‘সিলেট অঞ্চলে জায়গা-জমি নিয়েই প্রবাসীরা বেশি হয়রানির শিকার হন’
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ জানুয়ারি ২০২১, ৩:৫৬:৩৯ অপরাহ্ন

কাউসার চৌধুরী::
সিলেট অঞ্চলে জায়গা-জমি নিয়েই প্রবাসীরা বেশি হয়রানির শিকার হন। এর বাইরে পারিবারিক বিরোধ, জানমালের নিরাপত্তা ও বাসা-বাড়ি দখল সংক্রান্ত ঝামেলাও রয়েছে। পুলিশের প্রবাসী কল্যাণ সেলে দায়েরকৃত অভিযোগ পর্যালোচনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
পুলিশ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গেলো বছর সিলেট বিভাগে ১১৪ প্রবাসী হয়রানির শিকার হন। এর মধ্যে শুধুমাত্র সিলেট নগরেই হয়রানির শিকার হন ৭৫ প্রবাসী। নগরীতে গেলো বছর প্রবাসী হয়রানি কিছুটা বাড়লেও একই সময়ে সিলেটের ৪ জেলায় হয়রানি কমেছে।
সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহমেদ পিপিএম সিলেটের ডাককে বলেন, প্রবাসী হয়রানি রোধে পুলিশ জিরো টলারেন্সে রয়েছে। এজন্যে সিলেটের ৪ জেলায় প্রবাসী অভিযোগ কমে এসেছে। প্রবাসীদের জন্যে পুলিশ আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলেও জানান তিনি। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গেলো বছর মহানগর পুলিশ (এসএমপি) ও সিলেট রেঞ্জ পুলিশে প্রবাসী সংক্রান্ত ১১৪টি অভিযোগ জমা হয়। ২০১৯ সালে প্রবাসীদের এমন অভিযোগের সংখ্যা ছিল ৯৭। গত বছরের ১১৪টি অভিযোগের মধ্যে এসএমপিতে ৬৪টি ও সিলেট রেঞ্জে ২২টি অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি ২৮টি অভিযোগের কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। এসব অভিযোগের সবকটিই আদালতে চলে গেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, গত বছরের অভিযোগের মধ্যে জায়গা-জমি সংক্রান্ত অভিযোগই ৮৭টি। এসএমপিতে ৬৫টি ও সিলেট রেঞ্জে ২২টি। পারিবারিক বিরোধ সংক্রান্ত অভিযোগের সংখ্যা হচ্ছে ৭টি। এর মধ্যে এসএমপিতে ৫টি ও সিলেট রেঞ্জে ২টি। নিরাপত্তা সংক্রান্ত অভিযোগের সংখ্যা ১০টি। এসএমপিতে ৩টি ও সিলেট রেঞ্জে ৭টি অভিযোগ জানমালের নিরাপত্তার জন্যে দায়ের করেন ১০ প্রবাসী। যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, ইউরোপসহ প্রবাসে থাকা সিলেট বিভাগের প্রবাসীদের কল্যাণের লক্ষ্যেই প্রবাসী কল্যাণ সেল গঠন করে পুলিশ। পুলিশ রেঞ্জের সকল জেলার পুলিশ সুপারের কার্যালয়, সিলেটের ডিআইজির কার্যালয় এবং সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ে প্রবাসী কল্যাণ সেল রয়েছে। প্রতিটি সেলের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা দেখভাল করেন।
এসএমপি সূত্রে জানা গেছে, গেলো বছর করোনাকালে নগর পুলিশের প্রবাসী কল্যাণ সেলে ৭৫টি অভিযোগ দায়ের করা হয়। ২০১৯ সালে এ রকম অভিযোগের সংখ্যা ছিলো ৫৬টি। ২০১৯ সালের তুলনায় গেলো বছর ১৯টি অভিযোগ বেশি দায়ের করা হয়। এই হিসেবে সিলেট নগরে প্রবাসী হয়রানি বেড়েছে। গেলো বছরের ৭৫টি অভিযোগের মধ্যেই বিভিন্নভাবে ৬৪টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়। বাকি ১১টি অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়নি বলে সূত্র জানিয়েছে।
সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি অফিস সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের ৪ জেলায় দায়েরকৃত ৩৯ অভিযোগের মধ্যে সিলেট জেলায়ই ২৭টি অভিযোগ দায়ের করা হয়। সিলেটে জেলার অভিযোগের মধ্যে রয়েছে জায়গা-জমি নিয়ে ১৬টি, নিরাপত্তা সংক্রান্ত ৬টি ও অন্যান্য ৫টি। এর মধ্যে নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে ৭টি, আপোস মীমাংসার মাধ্যমে ৫টি অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়। ৩টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। মোট ১৫টি নিষ্পত্তি হলেও বাকি ১২টি অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়নি। মৌলভীবাজারে জায়গা-জমি নিয়েই ১টি অভিযোগ দায়ের হয় এবং এটি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। একইভাবে হবিগঞ্জ জেলায়ও পারিবারিক বিষয়ে ১টি অভিযোগ দায়ের করা হয় এবং এটিও নিষ্পত্তি করে দেয় পুলিশ। সুনামগঞ্জ জেলায় অভিযোগ দায়ের হয় ১০টি। এর মধ্যে জায়গা-জমি সংক্রান্ত ৫টি, পারিবারিক বিরোধ ১টি, নিরাপত্তা সংক্রান্ত ১টি ও ৩টি অন্যান্য অভিযোগ দায়ের হয়। দুইটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। বাকি অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়ায় আদালতের দ্বারস্থ হন সংশ্লিষ্টরা।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের ডিআইজির অধীনস্থ ৪ জেলায় ২০১৯ সালে মোট ৪১টি অভিযোগ জমা হয়। ২০১৮ সালে অভিযোগের সংখ্যা ছিল ৪১টি। গেলো বছর ৩৯টি অভিযোগ করেন প্রবাসীরা। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সিলেট রেঞ্জ পুলিশের অধীনস্থ ৪ জেলায় প্রবাসী হয়রানি তুলনামূলক কমে এসেছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, প্রবাসীদের অভিযোগের মধ্যে যে সকল অভিযোগ আপোস-নিষ্পত্তি হওয়ার যোগ্য সেগুলো আপোসে নিষ্পত্তি হয়। জায়গা-জমি সংক্রান্ত অভিযোগের নিষ্পত্তি করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। এর ফলে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া বিকল্প উপায় থাকে না।
সুশাসনের জন্যে নাগরিক (সুজন) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী সিলেটের ডাককে বলেন, প্রবাসীরা অর্থ দিয়ে জমি-জমা কেনার পর দেখেন জমির কাগজপত্রে জাল-জালিয়াতিতে ঠাসা। প্রবাসীরা নিকটাত্মীয় কর্তৃকও প্রতারণার শিকার হন। প্রবাসীরা বিদেশে অনেক কষ্ট করে দেশে টাকা পাঠান, জায়গা জমি ক্রয় করেন। অনেক প্রবাসীর সম্পদও বেহাত হয়ে যায়। এজন্যে প্রবাসীদের কল্যাণে প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সিলেটে একটি অফিস স্থাপনের ওপর জোর দেন তিনি।
লন্ডন বাংলা-প্রেসক্লাবের ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট ও লন্ডনের নতুন দিন সম্পাদক মহিব চৌধুরী বলেন, জায়গা জমি কেনার আগে ভালো করে কাগজপত্র দেখলে জালিয়াতির ঘটনা কমবে। কিন্তু, অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কারণ ছাড়াই এক শ্রেণির লোক প্রবাসীদের হয়রানি করেন। সিলেটের পুলিশ প্রবাসীদের পাশে রয়েছে বলে প্রবাসীরাও পুলিশের নিকট যান। প্রবাসীরা পুলিশের সহযোগিতাও পাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
সিলেট নগরে পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপ-কমিশনার বি এম আশরাফ উল্ল্যাহ তাহের বলেন, প্রবাসীদের জন্যে পুলিশ আগের মতোই আন্তরিকভাবে কাজ করে। অভিযোগ পাওয়ার পর পরই ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্রবাসী সেল প্রবাসীদের জন্যে সব সময় উন্মুক্ত। নগরের কোথাও কোনো প্রবাসীর সমস্যা হলে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগের জন্যে তিনি প্রবাসীদের প্রতি অনুরোধ জানান।
সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি অফিসের পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মোঃ জেদান আল মুসা বলেন, প্রবাসী সেলের কর্মকর্তারা সবসময়ই আন্তরিকভাবে কাজ করেন। প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। প্রবাসীদের জন্য প্রবাসী সেল সবসময় প্রস্তুত। পুলিশের আন্তরিকতার কারণেই প্রবাসী হয়রানির সংখ্যা কমছে।
সিলেটের ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ পিপিএম বলেন, প্রবাসী কল্যাণ সেলে অভিযোগ আসা মাত্রই অ্যাকশনে নামে পুলিশ। অনেক অভিযোগ আমরা নিষ্পত্তি করে দেই। আবার অনেক অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থাও নেয়া হয়। তিনি বলেন, দেশে থাকা স্বজনদেরকে তাদের স্বজনের প্রতি আরো আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। প্রবাসীরা শুধু দেশেরই নয় পরিবারেরও প্রাণ। করোনার এই মহামারির সময়ে প্রবাসীদের জন্যে বিশেষ মোনাজাতেরও আহবান জানান তিনি।