সুবর্ণজয়ন্তির শ্লোগান হোক সর্বস্তরে বাংলা চাই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৫:৩৭:১০ অপরাহ্ন

হাসান শাহরিয়ার
আজ থেকে ৬৯ বছর আগে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যখন তদানীন্তন পূর্ব বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) উত্তাল তখন আমি স্কুলের নিম্নশ্রেণীর ছাত্র। সেদিন প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের পুলিশ প্রতিবাদী ছাত্রদের শোভাযাত্রায় লাগামহীন গুলিবর্ষণ করে, ঝরে পড়ে কয়েকটি তরুণের প্রাণ। সম্ভবত ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথমবারের মতো ঐদিন পুলিশ বেপরোয়া লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণের মাধ্যমে এক ঐতিহাসিক নজির স্থাপন করে। প্রকৃতপক্ষে নুরুল আমিন ছিলেন ঠুঁটো জগন্নাথ। কেন্দ্রিয় পাকিস্তান সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত মুখ্যসচিব আজিজ আহমদই ছিলেন নাটের গুরু। এই পাঞ্জাবি আমলার হুকুমেই চলতো পূর্ব পাকিস্তান। আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ঢাকার নওয়াব বাড়ির উর্দুভাষী ‘খাদিমদার’ খাজা নাজিমউদ্দিন। তিনি জীবনে ঝুঁকি নেননি, রাজনীতিতে সবসসময় নিরাপদ অবস্থানে থেকেছেন। পুর্ব বাংলার বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও তিনি এবং তার ভাই খাজা শাহাবুদ্দিন তাদের জন্মস্থানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তারা বাঙালিদের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের ‘আপন’ মনে করতেন।
পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর মন্ত্রিসভায় আজিজ আহমদ ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। পাকিস্তান গিয়েছিলাম বিতর্কিত নির্বাচন কভার করতে। তখন ইসলামাবাদে তার কক্ষে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হলেন। দেশভাগের পরও তিনি বাঙালি বিদ্বেষী ছিলেন বলেই আমার কাছে মনে হয়েছিল। আমি যখন সম্পদ ভাগাভাগির প্রশ্ন করলাম তিনি তখন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। সাক্ষাৎকার এখানেই শেষ হলো। এটিই ছিল কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে আমার জীবনের সংক্ষিপ্ততম সাক্ষাৎকার।
একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা ছিল এক বিরাট ষড়যন্ত্রের অংশ। পাকিস্তানি শাসকেরা ভাবতো বাংলা হিন্দুদের ভাষা। তাই তারা আমার মায়ের ভাষাকে ধ্বংস করে আমাদের উপর ‘মুসলমানি’ উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চালায়। এমনকি আরবি হরফে বাংলা লেখার দুঃসাহসও দেখায়। কিন্তু বীরের জাতি বাঙালি। পরাজয় কাকে বলে জানে না। পুলিশের গুলিবর্ষণের খবর ছড়িয়ে পড়লো সারা প্রদেশে। জেলা ও মহকুমার স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিবাদ মিছিল, সমাবেশ ও ধর্মঘট পালন করতে শুরু করলো। আমার বাবা আসামের সাবেক এমএলএ মকবুল হোসেন চৌধুরী প্রকাশ্য জনসভায় সুনামগঞ্জ মুসলিম লীগের সভাপতি ও সাধারণ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন। সরকার কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী তলব করলো। কিন্তু কোন কাজ হলো না। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি কারফিউ ভঙ্গ করে প্রতিবাদী ছাত্র-জনতা ঢাকার রাস্তায় নেমে এলো। ভাষা শহীদদের স্মৃতি অমর করে রাখার জন্যে তারা ২৩ ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে একটি শহীদ মিনার গড়ে তুলে। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি সরকার তা ভেঙ্গে দেয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রদেশের সর্বত্র আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে উঠলো। নির্বাচন ঘনিয়ে আসলো এবং স্বাভাবিক কারণেই এটি একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়ালো। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নুরুল আমিনের মুসলিম লীগের ভরাডুবি হলো এবং শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দির নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলো।
গণআন্দোলনকে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না পাকিস্তানি শাসকদের। জনতার কাছে তারা মাথা নত করলো। অবশেষে ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চিহ্নিত হয়। প্রায় সাত দশক পর আজ ভাবছি মায়ের ভাষা বাংলার জন্য যদি সেদিন ঢাকায় ছাত্ররা আত্মাহূতি না দিতো, যদি বাংলার কোটি কোটি জনগণ এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াতো, তাহলে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী আমার ভাষা হারিয়ে যেতো, আমাকে কথা বলতে হতো ধার করে আনা এক ভাষায় যার সঙ্গে আমার পূর্বপুরুষ ও আমার কোনো সংশ্রব নেই, নেই কোনো সাংস্কৃতিক যোগাযোগ।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পাকিস্তান রাষ্টের জন্ম হলে প্রথম গণপরিষদের ভিত্তি ছিল ১৯৪৬ সালের ভারতীয় গণপরিষদের নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং অর্থমন্ত্রী মালিক গোলাম মোহাম্মদের কোনো আসনই ছিল না। জিন্নাহ ও লিয়াকত পশ্চিম পাকিস্তানের শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে সাহায্য না পাওয়ায় ধর্ণা দিলেন পূর্ব বাংলার সদস্যদের। বাংলার ‘উদার’ ও ‘মোসাহেবকারী’ নেতারা ‘নিজের পায়ে কুড়াল মেরে’ লিয়াকত আলী ও গোলাম মোহাম্মদকে নির্বাচিত করালেন। তাদের ‘মহানুভবতায়’ মাওলানা শাব্বির আহমদ ওসমানি, প্রফেসর ইশতিয়াক হোসেন কোরেশী, ড. মাহমুদ হোসেন ও বেগম শায়েস্তা ইকরামুল্লাহও পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত হলেন। পরবর্তীকালে অনেকেই বলেছেন, এটা ছিল খাল কেটে কুমির আনা।
পাকিস্তানের জনক মুহম্মদ আলি জিন্নাহ বাংলার পক্ষে ছিলেন না। তিনি ঢাকা সফরে আসেন ১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ। তখন খাজা নাজিমউদ্দিন পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী। জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কনভোকেশনে এবং রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দানকালে ঘোষণা দেন : ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বক্তৃতার সময় বেশ বিছুটা গোলযোগ হয়েছিলো। পশ্চিম পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণও উর্দুতে কথা বলতো না। সেখানে ছিলো চারটি প্রদেশ: সিন্ধু, পশ্চিম পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান। করাচি ছিলো সিন্ধু প্রদেশ ও পাকিস্তানের ফেডারেল রাজধানি। সেখানকার অধিকাংশ বাসিন্দা ছিলো ভারতীয় মোহাজের। তারা ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে নতুন দেশে বসতি স্থাপন করেছে। এই মোহাজেরদের ভাষা ছিলো উর্দু। ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ২০ লাখ। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৩৭ লাখ। জিন্নাহর এই উক্তি মুখ ফসকে বের হয়ে যায়নি। রাষ্ট্রের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উপর ক্ষুুদ্র একটি অংশের ভাষা চাপিয়ে দেওয়াই ছিল মূল লক্ষ্য। তবে জীবদ্দশায় জিন্নাহ আর এ নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি করেননি। অনেক বাঙালিই মনে করেন, নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টির এক বছরের মাথায় রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জিন্নাহর অবাস্তব ঘোষণার পর থেকেই পাকিস্তানের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। দীর্ঘ ২৩ বছর পর সে ভিত ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।
এক পাকিস্তানের কাঠামোয় উর্দুর সঙ্গে বাংলাও রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেলো। জাতীয় পরিষদে বাঙালি সদস্যগণ বাংলায় ভাষণ দিতে পারতেন, পোস্টকার্ডÑএনভেলাপ ও টাকার নোটে বাংলা অন্তর্ভুক্ত হলো। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকাণ্ডে বাংলার কোনো স্থান ছিল না, সেখানে ইংরেজি ও উর্দুর প্রধান্য অব্যাহত থাকল। পশ্চিম পাকিস্তান বা কেন্দ্রীয় প্রশাসনে বাংলা বরাবরই অবহেলিত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের স্কুলে উর্দু পড়ানো হতো, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে গোনা দু’তিনটি বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোনো স্কুলে বাংলা শেখানো হতো না। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও উর্দু বুঝতো, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষিতরাও বাংলা জানত না। জিন্নাহ বলেছিলেন, বাংলা একটি প্রাদেশিক সরকারি ভাষা। তার মৃত্যুর কয়েক বছর পর যখন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হলো, তখনও বাহ্যত তা পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশেই সীমাবদ্ধ থাকল, সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রভাষার পূর্ণ মর্যাদা পেল না। এই নিয়ে বাঙালি নেতাদের মধ্যে তেমন কোনো ক্ষোভ দেখিনি। তবে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ বরাবরই বাংলাকে ব্যবহারিক রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছে।
পট পরিবর্তন হয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর। স্বাভাবিকভাইে বাংলা হলো দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সরকারি অফিস-আদালতের দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে ১৯৭৫ সালের ১২ই মার্চ সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে। এই আইন চালু হওয়ায় সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বাংলায় নথি লেখা শুরু করে। আজও তা অব্যাহত আছে। এই আইনের ৩(১) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। একই সঙ্গে ধারা ৩(৩)-এ বলা হয়েছে, যদি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন তাহলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধির অধীনে অসদাচরণ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং তার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সরকারি কর্মকর্তা জানান, এই আইন প্রবর্তনের পর থেকেই সব আইনি ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বাংলা ভাষায় করা হচ্ছে। তবে নিম্ন আদালতে মামলার কার্যক্রম বাংলায় হলেও উচ্চ আদালতে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুপ্রীম কোর্টের রায় বাংলায় লেখার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘যে ভাষা আমরা সবাই বুঝতে পারি, সেই ভাষায় [রায়] লেখা উচিত।’
আবার ফিরে এসেছে ভাষামাস ফেব্রুয়ারি। শুরু হয়েছে পুরনো কাসুন্দি। দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতা ও তাদের চেলা এবং আমলা, কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্বিজীবি সর্বস্তরে বাংলা চালু করার জন্য জাবর কাটছেন। সেই ’৫২ সাল থেকেই তারা একই কথা বলে আসছেন। কোনো কোনো বিগদ্ধ ব্যক্তি বলেন, আজও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়নি। ফেব্রুয়ারি মাস জুড়েই এই আলোচনা চলে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। ভাষা আন্দোলনের প্রত্যাশা কেনো পূরণ হয়নি তা নিয়ে খুব একটা যুক্তিতর্ক হয় না। সুদীর্ঘ ৫০ বছরে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হওয়া উচিৎ ছিল। এজন্য প্রয়োজন আগ্রহ ও উদ্যম। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করে অচিরেই একাজে হাত দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তির শ্লোগান হোক : চাই সর্বস্তরে বাংলা।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমেরিটাস, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (সিজেএ)।