সাফার হলদে পাখি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ অক্টোবর ২০২১, ৩:৫০:১৭ অপরাহ্ন

আবু মালিহা
সাফার বাড়ির পাশে একটা বকুল গাছ। বেশ বড়। শাখা প্রশাখায় বিস্তারিত গাছটি তার বাড়ির শোভা বর্ধনে দারুণভাবে প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে। বাতাস যখন সেই গাছ দিয়ে বয়ে যায়, তখন ডালপালা সহ দারুণভাবে নেচে ওঠে। সেই গাছটিতেই কত ধরনের পাখি এসে বসে এবং শিস সুরে মুখরিত করে তোলে। আশপাশের আরও গাছগাছালিতে উড়ে উড়ে ডানা ঝাপটিয়ে অদ্ভূত মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করে। হৃদয় মন উৎফুল্লিত করে তোলে প্রতিটি মানুষের। ভালোবাসার অকৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টি করে ফুল পাখি আর মানুষের মাঝে।
রিনা প্রতিনিয়ত সেই সুখ অনুভূতিতে জড়িয়ে রাখে বকুল গাছের পাখিদের সাথে। শত রকমের পাখিদের মাঝে একটি পাখিকে সাফা খুব ভালোবাসে। সেই পাখিটি হলো ‘হলদে পাখি’! অদ্ভূত ভালোলাগার সেই পাখিটিকে সাফা মন থেকে খুব ভালোবাসে এবং আবেগ সোহাগে প্রতিদিন তাকে আদর করে সাফা… বলে, ওরে আমার হলদে পাখি! আয়না, কাছে আয়; তোকে আমি আদর সোহাগ দিয়ে দুধ ভাত খাইয়ে দিব। রঙিন মালার পুঁতি দেব। গলায় দেব সোনার হার পড়িয়ে। আয়না কাছে, আয়…
এভাবে সে ডাকতে থাকে প্রতিদিন ভোর বেলা এবং সন্ধ্যে বেলা। পাখি শুধু তার পানে তাকিয়ে থাকে! আর কিছুক্ষণ পর পর শিস দিয়ে ডাকে। কী মধুর ডাক। সাফাকে পাগল করে তোলে। তার ভাবের আবেগ এমনই হয়, যেন এখনই সে উড়ে যাবে তার কাছে। কিন্তু সে তো আর পাখি নয়; যে তার কাছে উড়ে যাবে। তাই পাখিটি অধরাই থেকে যায় তার কাছে। মনের ভেতর আবেগ আর উল্লাস শুধু ফিরে আসে তার বুকের মধ্যে। তবুও সে তার আবেগকে আশ্রয় করে প্রতিদিন সেই গাছটির কাছে এসে হলদে পাখিকে পলকহীন চেয়ে থাকে এবং মনের আকুতি কতোভাবে জানিয়ে দেয় সে, যে হলদে পাখিকে সে খুব ভালোবাসে এবং সে তার একজন ভালো বন্ধুও।
এমনিভাবে দিন চলে যায়। পাখিটিও প্রতিদিন একটা সময় এভাবে বকুল গাছের ডালে এসে বসে এবং নানান সুরে গান গায়। ফুল পাখি আর গাছ গাছালিতে ভরপুর সাফার বাড়ির চারিদিক। বন বনাঞ্চলে ছেয়ে আছে সবুজ শ্যামলীমায়। ভালোলাগার অকৃত্রিম পরিবেশ সবারই মন প্রাণ কেড়ে নেয় প্রকৃতির এই নৈসর্গিক বনায়ন দৃশ্যমালা।
সাফার মনও প্রকৃতিকে খুব ভালোবাসে, তাই সে ফুল পাখিকে খুব ভালোবাসে। তার মনের অরণ্যে পাখিদের আনাগোনা অনুভব করে প্রতিনিয়ত। তাই সে ফুল পাখিদের অভয়ারণ্যে প্রায়ই বেড়াতে যায় তার বাবার সাথে। বাবাও সাফার এ প্রকৃতি মমতার আবেগকে খুবই দরদ দিয়ে ভালোবাসে এবং কাজের ফাঁকে সময় হলেই তাকে নিয়ে বিভিন্ন পাহাড় টিলা বা বিভিন্ন সুন্দর অরণ্যানীতে বেড়াতে নিয়ে যান। মনের কাননকে ফুটিয়ে তোলার জন্য। কারণ যারা ফুল পাখি ভালোবাসে তারা মানুষকেও ভালোবাসে। আর সত্যিকার অর্থেই সাফার মন খুব সুন্দর! সে ফুল পাখি যেমন পছন্দ করে, তেমনি মানুষকেও ভালোবাসে। বিশেষ করে তার মতো শিশু কিশোরদেরকেও খুব ভালোবাসে। তাদের সাথে খেলাধূলা করে। বনের ধারে ফুল পাখিদের কোলাহলে মাতে এবং পাখিদের মত সুন্দর করে গান গাওয়ার চেষ্টা করে। প্রকৃতির প্রতিটি সৃষ্টিই যেভাবে মহান স্রষ্টার গান করে। যেমন করে ফুল পাখিরা। সাফাও তাদের মত করে গাইতে চেষ্টা করে। আর সে কারণেই সে তার বাড়ির পাশের বকুল গাছটিতে থাকা হলদে পাখির সাথে খুব ভাব জমিয়ে রাখে। পাখিটিও যেন সাফার ভালোবাসার জবাব দিতে সেই বকুল গাছটিতে এসে তারই বাড়ির দিকে চেয়ে সুন্দর করে গান করে। আর অমনি রিনা ঘর থেকে বের হয়ে তাকে বোঝাতে চায় আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, হলদে পাখি! তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমাকে ছেড়ে তুমি কোথাও যেও না।
প্রতিদিন এভাবে আমার বকুল গাছে এসে গান করবে, আমিও তোমার সাথে সুর ধরব; কেমন। একথাগুলো সে যখনি পাখির দিকে তাকিয়ে বলে; তখন হলদে পাখিটি যেন ডানা ঝাপটিয়ে আর শিস দিয়ে তাকে সে কথাটি জানিয়ে দেয়। এবং সেও বলে, সাফা আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমি তোমার জন্যই প্রতিদিন তোমার বকুল গাছের ডালে এসে তোমাকে ভালোবাসা জানাতে আসি। তুমি খুব ভালো মেয়ে। তুমি যেমন সুন্দর! তোমার মনও খুব সুন্দর। তুমি যেমন আমাদের ভালোবাস আমরাও তোমাকে খুব ভালোবাসি। হলদে পাখির একথাগুলো যেন তার মনের ভেতর গভীর ভালোবাসার জন্ম দিল। সাফা উপলদ্ধি করতে পারে পাখির কথাগুলো। পাখিরও যে মন আছে। তারও ভালোলাগা আছে। একথাগুলো ভাবতে ভাবতে সে পাখি প্রেমে গভীরভাবে মগ্ন হয়ে গেলো।
রিনা একদিন বিকেল বেলা তার বাবার সাথে গেলো এক পাহাড় টিলা ঘেরা বনাঞ্চলের পাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াতে। প্রকৃতির সৌন্দর্যকে মাঝে মধ্যে সে দেখতে যায় তার বাবার সাথে। এক কথায় সে একজন প্রকৃতি প্রেমিক। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে সে প্রকৃতির ছবি আঁকে। তার ছোট বোন রাফা এবং ছোট ভাই তাশফিনকে সাথে নিয়ে। খুব সুন্দর করে। সে জন্য মাঝে মধ্যে স্কুল প্রতিযোগিতায় ছবি আঁকায় সে প্রথম হয় এবং পুরষ্কার স্বরূপ প্রকৃতি ও ছবির উপর লেখা অনেক সুন্দর সুন্দর বইও উপহার হিসেবে পায়। স্কুলের সাথীরাও তাকে প্রকৃতি প্রেমিক বলেই জানে। তার ছবি আঁকায় সবাই মুগ্ধ হয়। সবার প্রশংসার কারণে সে আরও উদ্বুদ্ধ হয় প্রকৃতি নিয়ে ভাবতে।
এসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে একদিন সে ঘুমিয়ে পড়ল। সারাদিনের পরিশ্রমের পর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
হঠাৎ করে সে তার বাড়ির বাইরে হলদে পাখিকে দেখে সে গাছের তলায় গিয়ে ডাকতে শুরু করলো, হলদে পাখি আয়না; আমার কাছে আয়… আমি যে তোকে খুব ভালোবাসি। সেদিন সে পাখিটি আর ডাকাডাকি বা শিস সুরে গান গাইলোনা। কেমন যেন নিথর হয়ে বসে রইল একটি ডালে। কেমন নিশ্চুপ হয়ে থাকল। ওভাবে বসে থাকতে দেখে সাফা চমকে উঠলো। সে বুঝতে পারছেনা কী হলো তার! ডাকা ডাকি বা গান গাওয়া নেই। এমন মনমরা অবস্থায় তাকে দেখে সাফার কান্না পেতে লাগলো। সে গভীর মমতা ভরা মন নিয়ে তাকে আবার ডাকলো। হঠাৎ করে রিনা দেখলো পাখিটি ঝুপ করে গাছের ডাল থেকে তার পায়ের কাছে এসে পড়লো। সে খুব আঁতকে উঠলো এবং সাথে সাথেই তাকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির ভিতর গিয়ে আদর সোহাগে ভরে দিতে লাগলো। হঠাৎ তার নজরে পড়লো পাখিটির পা থেকে একটু একটু রক্ত ঝরছে। এটা দেখে সে চিৎকার করে ওঠলো এবং বলল, হায়, আল্লাহ! কে তোর এমন সর্বনাশ করলো! যাচাই করে দেখলো কোন এক পাখি শিকারী তার এ সর্বনাশ ঘটিয়েছে। সে তাকে যথাসম্ভব ঔষধ করে তাকে সেবাযত্ন করতে লাগলো এবং দু চারদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে গেলো। তার সে কী আনন্দ। এবং তাকে বুকের মধ্যে নিয়ে কতো আদর যত্ন করতে লাগলো। দেখা গেলো পাখিটিও যেন তার সাথে খুব ভাব জমিয়ে ফেলল এবং কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগলো। এসব চিন্তা করতে করতে সে তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে একটু বুঝতে চাইল যে, সে কী উড়ে চলে যাবে নাকি তার সাথে খেলা করবে। এ কথা ভাবতে ভাবতে সে যখন বাইরে যাবে, ঠিক তখনই তার মা তাকে ডেকে তুললো- এই সাফা! ভোর হলো… ওঠো, নাস্তা করবে না…।
সে তখন আড়মোড়া দিয়ে জাগতেই তার মাকে দেখে অবাক হলো যে, এতক্ষই সে হলদে পাখি নিয়ে স্বপ্নই দেখছিলো। সে তখন আফসোস করে তার মাকে বলল, মা… তুমি আমাকে কেন জাগালে। আমি আমার হলদে পাখিটার সাথে খেলছিলাম এবং তাকে আদর যত্ন করছিলাম। আমার সব আনন্দ মাটি করে দিলে। সে এ কথা বলতে বলতেই তার বাড়ির বকুল ডাল থেকে হলদে পাখির সুর ভেসে আসছিল। সে তাড়াতাড়ি লাফ দিয়ে বাইরে গিয়ে বকুল ডালে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, আমার প্রিয় হলদে পাখি। আমি যে এতক্ষণই তোমার সাথেই কথা বলছিলাম ও সোহাগ করছিলাম বলেই পাখিটির দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইল সাফা। পাখিটি যেন তার মনের কথা বুঝতে পারলো এবং সেও আবেগ ভরা সুর দিয়ে জানিয়ে দিলো। সাফা, আমিও তোমাকে ভালোবাসি। কেননা, তুমি প্রকৃতি ও ফুল পাখিকে খুব ভালোবাস…।
সাফা অবশেষে স্বপ্নের ঘোর কাটাতে হলদে পাখিটির দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইল।