সেকালের সিলেট শহর
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ এপ্রিল ২০২১, ৫:১১:২৫ অপরাহ্ন

মৃণাল কান্তি দে
(পূর্ব প্রকাশের পর)
বৃটিশ আমলে শহরে একমাত্র সরকারি হাসপাতাল ছিলো মাদ্রাসা মাঠের দক্ষিণে অবস্থিত বর্তমান শহীদ সামসুদ্দিন হাসপাতাল। সেখানে বহির্বিভাগে রোগী দেখা হতো। ওষুধ দেয়া হতো হাসপাতাল থেকে। ডাক্তারগণ হাসপাতালের বাইরে রোগী দেখতে পারতেন না। হাসপাতালে বেশ কয়েকজন নার্স ছিলেন ইটালীয়ান। তারা কথা বলতো বাংলায়। সরকারি খামার থেকে উৎপাদিত দুধ দেয়া হতো রোগীদের।
১৯৩৬ সালে শহরের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা নদীতে নির্মিত হয় সেতু। তখনকার আসামের গভর্নরের নামানুসারে সেতুর নামকরণ হয় ক্বীন ব্রিজ। সেকালে সুরমা নদী গভীর ও স্রোতস্বিনী ছিলো। বৃটিশ মালিকানার জাহাজ এই নদীতে যাতায়াত করতো। কালিঘাটে আমজদ আলী রোডে ছিলো জাহাজ কোম্পানীর প্রতিষ্ঠান। তখন সড়কপথ উন্নত ছিলো না। রেলপথ তৈরি হলেও নৌপথেই বেশী মালামাল পরিবহন করা হতো। যাত্রী চলাচলও করতো বেশী নৌপথে। সুরমা নদীতে তখন লঞ্চ চলাচলও করতো। খেয়া নৌকায় নদী পারাপারের সুবিধার্থে ক্বীন ব্রিজের পাশেই সুরমা নদীতে ৩২ সিঁড়ির একটি ঘাট নির্মাণ করেন তখনকার পৃথ্বিমপাশার জমিদার আলী আমজাদ। চাঁদনীঘাট নামের এই ঘাটের মাধ্যমে ১৯১৯ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খেয়া নৌকায় নদী পারাপার হন। এই ঘাটের মাধ্যমে তখন ফেরি নৌকায় যাত্রীরা দূর দূরান্তের গন্তব্যে যাতায়াত করতো। তখন এই ঘাটের সঙ্গে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক পথে যোগাযোগ সহজ ছিলো। সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্য সেই সময় সার্কিট হাউসের সামনে সুরমা নদীতে একটি স্টিমার নোঙ্গর করা থাকতো সব সময়। সুরমা নদীর তীরে শুধুমাত্র দু’টি বাজারই ছিলো- কালিঘাট ও কাজিরবাজার। যাত্রীবাহী ছাউনী নৌকাও সুরমার দুই তীরে নোঙ্গর করা থাকতো অনেকগুলো। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নারকেল বোঝাই বিশাল নৌকাও ভিড়তো নদীর উত্তর তীরে। নৌকায়ই বিক্রি হতো নারকেল।
সুরমা নদীতে ক্বীনব্রিজ নির্মাণের পর জনসাধারণের কাছ থেকে প্রতিবার পারাপারের জন্য জনপ্রতি এক পয়সা করে টোল আদায় করা হতো। যানবাহনের জন্যও ছিলো বিভিন্ন হারে টোল আদায়ের বিধান। গবাদি পশু পারাপারেও দিতে হতো টোল। অবশ্য চার বছর পর ১৯৪০ সালে এই প্রথা বাতিল হয়ে যায়। সেকালে সময় নির্ধারণের জন্য ঘড়ির প্রচলন হলেও হাতে গোনা কিছু মানুষের হাতে থাকতো ঘড়ি। বাসাবাড়িতেও দেয়াল ঘড়ি বা টেবিলঘড়ি ছিলো খুবই কম। ১৮৭৪ সালে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার পৃথ্বিমপাশার জমিদার আলী আমজাদ সুরমা নদীর উত্তর তীরে চাঁদনীঘাটের পাশেই স্থাপন করেন বিশালাকায় একটি ঘড়ি। এই ঘড়িটি তখন পথচারী ও শহরবাসীকে সময় বলে দিতো। প্রতি ঘন্টায় ঘড়ির ঘন্টাধ্বনি আকৃষ্ট করতো সকলকে।
বৃটিশ আমলে বিশ্বখ্যাত যাদুশিল্পী পি.সি সরকার সিলেটে আসেন। শহরে কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং যাদু প্রদর্শন করেন। বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শংকরও সিলেটে এসেছিলেন এবং কয়েকদিন অবস্থান করেছিলেন, নৃত্যানুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। বরিশালের বিখ্যাত গায়ক মুকুন্দ দাসও সিলেট শহরে কয়েকটি অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন। বিপুল সংখ্যক দর্শক শ্রোতার সমাগম হতো সেই সব অনুষ্ঠানে। এছাড়া যাত্রানুষ্ঠানও হতো মাঝেমধ্যে। বিশেষ করে বরিশাল থেকে আগত যাত্রাদল শহরের বিভিন্ন স্থানে যাত্রা পরিবেশন করতো। সেকালে রেডিও আবিস্কৃত হলেও দু’য়েকজনের ঘরে ছিলো এই রেডিও। সবার সামর্থ্য ছিলো না রেডিও কেনার।
ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুবাদে অনেক বিদেশী অবস্থান করতো তখন সিলেট শহরে। এর মধ্যে ছিলো নেপালী। বিভিন্ন মহল্লায় বসবাস করতো অনেক নেপালী। এদের অনেকে করতো দুধের ব্যবসা। তাদের ছিলো নিজস্ব খামার। তারা গরুর খাবার সংগ্রহ করতো শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন এলাকা থেকে। এগুলো নিজেরা মাথায় করে পায়ে হেঁটে তারা নিয়ে আসতো নিজেদের খামারে। তারা নিজেরাই দুধ বাসায় বাসায় পৌঁছাতো। তাদের অনেকে ব্যাংকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দারোয়ানের চাকরি করতো। তারা একদিকে ছিলো যেমন পরিশ্রমী, তেমনি ছিলো সৎ ও বিশ্বাসী।
সেকালে সিলেট শহরে ছিলো বেশ কয়েকটি ব্যাংক। যেগুলো প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। এর মধ্যে রয়েছে নিউমার্কেটে সিলেট কমার্শিয়াল ব্যাংক, দাশ ব্যাংক, ধোপাদিঘীর পারে সুরমা ভ্যালি ব্যাংক, ত্রিপুরা মডার্ণ ব্যাংক, স্ট্যান্ডার ব্যাংক, জিন্দাবাজারে লোন ব্যাংক। ব্যাংকগুলোতে অর্থের লেনদেন ছিলো কম। বেশীর ভাগ মানুষেরই ছিলো না ব্যাংক একাউন্ট। কোন কোন সময় একশ’ টাকার নোট ভাঙানোও কঠিন হয়ে পড়তো। ভাঙাতে হতো বড় কোন ব্যবসায়ী কিংবা ট্রেজারি থেকে। সে সময় বৃটিশ রাজাদের চিত্রযুক্ত তামা ধাতুর তৈরি পাই পয়সা, আধা পয়সা, এক পয়সার প্রচলন ছিলো। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে টাকার লেনদেন বেড়ে যায়। দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা ছিলো বেশী। কৃষকগণ উৎপাদিত ফসল স্বল্পমূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হতেন।
সেকালে শহরে ছাপাখানা ছিলো হাতে গোনা। যেমন-জিন্দাবাজার শক্তিপ্রেস, মির্জাজাঙ্গাল কোটিচাঁদ প্রেস, ধোপাদিঘীর পার সুরমা ভ্যালী প্রেস, লালবাজার ও লালদিঘীর পারে আরও দু’টি প্রেস ছিলো। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে স্থাপিত এইসব প্রেসে সিসার তৈরি বর্ণ দিয়ে হাতে চালানো মেশিনে ছাপার কাজ করা হতো।
শিক্ষার্থীদের বইপত্র কেনার জন্য তখন ছিলো বন্দরবাজার চন্দ্রনাথ লাইব্রেরি, লালদিঘীরপার আর্ল লাইব্রেরি, মহাজনপট্টি কোটিচাঁদ লাইব্রেরি। এছাড়া বন্দরবাজার পয়েন্টে ছিলো শিক্ষাসামগ্রীর বিক্রেতা ছাত্রবন্ধু স্টোর। তখনকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিলো গভর্ণমেন্ট হাইস্কুল, রাজা জি.সি হাইস্কুল, গভর্ণমেন্ট গার্লস হাইস্কুল, এইডেড হাইস্কুল, রসময় হাইস্কুল, মডেল হাইস্কুল, এমসি কলেজ এবং মদন মোহন কলেজ। তখন হাইস্কুলের শেষ পরীক্ষা ছিলো মেট্রিক। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এই পরীক্ষা দিতে হতো। তখন পাসের হার ছিলো খুবই কম। পরীক্ষা হতো দশটি বিষয়ে। এর মধ্যে ভারতীয় ইতিহাস ও ইংল্যান্ডের ইতিহাস নামে দু’টি বিষয় ছিলো। পাসের বিভাগ ছিলো তিনটি। ৮০% ছিলো স্টারমার্ক। আর প্রথম বিভাগে পাসের নম্বর ছিলো ৬০%, দ্বিতীয় বিভাগে ৪৫% এবং তৃতীয় বিভাগে ৩৩%।
শহরের গোবিন্দপার্কের তিন দিকে রাস্তার পাশে ছিলো ‘বোল’ নামক চার পাঁচটি বৃক্ষ। উত্তরদিকে পার্ক সংলগ্ন সড়কপথে ত্রিমোহনায় একটি পাকা বড় কূপ ছিলো। এখানে জনসাধারণের যাতায়াতের জন্য ছিলো ট্যাক্সিস্ট্যান্ড। মোটরযান চালাতে পেট্রোল ও পানি এই দু’টি তরল পদার্থের প্রয়োজন হতো তখন। কমস্পিডের টেক্সির প্রচলন ছিলো শহরে। প্রথমদিকে এইসব যানবাহন শুধুমাত্র ধনী, জমিদাররা ব্যবহার করতেন। সরকারি কাজেও ব্যবহার করা হতো। পরবর্তীতে ফোর্ড, বেডফোর্ড ইত্যাদি কোম্পানীর টেক্সি শহরে যাতায়াত শুরু হয়। তবে সংখ্যায় ছিলো কম। তখন জনসাধারণের যাতায়াতের জন্য সার্ভিস বাস বা গণপরিবহন চালু হয় দু’য়েকটা। এগুলো শহর থেকে দূরবর্তী বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল করতো। তখন সিলেট শহরের সাথে তখনকার মহকুমা শহরগুলোর সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হলেও সেটা ছিলো মাটির সড়ক। মালামাল বহনের জন্য কয়েকটি ট্রাকও চলাচল করতো। মোটর সাইকেল চলতো শহরে হাতে গোনা কয়েকটি। ইটালীর তৈরি এসব মোটর সাইকেল ছিলো ভারী যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি। রাস্তায় চলাচলের সময় আওয়াজ হতো জোরে। যানবাহন মেরামতের জন্য একটি মাত্র গ্যারেজ ছিলো চালিবন্দর রাস্তার দক্ষিণে। পরে শিবগঞ্জ মাছবাজারের পেছনে আরেকটি গ্যারেজ স্থাপিত হয়। তখন বিত্তশালীরা ঘোড়ায় টানা টমটম গাড়িতে চলাচল করতেন শহরে।
বৃটিশ আমলে প্ল্যাস্টিকের দ্রব্যের ব্যবহার ছিলো না। স্টিল, টিন, চামড়ার তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হতো। যেমন- ট্রাংক, স্যুটকেস, বালতি, জগ, মগ ইত্যাদি। মহিষের শিং দিয়ে তৈরি চিরুনী ব্যবহার করা হতো সব পরিবারে। বর্তমানে এইসব দ্রব্য আর দেখা যায় না।
সেকালে নিরিবিলি এই শহরে মানুষের ঘুম ভাঙ্গতো নানা ধরনের পাখীর গান শুনে। শহরের আশপাশ ছিলো বনজঙ্গলে ঘেরা। এতে নানা ধরণের বন্য প্রাণীর উপদ্রব ছিলো। সন্ধ্যা হলেই শহরের প্রায় সবস্থানেই শোনা যেতো শিয়ালের ডাক। মাঝে মাঝে দিনের বেলায়ও জনপদে দেখা যেতো এদের। গৃহপালিত হাঁসমুরগী ধরে নিতো এগুলো। শীত মওসুমে শীতের দাপটে দূরবর্তী পাহাড় থেকে দু’য়েকটা বাঘ নেমে এসে শহরের পার্শ্ববর্তী টিলা বা সমতলে বনজঙ্গলে আশ্রয় নিতো। গভীর রাতে শোনা যেতো বাঘের ডাক। ৪০ এর দশকে শহরের পার্শ্ববর্তী তারাপুর চা বাগান এবং দলদলি চা বাগানের কাছাকাছি দু’টি বাঘ আটকে যায় জালে। তখন এগুলো সরকারের আইন অনুযায়ী গুলি করে মারা হয়। ১৯৫০ সালের শেষের দিকে সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরে কুচাই ইউনিয়নের গোলাপগঞ্জ রাস্তার পাশে এক ঝোপের মধ্যে বাঘের সন্ধান মেলে। জনগণ জালের মাধ্যমে এটিকে আটকিয়ে ফেলে। এই বাঘটিকেও জনসমক্ষে গুলি করে মারা হয়।
সেকালে এই অঞ্চলের চা বাগানগুলোতে বেশীর ভাগ ম্যানেজার ছিলেন বৃটিশ নাগরিক। প্রতিদিন বিকেলে এরা টেক্সি বা জীপে করে পরিবারসহ শহরের স্টেশন ক্লাবে আসতেন। এখানে টেনিসসহ নানা ধরণের খেলাধূলা হতো। আবার রাতেই তারা চলে যেতেন নিজ নিজ বাগানে। তখন শহরে পেট্রোল পাম্প ছিলো হাতে গোনা। ডিসি অফিসের দক্ষিণ দিকে একটি, জিন্দাবাজারে, বন্দরবাজারে, জেলরোডে, শিবগঞ্জে একটি করে এবং সুরমার দক্ষিণ পারে দু’টি পেট্রোল পাম্প ছিলো। ৪০ এর দশকেই শহরে পৌরসভার অনুমোদন নিয়ে সাইকেল রিক্সার চলাচল শুরু হয়। অবাঙালিদের মালিকানায় গরুর গাড়ি চলাচল করতো শহরে। এই সব গাড়িতে বিভিন্ন ধরনের পণ্য পরিবহন করা হতো।
সময়ের সঙ্গে পাল্টে যায় সবকিছু। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। এক সময়ের ছোট্ট একটি গ্রামীণ আবহের শহর সিলেট এখন একটি বৃহত্তম মেট্রোপলিটন সিটি। এর আয়তন, জনসংখ্যা, চাকচিক্য বাড়ছে। কিন্তু দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে সিলেট শহর পৌঁছেছে এই পর্যায়ে। এই অভিযাত্রার বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে রয়েছে ইতিহাস; যা আগামীর পথে এগিয়ে যাওয়ার পাথেয়।
অনুলিখন ঃ আবদুস সবুর মাখন।