞ্চে এসে দাড়াঁলেন বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা। সেদিন শেখ হাসিনার কান্নায় আকাশ বাতাশ যেন ভারি হয়ে উঠেছিল। নেতাকর্মীদের মধ্যেও ছিল বুক ফাটা আর্তনাদ। জনতার স্রোতে সামরিক জান্তার সব চক্রান্ত বানের পানির মতো ভেসে যায়। পিনপতন নিরবতা ও প্রায় ১০লাখ মানুষের সামনে আবেগগণ ভাষণে শেখ হাসিনা বললেন, ‘আমি আওয়ামীলীগের নেত্রী হতে আসিনি, বাংলার মানুষের পাশে থেকে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে এসেছি। আমি আপনাদের বোন ও মেয়ে হয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন কর্মী হিসেবে পাশে থাকতে চাই’। শেখ হাসিনার বক্তব্য শুনে হতাশা ও ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীরা দলকে সুসংগঠিত করতে শপথ গ্রহণ করেন।
১৯৮১-৯৬ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাজপথে ভোট-ভাতের অধিকারের সংগ্রাম শুরু হয়। দীর্ঘ ২১ বছর ইতিহাস বিকৃতি করে মুক্তিযুদ্ধকে বিলীন করে দেয়া হচ্ছিল। বিএনপির ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর এক তরফা নির্বাচন প্রতিরোধ ও প্রতিহত করে ১২ই জুনের নির্বাচনে জয়লাভ করা ছিল শেখ হাসিনার বিরাট এক সাফল্য। শেখ হাসিনার জীবনাশের জন্য ২১ বার হামলা করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় প্রাণে বেঁচে গেলেও আহত হয়েছিলেন তিনি। এ ঘটনায় আইভি রহমানসহ ২৪ জন মারা যান। ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে শেখ হাসিনাসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে সামরিক গোয়েন্দারা চোখ বেধে ঢাকার ক্যান্টমেন্টে নিয়ে ১৫ দিন আটক রাখে। ১৯৮৪-৮৫ সালের ফেব্রুয়ারী ও নভেম্বর মাসে গৃহবন্দি করা হয় এবং পূণরায় ১৯৮৫ সালে তিন মাস গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৮সালে চট্টগ্রাম লালদিঘী ময়দানে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য হামলা করা হলে ৩৮ জন নিহত হন। ১৯৯০সালে ইশ্বরদী রেলওয়ে স্টেশনের উত্তরে বন্দুকধারীরা শেখ হাসিনার রেলের কামরায় গুলি করলে তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। ২০০০সালে কোটালি পাড়ায় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুতিয়ে রাখা হয় শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য। ২০০৯সালে পিলখানা হত্যাকান্ডের পর ইন্টারন্যাশনাল ডোরান্ডট্রিবিন ও নিউয়ার্ক টাইমসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমি জীবনের জন্য ভীত নয়, আমি ভীত হয়ে পড়লে গোটা জাতি ভীত হয়ে পড়বে। আমি থামবো না। আমি তাও জানি কিছু বুলেট আমার জন্য অপেক্ষা করছে’। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৮মাস ও ২০০৭সালে সেনাশাসিত সরকারের আমলেও বন্দি ছিলেন এবং ২০০৮সালের ১২জুন মুক্তি লাভ করে এ বছর ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২৬৪টি আসন লাভ করে। ২০১৪সালের ৫ জানুয়ারী ও ২০১৮সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে চতুর্থবার সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এখন বিশ্বজুড়ে। তৃতীয় বিশ্বের একজন দুরদর্শী নেতা হিসেবে অবর্তীণ হয়েছেন শেখ হাসিনা। ২০০৮সালের নির্বাচনের পর গত এক যুগে দেশের অর্থনীতির সাফল্য সমগ্র দুনিয়ার নজর কেড়েছে। শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে ও সকল কূটনৈতিক তৎপরতায় ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার, ২০১৪সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সমুদ্র সীমানা সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি করে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকায় সার্বভৌম প্রতিষ্ঠা হয়। বিশ্ব ব্যাংকের স্ট্যান্ডান্ড অনুসারে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের ৪১% মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করতেন। ২০২০ সালে সেই সংখ্যা কমে এসে দাঁড়ায় মাত্র ২০%। ১২ বছরে ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র যন্ত্রনা (কক্ষাঘাত) থেকে মুক্ত হয়। দারিদ্র বিমোচনের হারে এটা বিশ্ব রেকড। গঙ্গার পানি চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তি, পদ্মা সেতু, যমুনা সেতু, রাজধানী ঢাকায় উড়াল সেতু ও মেট্রোরেল নির্মাণ, খাদ্যে স্বয়সম্পর্ণতা অর্জন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মঙ্গ দূরীকরণ, বিনামূল্যে বই বিতরণ, পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন, মুক্তিযোদ্ধা, বয়স্ক, বিধবা, পঙ্গু, জেলে, বেদে, হিজড়া ভাতা চালু করে ইতিহাসে নজির সৃষ্টি করেছেন শেখ হাসিনা। করোনাকালিন সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে নগদ অর্থ ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ ছিল মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। করোনাকালিন সময়ে বিশ্ব মন্দার কবলে পড়লেও বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ছিল সচল। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় সাময়িকী পৌবেচেন প্রতিবেদনে এমন তথ্য ফুটে উঠে। এতে বলা হয়, অর্থনীতি মন্দা থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের যে কয়েকটি দেশ করোনার লাগাম ধরতে পেরেছে, তারমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। শেখ হাসিনা করোনা ভাইরাসের শুরুতেই যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রও তা করতে পারেনি।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের মতে, ২০৩২সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। কাতার, ওমান, নিউজিল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মিশর সহ ১৫টি দেশকে টপকে গেছে বাংলাদেশ। তাতে আরও বলা হয়, ২০১৯সালে জিডিপি স্থির ছিল, ১১লাখ ৩৫হাজার ৬শত কোটি টাকা এবং ২০৩৩সালে জিডিপি হবে ২৯ লাখ ১৫ হাজার ৩শত কোটি টাকা। যুক্তরাজ্যের প্রাইসওয়াটারহাউসকোপারস বলেছে, ২০৫০সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে শীর্ষ তিনটি দেশের মধ্যে একটি হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদুত পিটার হাস সম্প্রতি বলেছেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের রপান্তর বিষ্ময়কর। তিনি বলেন, শতভাগ বিদ্যুতায়ন করেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা বাহিনী সবচেয়ে বড় অবদানকারী দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সফল গল্প এখন বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত।
ইতিহাসবিদদের মতে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করলেও বঙ্গবন্ধু দেশে না ফেরলে ইতিহাস হয়তো অমীমাংশিত থেকে যেত। ঠিক তেমনিভাবে শেখ হাসিনা নিজের কোন স্বার্থে নয়, দেশ ও জাতির স্বার্থে বাংলার মানুষের প্রতি দরদ ও ভালবাসা, মমত্ববোধ নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন বলেই বাংলাদেশের সাফল্য ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য শেখ হাসিনা বিশ্বে মেধা, সাহসিকতা ও মানবিকতার শক্তি হয়ে দেশরত্ম থেকে বিশ্ব নেতায় পরিণত হয়েছেন। শেখ হাসিনার জন্য বাংলাদেশ আজ ধন্য।
লেখক : কলামিস্ট।