সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ইমারতশৈলী ভূমিকম্প সহনীয় আসাম প্যাটার্নের বাড়ি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ জুন ২০২১, ৯:২৬:৫৮ অপরাহ্ন

সাঈদ নোমান
পিলার হিসেবে কাঠের শক্ত খুঁটি। দেয়াল হিসেবে কাঠের ব্যাটন, বাঁশবেতের তরজার (পাটি) উপরে ইট সুরকির আস্তর। এর উপরে সাদা চুনকাম। উপরে টিনের চৌচালার নিচে কাঠের ছাদ এবং ছাদে যাওয়ার জন্য কাঠের সিঁড়ি। বিশুদ্ধ বায়ু প্রবাহের জন্য রয়েছে কাঠের খিলান এবং ভেন্টিলেটর। অধিকাংশ বাড়ির ধরণ ইংরেজি বর্ণ ‘এল’ এবং ‘সি’ আকৃতির। সিলেটের নিজস্ব ঐতিহ্য এসব ইমারত শৈলীর নাম ‘আসাম প্যাটার্ন বাড়ি’।
সিলেট অঞ্চলের প্রবীণ নাগরিকদের মতে, ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের পর (বড় বইছাল) সিলেটের বেশিরভাগ বাড়িঘর আসাম প্যাটার্নে তৈরি করা হয়। ভূমিকম্প সহনীয় ও নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশের নির্মাণশৈলীতে অন্যান্য এসব বাড়ি দেখতে যেমন নয়নাভিরাম বসবাসের জন্যও ছিলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনীয় এবং আরামদায়ক।
স্থপতিদের মতে, ইমারত নির্মাণে আসাম প্যাটার্ন হচ্ছে, ব্রিটিশ শাসনামলে আসাম রাজ্যে বিকশিত একটি নির্মাণশৈলী। এটি আসাম ও সিলেট অঞ্চলে গড়ে উঠে। নির্মিত বাড়িগুলো একতলা হয়। তবে দু’তলাও রয়েছে। বাড়িগুলো ভূমিকম্প এবং অতিবৃষ্টি সহায়ক হিসেবে নির্মিত হয়েছে। কাঠ, বাঁশ বেত, স্টিল এবং কংক্রিট উপকরণে এসব বাড়ি তৈরি করা হয়।
‘আসামি স্টাইল আর্কিটেকচার’ শিরোনামে স্থপতি শাকুর মজিদসহ বিভিন্ন স্থপতিদের আর্টিকেল থেকে জানা যায়, ভারতে ব্রিটিশদের আগমনের আগে, সিলেট ও আসামের ধনী পরিবারগুলো ব্যয়বহুল বাড়িতে বাস করলেও বেশিরভাগ মানুষ বাঁশের খুঁটির সাথে গোবর দিয়ে লেপা মাটির বেড়া এবং ছনের চালের ঘর র্নিমাণ করে বসবাস করতেন। এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ মূল্যায়ণ করে ব্রিটিশ প্রকৌশলীরা যে আকৃতির বিল্ডিংয়ের ডিজাইন ও নির্মাণ করেন সেগুলোই বর্তমানে আসাম-ধরণের ভবন হিসাবে পরিচিত।
টিলা ও সমতল উভয় স্থানেই এসব ভবণ নির্মাণ করা যায়। ভবনগুলো সাধারণত এল বা সি লে আউট হয়। উচ্চভূমিতে সাধারণত আয়তক্ষেত্রাকার হয়। ভারী বৃষ্টিপাত কাটিয়ে উঠার জন্য সাধারণত চৌচালা ছাদ তৈরি করা হয়। দেয়াল কাঠের কাঠামোযুক্ত, সিমেন্ট দিয়ে প্লাস্টার করা হয়। বায়ু চলাচলের জন্য কাঠের খিলান ও ভেন্টিলেটর তৈরি করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট সুরমা নদীর পাড়ে পুরাতন সার্কিট হাউজ, ডিসি অফিস সংলগ্ন জেলা রেজিস্ট্রার ভবন, ধোপাদীঘির পাড় এম এজি ওসমানীর বাসভবন বর্তমানে ওসমানী স্মৃতি যাদুঘর, জিন্দাবাজার রেডক্রিসেন্ট মাতৃমঙ্গল, দরগাহ মহল্লার মোতাওয়াল্লি বাড়ি, মুফতি বাড়ি, পাক্কা বাড়ি, রশিদ মঞ্জিল, কুয়ারপাড় সাধুবাবুর বাড়ি, বিমানবন্দর সড়কের মজুমদারবাড়ি, নয়াসড়ক নওরেজিয়ান খৃষ্টান মিশন, সুবিদবাজার দস্তিদার বাড়ি, এমসি কলেজের হোস্টেল এবং বাংলা বিভাগের ভবন, সিলেট সরকারি পাইলট স্কুলের ভবন, পীর মহল্লা, কুমারপাড়া, নয়াসড়ক, দক্ষিণ সুরমাসহ সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার রণকেলি, ভাদেশ্বর, ফুলবাড়ি ও ঢাকা দক্ষিণে এখনও কিছু বাড়ি রয়েছে। ১শ’ থেকে দেড়শ’ বছরের এসব বাড়ি এখন সিলেটের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
সিলেটের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ চৌধুরী জানান, ১৮৯৭ সালের ১২ জুন সিলেটে যে ভূমিকম্প হয়, সেটা ‘ গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থ কোয়াক’ নামে পরিচিত। ৮ দশমিক ৭ মাত্রার সেই ভয়াবহ ভূমিকম্পে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকার পাকা দালানকোঠার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। মারা যান অনেক মানুষ। ওই ভূমিকম্পের ফলেই সিলেট জুড়ে সৃষ্টি হয় বিশালাকারের হাওর, বিল, জলাশয়ের। এই ভূমিকম্পের পর সিলেট অঞ্চলের বাড়িঘর ও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও অফিস আসাম প্যাটার্নে নির্মাণ করা হয়। সিলেট ভূমিকম্প ও বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে এসব স্থাপনা ছিলো সহনীয়।
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম বলেন, সিলেট ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ার্স এর ৩৫ থেকে ৩৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ১৮৬৯ সালে এবং ১৮৯৭ সালে সিলেটে বড় মাত্রায় দুটি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। প্রথম ভূমিকম্পে গির্জার চূড়া, কাছারী গৃহের দেওয়াল, সার্কিট হাউস বাংলো প্রভৃতি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। এছাড়া, ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে সিলেট শহরের প্রায় সকল পাকাঘর সমতলে মিশে যায়। এই ভূমিকম্পে সিলেট জেলার ৫৪৫ জন মানুষ মারা যান। তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত সিলেট আসামের অংশ ছিল। আসাম প্রদেশের রাজধানী ছিলো শিলংয়ে।
এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলামের মতে, সিলেট অঞ্চলে ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পকে বড় বইছাল বলা হয়। এই ভূমিকম্পের পরে আসাম প্যাটার্নে বাড়িঘর এবং সরকারি স্থাপনা নির্মাণে উৎসাহিত করা হয়। ডেপুটি কমিশনারের অফিস, জেলা প্রশাসক অফিসের ভবন, জেলা জজ আদালতের স্থাপনা ট্রেজারি ভবন ইত্যাদি ভূমিকম্পের পর নির্মাণ করা হয়। যদিও এসব ভবন কোনটি সংস্কার করা হয়েছে এবং কোনটি ভেঙে নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, সিলেট শহর এবং এ অঞ্চলে এখনও দেড়শ’ বছরের আসাম প্যাটার্ন বাড়ি রয়েছে। দক্ষিণ সুরমার জবদলপুর বড়বাড়ির তনজ্জির আলী এবং মনজ্জির আলী চৌধুরী নির্মিত আসাম প্যাটর্নে নির্মিত বাড়িটি এখনও আছে।
জার্মান প্রবাসী শামসুল মজিদ চৌধুরী (সাকী চৌধুরী) সিলেটে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করছেন। তিনি বলেন, আসাম প্যাটার্নের ঘরবাড়ি গুলো ভূমিকম্প ও দুর্যোগ প্রতিরোধক, পরিবেশবান্ধব আর নান্দনিক। এসব বাড়ি সিলেটকে সৌন্দর্য এবং অভিজাত শহর হিসেবে পরিচিত করেছে। এসব বাড়ি ছিল আধা পাকা, কাঠের নল-বর্গা-কড়িকাঠের মাঝখানে ‘নল-খাগড়া-ইকড়া’ ঘাস জাতীয় গুল্ম উদ্ভিদের বেড়ার উপর চুন সুরকির লেপন ও সাদা চুনকাম করা দেয়ালের এবং ঢেউটিনের বা ‘ইস্পল্টু’র চাল বিশিষ্ট।
সাকী চৌধুরী জানান,‘জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে রাইন-বার্গিশ অঞ্চলে ১৬ থেকে ১৯ শতাব্দীর তৈরি বাড়িগুলো দেখতে অবিকল আমাদের সিলেটের ঐতিহ্যগত আসাম টাইপ হেরিটেজ হাউসের মতোই। সিলেটে বাড়িগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে কাঠ, এল প্যাটার্নের লোহার বার আর চুন সুরকি। জার্মানরা ব্যবহার করেছে কাঠ ও কাদামাটির সঙ্গে খড়কুটার মিশ্রণ। ওরা ব্যবহার করেছে টালির চাল আর সিলেটে ব্যবহার করা হয়েছে ঢেউটিন। উভয় ক্ষেত্রেই ঘরবাড়ি পরিবেশ বান্ধব। ভেতরের পরিবেশ শীতে গরম এবং গরমে ঠান্ডা রাখে। উভয় ক্ষেত্রেই কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক কম হয়, বিশেষ করে মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা কম থাকে।
দরগাহ মহল্লার অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার সরেকওম মো. কবির জানান, দরগাহ মোতাওয়াল্লি বাড়ির অনেক ঘর আসাম প্যাটার্নের ছিলো। এখনও আসাম প্যাটার্নের টঙ্গী ঘর রয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণের দত্তরাইল গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব লুৎফুর রহমান চৌধুরী জানান, তার দাদা মোহাম্মদ আলী চৌধুরী আসাম প্যাটার্ন বাড়ি করেছিলেন। এখনও দুটি বাড়ি রয়েছে। তিনি বলেন, ঘরের একেকটি কাঠের খুঁটি দেখে মনে হবে একেকটি আস্ত গাছ কেটে তা বানানো হয়েছে। এছাড়া, টিনের চালার নিচে যে কাঠের ছাদ তৈরি করা হয়েছে একশ’ দেড়শ’ বছরেও কিছু হয়নি। তবে দেওয়ালের ইট সুরকির আস্তরণ কিছু জায়গায় খসে পড়েছিলো। এতে দেখা যায়, ভেতরে বাঁশবেতের তৈরি পাটি বাইরে ইট সুরকি দিয়ে প্লাস্টার করা।