সীতাকুন্ড ইকোপার্কে একদিন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুন ২০২২, ৫:১১:৩৩ অপরাহ্ন

চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী
আমাদের দলনেতা জগত চন্দ্র স্যারের অদম্য ইচ্ছে সীতাকুন্ডের সন্নিকটে বারশত ফুট উপরে চন্দ্রনাথ পাহাড়চূড়ে অবস্থিত হিন্দু ধর্মালম্বিদের তীর্থস্থান প্রাচীন চন্দ্রনাথ মন্দির দর্শন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই চন্দ্রনাথ মন্দিরের অনেক নামঢাক শুনেছি, কিন্তু সেখানে পা ফেলার সৌভাগ্য হয়নি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে সীতাকুন্ড বাংলার এক প্রাচীন জনপদ, পশ্চিমে কূলহীন বঙ্গোপসাগর ও পূর্বদিকে সুউচ্চ পর্বতমালার মাঝে সীতাকুন্ড যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে এক অপূর্ব লীলানিকেতন। আমরা সীতাকুন্ডে আসছি জানতে পেরে জগত স্যারের আত্মীয় পূবালী ব্যাংকের ইপিজেড শাখার কর্মকর্তা রবিন কুমার সাহা তাঁর গ্রামের বাড়িতে দুপুরের খাবারে আমাদেরকে নিমন্ত্রণ জানান। সীতাকুন্ডের সেই গ্রামটির নাম জাফরাবাদ, বাংলাদেশের আর দশ গ্রামের মত একটি চিরসবুজ গ্রাম। গাড়ি গ্রামের ছোট রাস্তার মুখে আসতেই একজন সুদর্শন তরুণ আমাদেরকে বরণ করতে আসেন। মায়া মায়া চেহারার এই তরুণকে দেখে ভাবী সে হয়ত সদ্য স্কুল ছেড়ে কলেজে ভর্তি হওয়া একজন ছাত্র হবে। তাঁর বাবা হয়ত আমাদেরকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে ওকে পাঠিয়েছেন। ছোট ছোট বাড়ি, প্রতি বাড়ির সামনে পুকুর। টিনের পাকা পাকা ঘর, গ্রামে বিদ্যুৎ ও গ্যাস রয়েছে। পুরো গ্রামে এক আধুনিক মধ্যবিত্ত জীবনের অবয়ব।
জাফরাবাদের এই ছিমছাম হিন্দু বাড়িতে ঢুকে সোফায় বসতেই পরিচয় পাই পথ প্রদর্শক এই বিনয়ী তরুণটিই আমাদের মেজবান রবিন কুমার সাহা। তাঁর বাবা নেই, ঘরে আছেন চিরলক্ষ্মি মা এবং সদ্য বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসা নববধু নোয়াখালী কন্যা তৃষা সাহা। রবিনের বয়স্কা জননী এবং নববধূ তৃষা সাহা মেহমান সেবায় অতি তৎপর হয়ে যান। অতিথি সেবায় চট্টগ্রামবাসীদের ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন। শরবতের পর ফল, তারপর ডাইনিং টেবিল। সেখানে এলাহি কারবার। চিংড়ি, খাশি, মোরগ, ডিম, রূপচাঁদা, শুটকিভুনা, সাদাভাত ও পোলাও। মনে মনে লজ্জা পেলাম এই ভেবে, রবিনের মা ও বৌকে আমরা ঢাকার মেহমানরা তাহলে অনেক রান্না কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আমি জানতাম চাটগাবাসী মানুষকে খাওয়াতে খুব আনন্দ পান। রবিন সাহার ঘরে তাঁর সত্যতা শতভাগ পেয়ে গেলাম। জাফরাবাদের এই বাড়িতে এসে বুঝলাম রবিনের ঘরে সুখ আছে। ঘরের তিনজন মানুষের সবাই বিনয়ী, সবাই দিলখোলা। আমাদের সাথে তাঁরা ছবি তুলেন। পাশে বসেন। গল্পগোজব করেন। ভাবনাটা এমন, তাঁরা যেন আমাদের অনেক দিনের পরিচিত আপনজন।
সীতাকুন্ডের জাতক রবিন সাহা এখানে আমাদের গাইড। তিনি আমাদেরকে সীতাকুন্ড ইকোপার্কে নিয়ে যান। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে টিলাময় উপত্যকা সুন্দর নৈসর্গিক পরিবেশে এই বড় পার্কের অবস্থান। আমরা টিকেট কেটে গাড়ি নিয়ে পার্কের ভিতরে ঢুকে পড়ি। এই পার্ক হতে চন্দ্রনাথ মন্দিরের দূরত্ব কয়েক মাইল। উচ্চতাও হাজার ফুট পার হবে। আমরা পার্কে সময় নষ্ট না করে গাড়ি নিয়ে মন্দিরের আশায় গাড়ি ছুটালাম। ঘন বনবৃক্ষের আবরণ বেদ করে গাড়ি ধাপে ধাপে উপরে উঠতে থাকে। উপর থেকে উপরে, তারপর আর উপরে, বায়ুর চাপ কমে দুইকানের পর্দা পটপট করছে। জগত স্যার আঙ্গুল কানে ঢুকিয়ে কান বাঁচাতে ব্যস্ত। আমার শ্রবণ শক্তি যেন আর বেড়ে গেল। তিন চার মাইল যাবার পর বন বিভাগের একটি নয়নাভিরাম পর্যটন স্পটে এলাম। এই স্পটে প্রহরীরা আমাদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেন এবং বিনয়ের সাথে জানিয়ে দেন আর যাওয়া যাবেনা। কেন যাওয়া যাবেনা ? জানতে চাইলে তাঁরা বললেন, চন্দ্রনাথ মন্দির এখনও কয়েক মাইল ভিতরে। এই দুর্গম পথ চোর ডাকাতের অভয়ারণ্য। তাই বাৎসরিক পূজা পার্বণ ছাড়া এই রাস্তা দিয়ে কাউকে মন্দিরে যাবার অনুমতি প্রদান করেনা সরকার। সার্বভৌম শক্তিধর সরকার বাহাদুর কি এখানে ব্যর্থ? বলতেই রবিন সাহা জানালো এই জংলাকীর্ণ পাহাড়ে স্থানীয় জংলি ডাকাতরা এত ভয়ংকর যে, সরকার ওদের সাথে পেরে উঠতে পারেনা, জননিরাপত্তায় তাই এই ব্যবস্থা। কি আর করা যায়। জীবনে অনেক শখই অপূর্ণ থেকে যায়। আমি ও জগত স্যারের চন্দ্রনাথ মন্দির জয়ের স্বপ্নীল রথযাত্রা এখানেই থেমে গেল।
উঁচু পাহাড়ে এলোমেলো হাওয়া বইছে। বসন্তের মায়াবী রোদ পাহাড়ি বৃক্ষের পাতায় পাতায় লুকোচুরি খেলছে। চিরসুন্দর এই পাহাড়ি এলাকার মনোরম দৃশ্য দেখতে আমরা গাড়ি ছেড়ে নামলাম। পাহাড়ের ঢালু বেয়ে সিঁড়ির পর সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। আমরা সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করি। ছায়াবৃক্ষের চিরল পাতার ফাঁকে বসন্ত রোদ ঝিকিমিকি করছে। পাখি গাইছে। সুন্দর বিকেল, শতাধিক সিঁড়ি নেমে দেখি পাতালপুরী এখনও-দিল্লি হনজু দূর কাওয়াস্ত। আর নিচে নামলে বেয়ে বেয়ে উপরে উঠে আসা কঠিন হবে। তাই পাতালপুরী না ছুঁয়েই ফিরে এলাম মর্ত্যলোকে পাহাড়ের মাথায়, পাহাড়ি রাস্তায়। এবার ফেরার পালা, গাড়ি নিচে নামছে তো নামছেই। পাহাড়ি ধাপ বেয়ে নামতে নামতে আসরের সময় আমরা সীতাকুন্ড ইকো পার্কে নেমে আসি। সীতাকুন্ড পাহাড়ের পাদদেশে নিম্নধাপের উপত্যকায় প্রাকৃতিক পরিবেশে সীতাকুন্ড ইকোপার্ক। এখানে একটি নৈসর্গিক মঞ্চে সাম্যবাদী কবি কাজি নজরুল ইসলামের বিশাল আকৃতির ম্যুরাল রয়েছে। এই সুরম্য পার্কে ঘুরে ঘুরে আধা ঘন্টা সময় পার করি। পশ্চিমাকাশে তখনও সূর্য জ্বলছে।
এবার আমাদের গুলিয়াখালি সমুদ্র সৈকতে যাবার পালা। এই পার্ক থেকে বেরুতেই সমতল ভূমি। গাড়ি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে অগ্রসর হয়। মহাসড়কের পশ্চিমের একটি গ্রাম্য সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি এগিয়ে যায়। চালকের পাশে আমাদের গাইড রবিন কুমার সাহা। সাগরপারের অন্য দশটা গ্রামের মত এক জনপদে যখন ঢুকি তখন গোধূলিবেলা। রাখালেরা গরুর পাল নিয়ে বাটি ফিরছে। সাগরপারের খালে খালে জোয়ারের পানি নেমে কাদা ছুঁয়ে আছে। রাস্তার দু’পাশে শস্যক্ষেত সবুজে ছেয়ে আছে। ভুল রাস্তায় যাবার কারণে সৈকত বেশ দূরে। গাড়ি নিয়ে সেখানে যাবার সংযোগ নেই, একটি খাল সৈকতের রাস্তা আটকে রেখেছে। দূরে গুলিয়াখালি সৈকতে মানুষের ভীড় দেখা যাচ্ছে। আমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এতদূরে যখন এসে গেছি, রাত হলেও গুলিয়াখালী সৈকত না দেখে যাবনা। সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে বাঁশের সরু সাঁকো বেয়ে খাল পার হলাম। শস্যহীন জমি দিয়ে আমরা যখন গুলিয়াখালী সৈকতের পানে উর্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছি, পর্যটকরা তখন দলে দলে ঘরে ফিরছেন। আমরা যখন সাগরসৈকতে গেলাম, সৈকত তখন প্রায় জনশূন্য। এই সৈকত বাংলাদেশের অন্যান্য সৈকতের মত নয়। এখানে সৈকত জুড়ে ছেয়ে আছে মনগ্রোভ বনের বৃক্ষরাজি। সারাটা সৈকতে ধ্বসে পড়া কবরের গর্তের মত অসংখ্য গর্ত, যেন যুদ্ধকালীন সময়ে সেনাদলের খনন করা বাংকারের সারি ছোট ছোট নালা কেটে কেটে একটার সাথে অন্যটা যেন সংযোগ করে দেয়া। জোয়ারের সময় সবগুলো বাংকার ও ম্যানগ্রোভ বৃক্ষরাজি জলে সাঁতরায়। আবার ভাটার পর জল শুকিয়ে বাংকারগুলোর সাথে সাগরগামী আঁকাবাঁকা নালারা মুখ মেলে। ফাঁকে ফাঁকে সুন্দরবনের নানান প্রজাতির বৃক্ষরাজি কোমরজল হতে বেরিয়ে আসে। বেশ রাত করেই আমরা ফিরলাম চট্টগ্রামের হোটেল হোয়াইট ইনে।