স্টেশনে রোদেলা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ মে ২০২২, ৪:৪৬:২৭ অপরাহ্ন

বিনতা দেবী
রোদেলা বরাবরই একটু ছন্নছাড়া স্বভাবের। কখন কি করে বসে, সে নিজেও এতটা বুঝে উঠতে পারে না। হঠাৎ প্রেম করে বসলো এক মুদি দোকানীর সাথে! গত শীতের প্রথম দিকে শীত পড়তে না পড়তে ও দুর্গাপুর কলেজ থেকে শিক্ষা সফরের নাম করে ঐ দোকানি অনিমেষকে নিয়ে দার্জিলিং ঘুরতে যায়। বাবা নিশিকান্ত চৌধুরী কলকাতার যোধপুর শহরের একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি যাকে এক ডাকে সবাই চেনে। রোদেলার বিষয়টি চারদিকে জানাজানি হলে বাবার কর্ণগোচর হয়। এতে বাবা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে রোদেলার প্রতি একটু নজরদারী করলে ও কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারেনি।
এর ফলস্বরূপ রোদেলা বাবার অজান্তে তার ব্যাংকের চেকের স্বাক্ষর নকল করে বেশ কিছু টাকা তুলে নেয়। তারপর দোকানী অনিমেষকে প্রস্তাব দেয় দুজন মিলে অন্যত্র চলে যেতে। এর মধ্যে নিশিকান্ত চৌধুরী টের পেয়ে দোকানির ভিটেমাটি সহ সব উচ্ছেদ করে দেন। সে ভয়ে ভীত হয়ে এখান থেকে অনেক দূরে চলে যায়। রোদেলার সাথে আর কোন সম্পর্কই রাখে না। এত্ত সবের মূলে হলো, রোদেলা বয়স যখন পাঁচ বৎসর ছ’মাস তখন রোদেলার মা জয়ন্তী ভদ্র রোড এক্সিডেন্টে গুরুত্বর আহত হয়ে মাস দু’এক মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
নিশিকান্ত চৌধুরী অনেক টাকা পয়সা খরচ করেও স্ত্রীকে বাঁচাতে পারলেন না। তারা দু’জনের ভালবাসার সম্পর্ক ছিল দীর্ঘ দিনের। উনাদের ভার্সিটি জীবন একই সাথে কাটে। দু’জনই অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া করেছেন। লেখাপড়া শেষ করে জয়ন্তী ভদ্র দুর্গাপুর একটা কলেজে অধ্যাপনা করতেন। আর নিশিকান্ত চৌধুরী ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি কয়েকটা গার্মেন্ট ফেক্টরীর মালিক। তাদের বিয়ের প্রায় পাঁচ বৎসর পর রোদেলার জন্ম হয়, রোদেলা মা বাবার যেন একেবারে চোখের মণি ছিলো। হঠাৎ করে ওর মা মারা যাওয়ার পর বাবা নিশিকান্ত চৌধুরী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এমনি অবস্থায় রোদেলাকে দেখা শোনার দায়িত্ব ভারটা ওর মামারাই নেন। ওরা ওকে কোলে পিঠে করে বড় করে তুলেন। একেবারে আদরে আদরে মেয়েটি আদরের দুলালী হয়ে উঠে। যা পরবর্তীকালে তার জন্য আশির্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।
এদিকে নিশিকান্ত চৌধুরী দিনে দিনে ডিপ্রেশনে চলে যান। কিছুদিন তাকে মানসিক হাসপাতালেও থাকতে হয়। একসময় অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ছাড়পত্র দিয়ে পরিচর্যার জন্য হাসপাতাল থেকে একজন সিস্টার নিযুক্ত করে দেয়। সিস্টার তিলোত্তমার দীর্ঘদিন সেবা ও কাউন্সিলিং এর মধ্য দিয়ে একসময় নিশিকান্ত চৌধুরীর শারীরিক অবস্থা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠে। তিনি একমাত্র মেয়ে রোদেলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। খবর পেয়ে রোদেলা বড় মামা রোদেলাকে নিয়ে আসেন ওর বাবার কাছে। নিশিকান্ত চৌধুরী মাতৃহারা মেয়ে রোদেলাকে বুকে জড়িয়ে ওর মায়ের স্মৃতি আওড়াতে থাকেন। এক মুহূর্তে তিনি আবেগ প্রবণ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। রোদেলার বড় মামা এ অবস্থার প্রেক্ষিতে ওকে ওর বাবার কাছে রেখে যান। ওকে পেয়ে ওর বাবা নতুন জীবন ফিরে পান। আদর সোহাগ করে ওকে মানুষ করতে থাকেন। কিন্তু অতি আদর ও যেন সইতে পারেনি। দিন দিন মেয়েটা বাবার আসকারা পেয়ে কেমন জানি বেয়াড়া স্বভাবের হয়ে উঠতে থাকে।
সে দুর্গাপুর কলেজে অনার্স ২য় বর্ষে পড়াকালীন অবস্থায় কলেজ থেকে পিকনিক স্পটে গেলে সে ঐখান থেকে উদাও হয়ে যায়। দোকানি অনিমেষকে খুঁজতে বিভিন্ন রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। তার বিশ্বাস অনিমেষকে সে এখানেই পাবে। কে জানতো তার বিশ্বাসের থলে কখন পূর্ণ হবে? সে আর বাসায় বাবার কাছে ফেরেনি, এমন কি আত্মীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগও বন্ধ করে দেয়। শুধুই অনিমেষ এর ভূত তার মাথায়। রেলস্টেশন এর কাছাকাছি রুম নিয়ে থাকে আর সময় সময় এসে ট্রেন যাত্রীদের ভীড়ে অনিমেষকে খুঁজে বেড়ায়। কি অদ্ভুত ব্যাপার! এ দিকে মেয়ের চিন্তায় চিন্তায় বাবা নিশিকান্ত চৌধুরীর শারীরিক অবস্থা একেবারে চরমে। একদিন প্রত্যুষে রোদেলা ঘুম থেকে উঠে সোজা স্টেশনে চলে আসে। এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক চা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে এক পেয়ালা চা খেয়ে হতাশ হয়ে ট্রেনে ওঠা যাত্রীদের দিকে সকরুণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে; এমনি সময় পাশ ফিরতে গিয়ে এক কফি বিক্রেতার সাথে ধাক্কা লেগে ওর ফুটন্ত জল রোদেলার পাচাতে পড়ে বেশ কিছু অংশ পুড়ে যায়। সাথে সাথে ফুসকা পড়ে যায়। অবস্থা বেহাল হয়ে যায়।
কফিওয়ালা লোক সমাগম হওয়ার পূর্বেই রোদেলাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে তড়িঘড়ি করে একটা অটোরিকশা ডেকে হসপিটাল এমারজেন্সিতে নিয়ে গেল। ডাক্তার তাকে বার্ণ ইউনিটে ভর্তি দেয়। চিকিৎসা চলতে থাকে। কফিওয়ালা ছিল রোদেলার সেই দোকানি অনিমেষ। রোদেলা কফিওয়ালাকে চিনতে পারেনি কিন্তু অনিমেষ রোদেলার পুড়া অংশে এন্টিবায়োটিক ক্রীম লাগাতে গিয়ে চোখে পড়ে রোদেলার পাচায় জন্মগত কালো স্পটটি। মনে পড়ে যায় অনিমেষ এর। রোদেলাকে নিয়ে দার্জিলিং বেড়ানো ঘুরানো অবাদ মেলামেশার কথা, তখন এই স্পট দেখে সে রোদেলাকে কত প্রশ্ন করেছিল। এক সময় রোদেলা বলছিলো, ‘কখনো যদি হারিয়ে যাই প্রিয় আমার পাছায় পেছানো স্পটটি দেখে চিনে নিও’।
অনিমেষ এর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু বিগলিত হতে থাকে, সে রোদেলাকে আরও কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাইলে রোদেলার ঘুম ভেঙ্গে যায়। রোদেলা আ…রে…রে…রে কি করছো? কি করছো বলে চিৎকার দিল। হসপিটালের ডিউটিরত নার্সরা বিষয়টি জানতে চাইলে, অনিমেষ ধামাচাপা দিয়ে দেয়। অনিমেষ ভাবতে থাকে ও তো আমাকে চিনতে পারেনি, চিনলেই কি আর আমাকে পছন্দ করবে। ও রাজ দুলালী আর আমি কফিওয়ালী আর কফিওয়ালা একটা বললেই হলো একই কথা। এর মধ্যে হাসপাতাল থেকে রোদেলা ছাড়া পেল। সে কোথায় যাবে চিন্তা করছে, বাবার কাছে ফিরবে কিনা। ভাবছে, এমনি সময় অনিমেষ বলল, আপনি কি কিছু ভাবছেন? রোদেলা কেন আপনি কি করে বুঝলেন আমি কিছু ভাবছি? অনিমেষ না এমনিতেই বললাম বিষন্ন বদন, ভ্রুকুঞ্চন দেখে। আপনার তো কিছু ভাবলে ভ্রু কুঁচকে যায়? রোদেলা আচ্ছা আপনি বেশ লোকতো? এগুলো আপনি কি করে জানেন? যতসব সাজানো কথা। এই যাবার বেলা ঝগড়া বেধো না তো! অনিমেষ না আমি কি করে জানবো আশ্চর্য তো! রোদেলা একটু একটু করে অনিমেষকে ভালবাসতে শুরু করে। হসপিটাল থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ওর হাত ধরে বলল, তোমার মাঝে না আমি আমার হারানো সুর খুঁজে পাই। তোমায় পেয়ে মনে হচ্ছে, আমার মেঘে ঢাকা আকাশে নতুন সূর্য হাঁকে। আমরা দু’জন চির বন্ধু হব। আচ্ছা, এই দ্যাখো দ্যাখি আমরা দু’জন এতদিন এত কাছে থেকেও একে অপরের নামটা পর্যন্ত টুকিনি!
অনিমেষ বিড় বিড় কণ্ঠেÑওগো মেঘলীনা তোমার ভালবাসায় পূর্ণ/আমার হƒদয় পাত্র খানি,/কতো দিন কতো নিশি ভোর/খুঁজে হয়েছে বিভোর কি করে বুঝাবো এক্ষুণি।
রোদেলা কি বিড় বিড় করছেন আপনি? আরে আপনি পাগল কিনা? বলছি নামটি বলেন? অনিমেষ বলল, কফিওয়ালা এই নামে আমাকে সবাই চেনে। এই নামে ডাকলেই পেয়ে যাবেন।
এবার দু’জনের যাবার পালা। অনিমেষ রোদেলাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে তার সেই কফি বিক্রির কাজে লেগে যায়। প্রতিদিন ভোর হতে না হতেই রোদেলা প্ল্যাটফর্মে এসে তার অনিমেষ এর প্রতিক্ষায় সময় কাটায়। অনিমেষ খুব ভাল গান করত আর দেখতে সুনিপুন চেহারার অধিকারী ছিল, যার জন্য রোদেলা ওর প্রেমে পড়েছিল। একদিন প্রত্যুষে রোদেলা প্ল্যাটফর্মে পৌঁছানোর অনেক দূর থেকে অতি পরিচিত একটা কণ্ঠ শুনতে পায়, যত এগোচ্ছে ততই যেন মনে হচ্ছে খুব কাছের মানুষ তার। অনিমেষ এর কন্ঠে এই গানটি দার্জিলিং যাওয়ার সময় ওরা শিলিগুড়ি একটা স্টলে বসে কপি খেতে খেতে অনিমেষ গানটি করছিল। আর রোদেলা শুনে শুনে ধোঁয়া উঠা কফিতে চুমুক দিচ্ছিল। গানটি শুনে রোদেলার মনের জোর বেড়ে গেল ও মুগ্ধ হল। ভাবতে লাগলো নিশ্চয় অনিমেষ এখানেই আছে। অনিমেষ অনিমেষ বলে রোদেলা বেহুশ হয়ে ট্রেনের এ কামরা থেকে ও কামরা ছুটে অনিমেষকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু না পেয়ে সে আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ে। কখন যে ট্রেনের নিচেই পড়ে যায় কিনা শরীরের কাপড় চোপড়ের অবস্থা বেহাল। মনে হচ্ছে যেন আজ তার অনিমেষকে চাই ই চাই। এসব দেখে অনিমেষ আর ধৈর্য্য ধরতে পারেনি। রোদেলার দেওয়া একটা নীল টিশার্ট ছিল। অনিমেষ এটা গায়ে জড়িয়ে পিছন থেকে এলোমেলো চুলে রোদেলা রোদেলা বলে চিৎকার করতেই পিছন ফিরে রোদেলা অনিমেষকে বলে কফিওয়ালা আমার অনিমেষ আমার অনিমেষ কোথায়? এই না গান করছিল। এক সময় রোদেলা ইমোশনাল হয়ে ট্রেনের পিছন পিছন অনিমেষ অনিমেষ যেওনা যেওনা বলে দৌড়াতে থাকে। এত্ত সব দেখে অনিমেষ আর তার পরিচয় রোদেলার কাছে গোপন রাখতে চায়নি। সে গলা ছেড়ে ঐ গানটি গায় শিলিগুড়ির কফি হাউসে যে গানটি গেয়েছিলো। ‘যেওনা সাথী কোথায় চলেছো একেলা… বেঁহুশের মতো রোদেলার পিছনে ছোটতে গিয়ে বাম পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের মাথা কেটে রক্ত ঝরতে থাকে। সে রোদেলাকে কোলে তুলে প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসে বলতে থাকে, রোদেলা রোদেলা তাকাও দ্যাখো তোমার অনিমেষকে। ততক্ষণে রোদেলা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
কিছুক্ষণ পর চোখে মুখে জল দিলে রোদেলার জ্ঞান ফিরে। সে অনিমেষকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। চিনবে কি করে দীর্ঘ দিন পর দু’জনের আবার দ্যাখা। অনিমেষ পকেট থেকে ফেইস টাওয়েলটা বের করে রোদেলার চোখের জল মুছে দেয় অতি সযত্নে আদরে সোহাগে তাকে তার নির্জন কুটিরে নিয়ে যায়। তারপর তার বৃদ্ধাঙ্গুলীর ঝরে পড়া রক্ত ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করে আর যত বাঁধা আসুক না কেন এ দেহে প্রাণ থাকতে রোদেলাকে তার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে দেবে না।
এমনি সময় অনিমেষের হাত থেকে এক ফোটা রক্ত রোদেলার সিঁথিতে পড়ে কপাল পর্যন্ত গড়িয়ে এসে পৌঁছে। এ দৃশ্য দ্যাখে অনিমেষ অভিভূত হয়ে পড়ে। রোদেলার কপাল সিঁদুর রাঙ্গা হয়ে উঠে। কি আশ্চর্য! চাঁদনী রাতে রোদেলা চন্দ্রিমার চন্দ্রালোকে জ্যোস্নাত হয়ে বরণ করে তার প্রেম তার ভালবাসার মানুষ কফিওয়ালা অনিমেষকে। অনিমেষ শিলিগুড়ির কফি হাউসে বসে কফি খেতে গিয়ে, গাওয়া গানটি রোদেলার হাত ধরে গলা ছেড়ে সুর তুলে, যেওনা সাথী কোথায় চলেছো।