সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ঐতিহ্য ও শিল্পরূপ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জুন ২০২২, ৯:১৭:২৮ অপরাহ্ন

নাসরীন জেবিন
সেলিনা হোসেন তাঁর সৃজনসৌকর্যের মৌলিকতায় বাংলা আধুনিক সাহিত্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন। অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা ও লড়াকু জীবনের অনুসন্ধান আজীবন তাঁর সাহিত্যভান্ডার সমৃদ্ধ করেছে। ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন সংস্কারমুক্ত একজন মানুষ। মানুষের মঙ্গল চেতনায় তাঁর সাহসী জীবনবোধে মানবিকতাকে সবার আগে স্থান দিয়েছেন। প্রতিটি উপন্যাস যেমন বিষয়ের বৈচিত্র্যে আমাদের মুগ্ধ করে, তেমনি তা রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যেও স্বতন্ত্র মাত্রা যোগ করেছে।
সেলিনা হোসেনের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ (১৯৭৬) আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করেছে। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসের উপকরণ ছিল মুক্তিযুদ্ধকাল। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে আমরা হলদিগ্রামের বুড়ি এবং গ্রামের সমস্ত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা উজ্জীবিত হতে দেখেছি। এ উপন্যাসটি শুধু যে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত হয়েছে, তা নয়। নারীর ক্ষমতায়নের একটি বড় মাধ্যম হিসেবেও রচিত হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যার পৈশাচিকতা যেভাবে রক্তাক্ত করেছে বাংলার জনপদ তারই প্রতিবাদে সমগ্র জাতি প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল। নদীতে আমরা হাঙরকে যেভাবে দেখি সমস্ত জলজ প্রাণীর জন্য আতঙ্কস্বরূপ, তেমনি গ্রেনেডও মানুষের জীবনের জন্য আতঙ্ক আর ভয়াবহতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
কিশোরী বুড়ি জীবন ও জগৎকে দেখতে চায় অসীম কৌতূহল নিয়ে। শৈশবে নিজের নাম নিয়ে ছিল তার প্রতিবাদ-মর্যাদাশীল আত্মিক সত্তাবোধের কাছে সে ছিল আপসহীন। গ্রামের পাশ দিয়ে ছুটে চলা ট্রেন কোনো সীমানায় পৌঁছায় তা জানার কৌতূহল থেকে সে ট্রেনে চড়ে বসে। সে স্বপ্নডানায় চড়ে যেন চলে যেতে চায় দূর সীমানায়। লেখক সেলিনা হোসেন বুড়ির মানসিক মনোবৃত্তিকে উন্মোচন করেছেন গভীর মমতায়- ‘হলদি গাঁয়ের এ বাড়ি থেকে আর কোথাও যাবার সুযোগ হয়নি ওর। পশ্চিমে স্টেশনে যাবার বড় রাস্তা। পূর্বে খালের ধার। উত্তর দক্ষিণে মাঠের পর মাঠ, এর বাইরে কি আছে বুড়ি জানে না।’
যুদ্ধের আগুন হলদি গ্রামে এসে পড়েছে। স্বাধীনতা শব্দটি বুড়ির কাছে নতুন। চারপাশের মিছিল-মিটিং। বুড়ি কাচারি ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখে, দুর্বার গতিতে স্বাধীনতাকামী মানুষ বলে- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সবার মুখে মুখে বুড়ি একটি নামই শোনে- শেখ মুজিবুর রহমান।
এ উপন্যাসে লেখক মানবিক চেতনা সমুন্নত রেখে ত্যাগধর্মী জীবনবোধের জয়কে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। আর যুগে যুগে এভাবেই আমাদের অর্জন অভিনন্দিত হয়েছে। বৈশ্বিক রাজনীতির সঙ্গে আমরা স্বীকার হই নানা ষড়যন্ত্রের। তাই মুক্তির পূর্বশর্ত যুদ্ধ এ বোধই আমাদের আত্মপ্রত্যয়ী করে রাখে। সম্প্রীতির চির বন্ধনকে সমুন্নত রাখতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করেছে বাংলার দুঃখী মানুষ। দায়িত্ববোধ আর সম্প্রীতির এক অনন্য দলিল ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’।
সেলিনা হোসেনের ‘জলোচ্ছ্বাস’ (১৯৭৩) উপন্যাসটির নামকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে বাঙালির জনজীবনের ঐতিহ্যিক পটভূমি। যেখানে ধীর-শান্ত নিরবধি গ্রামবাংলার প্রকৃতি বয়ে যায় নিস্তরঙ্গভাবে। প্রকৃতির সঙ্গে আত্মার বন্ধনের সংযোগে যে সরলীকৃত জীবন সে শান্ত জীবনের জনপদ আচমকা প্রকৃতির আকস্মিক আঘাতে এক সময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ছুটে চলা জলোচ্ছ্বাস মানুষের জীবন স্বপ্ন মুছে দেয়- সেই চির শান্ত প্রকৃতিই হয়ে ওঠে বিষণ্ণ ও আতঙ্কিত এক জনপদ। এক রাতের জলোচ্ছ্বাস মানুষের সাধের সংসারে রেখে যায় দগ্ধ জীবন-যন্ত্রণা। বঙ্গোপসাগরের হৃদয়হীন তা ব সোনার মানুষের সোনার সংসার নিঃশেষ করে দেয়। চির দুঃখের সংসার চোখের জলে নদী হয়ে যায়। লেখক তাকে চিহ্নিত করেছেন এভাবে-
‘জীবন আর মৃত্যু এখানে একই মিছিলের সাথি। বেঁচে থাকার কঠোর সংগ্রাম ওলটপালট হয়ে গিয়ে রূপ নেয় মরণ বিজয়ী সংগ্রামে। জীবনকে ছিনিয়ে আনতে হয় সাগরের থাবা থেকে। আবার তুলতে হয় পাতার কুটির। অন্যদিকে প্রস্তুত হতে হয় নতুনতর আক্রমণের জন্য কখন আবার এসে যাবে শত্রু। যাকে ওরা বলে গোরকী।’ -(জলোচ্ছ্বাস)
-তবুও থেকে থাকে না জীবন। মানুষ জীবনকে ভালোবেসে আবার এগিয়ে যায়। ওঠে সূর্য, জোনাকির আলো স্বপ্ন বুনে দেয় আবার জীবনে। রোদ ঝলমল করে হেসে ওঠে-ভুলিয়ে দেয় বিগত মুহূর্তের প্রাকৃতিক তা ব। মানুষের কাঁপন তোলা হূৎপি আবারও অমাবস্যার চাঁদ হয়ে হাসে। আশান্বিত হতভাগা মানুষ আবার ফিরে তাকায় জীবনের দিকে। ঘর বাঁধে, ফসল বোনে, সারারাত আরক্ত চোখে নদীবক্ষে রূপালি ইলিশ ধরে। স্বপ্ন যদি ছেড়েছে তাদের আবার নতুন স্বপ্নকে আলিঙ্গন করেছে তারা। নিম্নবিত্তের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেন জীবনের অনিবার্য বিয়োগপত্র ঝেড়ে ফেলে আবার সংসার পাতে। আকস্মিক জলোচ্ছ্বাস যেন দরিদ্র মানুষের রক্তমাখা নদী পার হয়ে সাফল্যের এক পৃথিবী গল্প শুনিয়ে যায়। ‘জলোচ্ছ্বাস’ উপন্যাস যেন মানব সৃষ্টির শরীরকে নতুন পথের সন্ধান দেয়। ডানা মেলে উড়তে শেখায় জীবন সাফল্যের নতুন দিগন্তে। যন্ত্রণাদগ্ধ জীবনের দুঃখ ভুলে মানুষ কীভাবে আবার বাঁচতে শেখে সে গল্পটি লেখক আমাদের বলে যান। মানুষের চির-দুঃখের ঘর-গৃহস্থালি যেন জীবনেরই অংশ হয়ে যায়। প্রকৃতি শত অভিমান নিয়ে আছড়ে পড়ে চির সাধের সংসারে। ঘরের চাল উড়ে যায়, উড়ে যায় গোয়ালঘরের গরু, সময়ের সাথে সাথে এ দগ্ধ মানুষই আবার প্রকৃতির বুকে নতুন বসত গড়ে সম্প্রীতির বন্ধনে এক হয়।
ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের অনুসন্ধিৎসু জীবন জিজ্ঞাসা ইতিহাস ঐতিহ্যের শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ। সমাজ সত্যের অনুসন্ধানই তাঁর চেতনালোককে জীবন সত্যের মুখোমুখি করেছে। ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ (১৯৮৬) সালে প্রকাশিত হয়। সেলিনা হোসেন তাঁর এ রচনায় নাফ নদীর তীরের সাহসী লড়াকু স্বপ্নতাড়িত জনগোষ্ঠীর জীবনধারা তুলে ধরেছেন। অসীম সাহস, লড়াকু জীবন, স্বপ্নচারী ও প্রেমময় মানুষ প্রবহমান নদীর মতোই ভৌগোলিক সীমা পেরিয়ে যেন বুনে যায় স্বপ্ন। যে স্বপ্ন রামধনু পাখা মেলে উড়ে চলে জীবনের সাথে জীবনযোগে। যে স্বপ্নে মাঝে দাবানলের তীক্ষ্ণ ঘুড়িওয়ালা দুপুর এসে বিষাদের গান শুনিয়ে যায় না-শুনিয়ে যায় নতুন জীবন স্বপ্নের স্বর্ণখচিত ইতিহাস। সেলিনা হোসেনের ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ উপন্যাস দক্ষিণপূর্ব বাংলার সমুদ্র সংলগ্ন জীবনের অস্তিত্ব সংকট সংবলিত উপন্যাস। সেলিনা হোসেনের অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ আঞ্চলিকতার জারক রসে সিক্ত হয়েছে। ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের ওপর রচিত উপন্যাস। ঐতিহাসিক চরিত্র ইলা মিত্রের সাহসী জীবনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, ব্যর্থতায়-সফলতায় ঐশ্বর্যমি ত এক একটা মানুষ। যারা লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে জীবন জয়ের ইতিহাসকে স্পর্শ করে। সময়ের পাঁজরে দুঃখের আগুনে পোড়া ভালোবাসার নুড়ি পাথর এসব মানুষ। যাদের স্বপ্নসাধে জড়িয়ে আছে নক্ষত্রলোকের জীবনের সাধ।
‘যুদ্ধ’ উপন্যাসে সেলিনা হোসেন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্তরকে ধারণ করেছেন। এ উপন্যাসে আলাদা করে কোনো কাহিনি নেই কিন্তু প্রতিটি চরিত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেছে। লেখক একটি সেক্টরের যুদ্ধকে উপাত্ত করে বাংলাদেশের অগণিত মানুষের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার চিত্রকে আলাদা মাত্রায় তুলে এনেছেন। ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসে একটি মূল্যবান চরিত্র আছে যার নাম নেই। অথচ এ চরিত্রটি উপন্যাসের মূল প্রেরণা শক্তি। এ চরিত্রটি যুদ্ধের সময় পুরোদেশ ঘুরে বেড়িয়েছে।
তারামন মুক্ত স্বাধীন সত্তার অধিকারী। প্রকৃতির মুক্ত জমিন, ব্রহ্মপুত্র ওকে মুক্ত জীবনের ইশারা দিয়ে যায়। বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে বাবা এসেছে তাকে বাড়ি নিতে। প্রতিবন্ধী স্বামী তাকে তালাক দিয়েছে। এ বন্দি জীবনে আত্মার আনন্দে সে আজ আত্মহারা। এ আনন্দ লেখক প্রকাশ করেছেন এভাবে-
‘নিজের বাড়ি ফিরে যাবার আনন্দে একটি শাড়ি ও দুটি ব্লাউজের ছোট পুঁটলিটা উপরে ছোড়ে আর দু’হাতে ধরে।’-(যুদ্ধ)
তারামনের দেখার দৃষ্টি আর চেতনা জগৎ আলাদা সেখানে স্বাধীনতা আর মুক্তি ছাড়া কিছু নেই।
যুদ্ধের সময় সব অনিয়মই নিয়ম হয়ে যায়। সব অসম্ভবই সম্ভব। জানাজা পড়াতেও ছেলেমেয়ে ভেদাভেদ নেই-মানবতাই প্রধান। যুদ্ধ মানুষকে প্রকৃত মানুষ করে দেয়। যুদ্ধ এক ধর্মের মানুষকে অন্য ধর্মের করে দেয়। যুদ্ধের কোনো মাস নেই, বছর নেই, শুধু আছে দিনের হিসেবে বেঁচে থাকা। যুদ্ধের সময় মানুষ জীবন দিয়েছে, মেয়ে দিয়েছে, ভিটে দিয়েছে আর কী দিতে হবে?
রেণুর সাথে মাখনের ভালোবাসা ছিল। স্বপ্ন ছিল নীড় বাঁধার। যুদ্ধে রেণুর গর্ভ হওয়াকে সে অঙ্গহানি বলে চিকিৎসা করতে বলে। গর্ভপাত রেণু করতে পারে না। গর্ভ বড় হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা মাখনকে সে বলে-
‘যুদ্ধে আমার অঙ্গ যখম হয়েছে- আমি ভালো হয়ে যাব। আমি তোমারই আছি। … গর্ভ? কিসের গর্ভ? এটা জরায়ুর জখম। তুমি দিয়েছ পা, আমি দিয়েছি জরায়ু। যুদ্ধ শিশুই হবে আমাদের যুদ্ধের সাক্ষী।’
‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ উপন্যাস ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত কবি কঙ্কন মুকুন্দরামের ‘চণ্ডী মঙ্গল কাব্যের নায়িকা কালকেতু ও ফুল্লরার কাহিনি অবলম্বনে রচিত। মঙ্গল কাব্যের চরিত্রগুলো থেকে এ উপন্যাসের চরিত্রগুলোর নামকরণ হয়েছে। শাসকের অত্যাচার আর স্বেচ্ছাচারিতায় প্রজাদের সুখ-শান্তি ধুলায় লুটিয়ে পড়ে। এহেন সুবিধাবাদী মনোভাব বাংলাদেশের তৎকালীন স্বৈরশাসকের ছিল এবং তার দোসররা বাংলাদেশের রাজনীতিকে নষ্ট করেছে। লেখক আমাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে চেতনায় ধারণ করে শৈল্পিক অবয়বে তাকে প্রকাশ করেছেন।
‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ বাংলাদেশ ও বাঙালি জীবনের অখণ্ড ভূখণ্ড। যে ভূখ নিয়ে বাঙালি জাতির বারোমাসি স্বপ্নবোনা। প্রতি সন্ধ্যায় মানুষের মঙ্গলধ্বনি বাজে সে মাটিতে। যে ভূখণ্ডে মানুষের জীবনের স্বপ্ন সাধে জড়িয়ে আছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি বাংলার বাঙালিকে গৌরব-উদ্দীপ্ত স্বপ্ন দিয়েছেন। দিয়েছেন বেঁচে থাকার আকণ্ঠ সাহস। সে স্বপ্ন্ন ভেঙে চুরমার করে দেয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে।
ইতিহাস আর সাহিত্যের এক চমকপ্রদ যুগলবন্দি উপন্যাস ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’। মীর্জা গালিব এই লেখার মূল। ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’ লেখক অন্য এক গালিবকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। ‘লারা’ (২০০০) উপন্যাসে লেখক লারার জীবনের প্রতিটি সময়কে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বিশ্নেষণ করেছেন। লারা তাঁর বুকের মানিক আত্মনিবিষ্ট ধন। সেলিনা হোসেন ‘লারা’ উপন্যাসে জীবনের অনেক না বলা কথা অকপটে বলেছেন। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে আত্মবিশ্বাসের স্থির ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে বলতে পেরেছিলেন ‘মা-মেয়ের’ সংসার। লারা ছিলেন বৈমানিক। লারার মৃত্যুর দিনই ছিল তাঁর প্রশিক্ষণের শেষ দিন। প্লেনটা পোস্তগোলায় ক্যাশ করেছে। একজন মা সন্তানের মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। মৃত্যুর পর তার পুড়ে যাওয়া দেহের বর্ণনা উপস্থাপনের সময় কতটা স্বাভাবিক নির্লিপ্ত নিরুত্তেজ নির্মোহ থাকতে পেরেছে- অথচ হৃদয়ের ক্ষরণকে পাষাণ হৃদয় দিয়েই অনুভব করেছেন তা প্রশংসার যোগ্য। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, স্বপ্নসাধ, নাড়িছেঁড়া ধন লারার সাথে আত্মার প্রতিটি সূক্ষ্ণ তন্ত্রী যেন লেখকের অনুভূতিমিশ্রিত বেদনার্ত অধ্যায়। যে অনুভব মানুষকে প্রতিনিয়ত দ্বগ্ধ করে, দ্রোহ করে, করে দহন। এ পীড়ন নিয়েই তিনি প্রতিদিন জীবনযাপন করে যান। ‘কাঠকয়লার ছবি’ উপন্যাসের পটভূমি একটি যুদ্ধ শিশু ও চা-বাগানের মানুষ। যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পায়নি জীবন-মুক্তির কোনো পারিশ্রমিক। তারা শুধু আজীবন শ্রম দিয়ে গেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এভাবেই চলেছে তাদের শোষণ, শাসন। এদের মাঝে হঠাৎ এক যুদ্ধশিশু এসে দাঁড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন নারীর গর্ভে যার জন্ম। সে শিশুর পিতা একজন পাকিস্তানি সৈনিক। সে শিশুর জন্মের পর শিশুটিকে তার অসুস্থ মায়ের কাছে না দিয়ে এক বিদেশি দম্পতিকে দিয়ে দেয়। তারা পরম মমতায় তাকে মানুষ করে। একদিন নাড়ির টানে বাংলাদেশে আসে মায়ের খোঁজে।
বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাঁর লেখার মূল উপজীব্য। ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সকল বঞ্চনা, শ্রেণিবৈষম্য, অবদমন, সংগ্রাম অর্জন সবই স্থান পেয়েছে তাঁর বিভিন্ন রচনায়। বিশ্নেষণধর্মী সাহিত্য সৃষ্টির প্রবহমান জীবন তাঁর সাহিত্য প্রেরণার মূল স্তম্ভ হয়ে কাজ করেছে। সমাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমগ্রতাই তাঁর শিল্পসত্তার মূল উপাদান।