সামেরির সোনার বাছুর
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৩:২৫:৪৭ অপরাহ্ন

নাওয়াজ মারজান
আজ থেকে চার হাজার বছর আগের কথা। নবি মুসা ছিলেন তখন বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের নবি। বনি ইসরাইলরা ছিলো মিশরীয়দের দাস। এরা প্রায় সাড়ে চারশো’ বছর ধরে মিশরীয়দের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলো। মিশরে তখন অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের রাজত্ব। নবি মুসা [আ.] বনি ইসরাইলদের অত্যাচারী শাসক ফেরাউন ও মিশরীয় জাতির হাত থেকে মুক্ত করে লোহিত সাগরের পূর্ব পারে সাইনা উপত্যকায় নিয়ে আসলেন।
তুর পাহাড়ের একটি সৌন্দর্যমন্ডিত উপত্যকা ছিলো সাইনা। কিন্তু সেখানে ছিলো খাদ্য ও পানির বড্ড সংকট। নবি মুসা তাঁর অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন লাঠি দিয়ে মাটিতে আঘাত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক গোত্রের জন্য আলাদা আলাদা জলধারা তৈরি হয়ে গেলো। তাদের জন্য অলৌকিকভাবে জান্নাতি সুস্বাদু খাবার মান্না ও সালওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেলো। খাবার ও পানি পেয়ে বনি ইসরাইলরা বেজায় খুশি। তারা সাইনা উপত্যকায় সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো।
নবি মুসা যখন বনি ইসরাইলদের নিয়ে মিশর থেকে সাইনা উপত্যকায় আসেন, তখন তাদের সাথে সামেরি নামক একটি লোকও ছিলো। সেও নবি মুসার ওপর ইমান এনেছিলো। লোকটির নাম ছিলো মুসা ইবনে জাফর। সে ছিলো সামাররা নামের একটি গ্রামের বাসিন্দা। এ জন্য সে সামেরি নামে প্রসিদ্ধ ছিলো।
সামেরি তখন ছোট্ট শিশু। বাবা-মা তাকে নিয়ে সফরে বেরিয়েছিলেন। একটি বিশাল মরুপ্রান্তরে গিয়ে বাবা-মা দু’জনেই মারা গেলেন। মরুভূমিতে সামেরি একা পড়ে রইলো। বড় অসহায়। কোথাও কেউ নেই। চারদিকে শুধু বালু আর বালু। উত্তপ্ত বালু। মরুভূমির সেই উত্তপ্ত বালুতে পড়ে কাতরাচ্ছিলো সামেরি।
ওই রাস্তা দিয়ে তখন যাচ্ছিলেন ফেরেশতা জিবরাইল। নির্জন মরুপ্রান্তরে শিশু সামেরির করুণ আর্তনাদ শুনে তার অন্তরে মায়া হলো। তিনি আল্লাহ পাকের মিনতি করলেন- ‘হে পরম দয়াময়, এই নির্জন মরুতে আর্তনাদ করা নিষ্পাপ শিশুটির লালনপালনের দায়িত্ব আমাকে দান করুন। আমি তার লালনপালন করতে চাই।’ আল্লাহ পাক জিবরাইলকে অনুমতি দিলেন। শিশুটিকে লালনপালন করতে থাকলেন জিবরাইল।
ছোটবেলা থেকেই সামেরি ছিলো প্রচন্ড রকমের চালাক। সে দেখতো জিবরাইল ফেরেশতা মানুষের রূপ ধরে ঘোড়ায় চড়ে তার কাছে আসতেন। সামেরি একটু একটু করে বড় হতে লাগলো। এখন সে অনেক কিছু বুঝে। একদা সে আবিষ্কার করলো জিবরাইল ফেরেশতা যে ঘোড়ায় চড়ে তার কাছে আসেন, সে ঘোড়ায় অলৌকিক কোনো শক্তি আছে। ঘোড়াটি যেখানেই পা ফেলে, সেখানেই শুকনো বালিকণা জীবন্ত হয়ে ওঠে।
তোমরা হয়তো জানো, নবি মুসাকে আল্লাহ পাক আসমানি কিতাব তাওরাত দান করেছিলেন। তখনো নবি মুসার ওপর তাওরাত অবতীর্ণ হয়নি। একদিন নবি মুসা বনি ইসরাইল সম্প্রদায়কে জড়ো করলেন। তাদের উদ্দেশ্যে বললেন ‘হে আমার সম্প্রদায়, মহান আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনে আমি তুর পাহাড়ে যাচ্ছি। সেখানে আমি এক মাস অবস্থান করবো। তোমাদের কাছে আমি আমার ভাই হারুনকে রেখে যাচ্ছি। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত সে তোমাদের তত্ত্বাবধান করবে।’
তারপর তিনি তুর পাহাড়ে চলে গেলেন।
একএক করে তিরিশ দিন কেটে গেলো। কিন্তু মুসা ফিরলেন না। মুসার ফিরতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে বনি ইসরাইলরা অস্থির হয়ে পড়লো। তারা জানতো, কখনোই নবি মুসার কথার নড়চড় হয় না। তাই তারা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। মুসা আদৌ ফিরে আসবেন কি না- এ জাতিয় নানান দুশ্চিন্তা তাদের ওপর ভর করে। বনি ইসরাইলদের দুশ্চিন্তার এই সুযোগকে কাজে লাগায় সামেরি।
বনি ইসরাইলিরা মিশর থেকে সাইনা উপত্যকায় আসার আগে মিশরীয়দের কাছ থেকে যে স্বর্ণালঙ্কারগুলো ধার নিয়েছিলো, তা আর ফেরত দিতে পারেনি। সামেরি বললো- তোমরা মিশর থেকে আসার সময় মিশরীয়দের কাছ থেকে ধারকৃত যে স্বর্ণালঙ্কার ফেরত দিতে পারোনি, ওগুলো দিয়ে তোমাদের জন্য একটি মঙ্গলজনক কাজ করে দেবো।
সামেরি ছিলো মূর্তি ও ভাস্কর্যের কারিগর। বনি ইসরাইলরা তার কথায় স্বর্ণালঙ্কারগুলো এনে তার কাছে জমা দিলো। সে ওগুলোকে আগুনে নিক্ষেপ করে দিলো। আগুনের উত্তাপে গলে যাওয়া স্বর্ণ দিয়ে সে একটি বাছুরের ভাস্কর্য নির্মাণ করলো। বাছুরটির নাম রাখলো বাহমুত। স্বর্ণ দিয়ে গড়া ভাস্কর্যটি ছিলো খুবই সুন্দর। কিন্তু সামেরির বাছুরটি জীবন্ত বাছুরের মতো হাম্বা হাম্বা করতে থাকলো। সামেরির কান্ড দেখে সবাই অবাক হলো। মুগ্ধ হলো।
সামেরি বনি ইসরাইলিদের বললো- তোমরা কি জানো, মুসা কী কারণে ফিরে আসছে না? কারণ মুসা তার প্রভুকে খুঁজে পাচ্ছে না। মুসা তার প্রভুকে খুঁজতে ওইদিকে তুর পাহাড়ে গেছে, আর এদিকে তার প্রভু অবস্থান করছেন এই বাছুরটির ভিতরে।
কয়েক শতাব্দি ধরে বনি ইসরাইলিরা মিশরে দাসত্ব করেছে তো, তাই তাদের মধ্যে কুসংস্কারের রঙ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছে। গরু-পূঁজা ছিলো মিশরীয়দের প্রাচীন বিশ্বাস। তাদের ধর্মে এটা ছিলো বেশ গুরুত্ব ও মর্যাদার কাজ।
নিজ হাতে গড়া বাছুরটির পূঁজা করতে বনি ইসরাইলদের উৎসাহমূলক একটি বক্তব্য দিলো সামেরি। বনি ইসরাইলরা তার কথা বিশ্বাস করে ফেললো। তারা বাছুরটির উপাসনায় লিপ্ত হলো।
তোমরা হয়তো পয়গাম্বর হারুনের নামও শুনতে পারো। তিনিও নবি ছিলেন। তিনি ছিলেন নবি মুসার ভাই। সামেরির কান্ড দেখে তিনি ছুটে এলেন। বনি ইসরাইলদের বাছুরটির উপাসনা করতে নিষেধ করলেন। তিনি বললেন- ‘খবরদার, তোমরা এই বাছুরটির পূঁজা করো না। এটা শিরক। স্পষ্ট শিরক। আল্লাহ পাক তোমাদের উপর অসন্তুষ্ট হবেন। সামেরি তোমাদের পথভ্রষ্ট করছে, তোমরা বুঝতে পারছো না।’
কিন্তু তারা হারুনের কথা মানলো না।
তারা বললো- ‘যতক্ষণ না মুসা ফিরে এসে আমাদের নিষেধ না করেন, ততক্ষণ আমরা এই বাছুরটির উপাসনা করে যাবো।’
তারা হারুনকে প্রত্যাখ্যান করলো। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে তাকে হত্যার হুমকি দিলো।
তোমরা নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছো! সামেরি একজন মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও এমন জঘন্য কাজ কীভাবে করলো? আসলে সামেরি মুসলিম হলেও তার অন্তরে ছিলো পূঁজাপ্রেম। সে ছিলো বাজারমা নামের একটি গোষ্ঠীর সদস্য। তার গোষ্ঠির লোকেরা গরুপূজারি ছিলো। ফলে বাহ্যিকভাবে ইমান আনলেও ভেতরে ভেতরে সে ছিলো গরুপূজারি।
নবি মুসা তখন তুর পাহাড়ে। তিনি আল্লাহ পাকের সাথে কথা বলার জন্য সিয়ামসাধনা করছিলেন। প্রথমে তিনি তিরিশ দিন সিয়ামসাধনা করলেন। তিরিশ দিন পূর্ণ হওয়ার পর যখন আল্লাহ পাকের সাথে কথা বলতে যাবেন, তখন অনুভব করলেন তার মুখ থেকে গন্ধ বেরোচ্ছে, রোজাদারের গন্ধ। তিনি ভাবলেন আল্লাহ পাকের সাথে কথা বলতে যাবো, মুখে এমন গন্ধ নিয়ে গেলে আল্লাহ পাক বেজার হতে পারেন। তিনি দাঁত মাজন করে আল্লাহ পাকের সাথে কথা বলতে গেলেন। আল্লাহ পাক বললেন- ‘হে মুসা, তুমি রোজা ভঙ্গ করলে কেনো?’ মুসা বললেন- ‘হে প্রভু, তিরিশ দিন রোজা রাখার ফলে মুখে গন্ধ করছিলো। আপনি এতে নাখোশ হতে পারেন ভেবে দাঁত মাজন করে এসেছি।’ আল্লাহ বললেন- ‘মুসা, তুমি জানো না রোজাদারের মুখের গন্ধ আমার কাছে মিশকে আম্বরের চেয়েও সুগন্ধি। যাও, তুমি আরো দশ দিন সিয়ামসাধনা করে এসো।’
মুসা আরো দশ দিন সিয়ামসাধনা করে আল্লাহর দরবারে হাজির হলেন। মুসা হাজির হতেই আল্লাহ বললেন ‘হে মুসা, তুমি এসেছো বনি ইসরাইলের জন্য হেদায়াত চাইতে, আর ওইদিকে তারা তোমার অনুপস্থিতিতে সামেরির প্ররোচনার ফাঁদে পড়েছে। তারা বাছুরের পূজায় লিপ্ত হয়েছে।’
নবি মুসা ক্রোধ, লজ্জা ও মর্মবেদনা নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে এলেন। সবাইকে জড়ো করলেন। তাদের উদ্দেশ্যে বললেন- ‘তোমরা এটা কী করলে! আমার এমন কী বিলম্ব হচ্ছিল যে, তোমরা আপদ ঘটিয়ে ফেললে?’ তিনি ক্ষোভে ও ক্রোধে কাঁপছিলেন।
বনি ইসরাইলিরা বললো- আমাদের কোনো দোষ নাই। মিশরীয়দের কাছ থেকে ধারকৃত স্বর্ণালঙ্কারগুলো আমরা সঙ্গে নিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। সামেরি ওগুলো আমাদের কাছ থেকে নিয়ে এই বাছুরের ভাস্কর্যটি বানিয়েছে। সে আমাদের পথভ্রষ্ট করেছে।
নবি মুসার প্রচন্ড রাগ ছিলো। তিনি তার ভাই হারুনের দিকে তেড়ে গেলেন। খামচি মেরে তার চুল ধরলেন। অন্য হাতে ঝাপটি মেরে দাঁড়ি ধরে টানাহেঁচড়া করতে করতে তিনি বললেন- আমি তোমাকে রেখে গেছিলাম আমার অবর্তমানে গোষ্ঠীর লোকদের পথপ্রদর্শন করতে। তুমি কী করছিলে এখানে। তোমার উপস্থিতিতে এমন জঘন্য কান্ড ঘটে গেলো।
হারুন বললেন- হে আমার ভাই, আপনি আমাকে মারতে পারেন। ইচ্ছে হলে আমার মাথার সব চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে পারেন, আমার সকল দাঁড়ি উপড়ে ফেলতে পারেন, আগে আমার কথাটা শুনুন, একটু থামুন। হে আমার মায়ের পুত্র। আপনি বিশ্বাস করুন, আমার কোনোই দোষ ছিলো না, আমি তাদের নিষেধ করেছি, তারা আমার কথায় কোনো পাত্তা দেয়নি, আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, বলেছে আমি যদি এ ব্যাপারে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করি তাহলে আমাকে হত্যা করে ফেলবে। আমি দেখলাম, আমি যদি এ ব্যাপারে আর নাক গলাই, তাহলে পূর্ণ ইমানদার ও প্ররোচিতদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হবে। পরবর্তীতে আপনি আমাকে দোষারোগ করবেন। আপনি বলবেন, আমার অনুপস্থিতিতে তুমি বিভেদ বাঁধিয়েছো। তাই আমি নিরবতাকে গ্রহণ করে নিলাম। আমি আপনার অপেক্ষা করছিলাম। প্রিয় ভাই। আপনি আমার মাথার চুল ধরে টানবেন না। আমার দাঁড়িতেও খামচে ধরবেন না। লোকে হাসাহাসি করবে। অনুগ্রহ করে আপনি শান্ত হোন।
হারুনের এমন যৌক্তিক বক্তব্য শুনে মুসার রাগটা একটু থামলো। মুসা এবার সামেরির দিকে এগিয়ে গেলেন। ধমকের স্বরে সামেরিকে বললেন- হে সামেরি! তুমি এটা কেমন মূর্তি বানালে? সামেরি বললো- আমি এমন একটি বিষয় দেখতে পেরেছি যেটি আর কেউ দেখেনি। আমি দেখেছি ফেরাউন যখন আমাদের তাড়া করেছিলো তখন ফেরাউন এবং বনি ইসরাইলের মধ্যস্থলে জিবরাইল ফেরেশতা ঘোড়া নিয়ে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তার ঘোড়া যেখানেই পা ফেলে, সেখানে প্রতিটি বালিকণা জীবন্ত হয়ে ওঠে। শুকনো মাটিতে গাছের চারা গজিয়ে ওঠে। আমি সেই মাটি সংরক্ষণ করেছিলাম। এই একমুঠো মাটি আমি বাছুরের মূর্তির সাথে সংযোজন করলাম। বাছুরের মধ্যে প্রাণের লক্ষণ সঞ্চারিত হলো। এবং বাছুরটি হাম্বা হাম্বা বলে ডাকতে লাগলো।
নবি মুসা বললেন- তোমার জন্য পৃথিবীতে এমন শাস্তি নির্ধারণ করা হলো, তোমাকে যদি কেউ স্পর্শ করে, তোমার প্রচণ্ড জ্বর উঠবে। তাই কোনো মানুষ তোমার কাছে আসতে দেখলে দৌড়াতে দৌড়াতে বলবে- ‘আমাকে স্পর্শ করো না, আমাকে স্পর্শ করো না।’
আর কিয়ামতের দিনে তোমার মতো পথভ্রষ্টকারীর জন্য আল্লাহ পাক যে শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা অবশ্যই তুমি ভোগ করবে।