স্বপ্নভাঙ্গা ঈদ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০১ মে ২০২২, ৬:১৯:৪০ অপরাহ্ন

ইছমত হানিফা চৌধুরী
সেদিন পঁচিশ রমজান ছায়ারুন বাসার কাজ শেষ করে খুব জোর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে নিজের ঘরে। ছুটা বুয়ার কাজ করে সে। তিনটি বাসায় ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে নিজের ঘরের কাজ শেষ করে, ওর মেয়ে ফুল, যার বয়স মাত্র পাঁচ বৎসর, একদম ফুলের মতো মিষ্টি একটা মেয়ে। সেই মেয়েকে খাইয়ে মেয়ের দুপুরের খাবার রেখে এরপর ছায়ারুন কাজে যায়। এক বাসা দুই বাসা করে তিন বাসার কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। রমজান মাস আসাতে ছায়ারুন ইফতারের আগে আগে, কখনো কিছু কাজ ফেলে রেখে ইফতারে ওর বাসায় চলে আসে। পরে আবার রাতে ঐ বাসায় গিয়ে কাজ শেষ করে।
ছায়ারুন খুব বিশ্বাসী আর সুন্দরভাবে কাজ করে বলে সব বাসায় তার কদর। সবাই আগের দিনের খাবার থেকে যা থাকে, তা ফ্রিজে রেখে দেয়। পরের দিন ছায়ারুনকে দেয়, শুধু যে বাসায় শেষ কাজটা করে ঐ বাসার মেমসাহেব তাকে নতুন ইফতারি থেকে প্রতিদিন ইফতার দেন। এই সব মিলিয়ে ছায়ারুন ঘরে ইফতার করে। তবে যাই হউক ইফতারের সময় ছায়ারুনের স্বামী সুরুজ মিয়া খেজুর হাতে নিয়ে অর্ধেক নিজ মুখে দিয়ে, বাকি অর্ধেক ছায়ারুনের মুখে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। এমন সময় যত যাই ঘটুক ওরা একত্রে বসে ইফতার করে।
প্রায়ই খুব একটা আগে ফিরতে পারে না ছায়ারুন, বেশিরভাগ চৌকাটে পা দিতেই আযান হয়ে যায়, তবুও ওরা সবাই মানে ফুলের বাবা, ফুলকে নিয়ে একসাথে ইফতার করে। ফুলের বাবা সুরুজ সারাদিনে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করে। সুরুজ মিয়ার এক কথা যত যাই করি রমজান মাসে স্ত্রী সন্তান নিয়ে এক সাথে ইফতার, সেহেরি খাব। তাই ছায়ারুনের যত কাজের চাপ থাকুক না কেন ইফতারের সময় বাসায় চলে আসে। রুটিন মতো সব শেষ করে বাসার কাজে যায়, রমজান মাসে প্রথম দুই বাসায় কাজ শেষ করে কুলিয়ে উঠতে অনেক সময় দেরি হয়ে যায়। তারপরও এই বাসার মেমসাহেব খুবই ভাল। প্রতিদিন নতুন ইফতার দেন। আজ ছায়ারুন সব ইফতার প্লেটে নিচ্ছে। এক বাসার মেম সাহেব বেশ বড় এক বক্স পায়েস দিয়েছেন। পায়েস এর ঢাকনা সরাতেই কেমন মৌ মৌ ঘ্রাণ নাকে এল সেই বাটি উপুড় করে স্টিলের প্লেটে ঢালছে, খুব জুরে একটা শব্দ হল। সুরুজ মিয়া শব্দ শুনে নাক উচু করে মন খারাপ করে চোখ খুললো। এমন সময় শোনা গেল, সাইরেন আর মসজিদের আযান। সুরুজ মিয়া হাতে খেজুর নিয়ে দোয়া পড়তে ছিল, এক টুকরা নিজের মুখে দিয়ে অন্য টুকরা ছায়ারুনের মুখে দিয়ে ইফতার খাওয়া শুরু করলো।
বাইরে অল্প বৃষ্টি ছিল তখন আজানের পর শুরু হল প্রচুর বাতাস ঝড় বৃষ্টি। এর মাঝে চলে গিয়েছে কারেন্ট, মোমবাতির আলোয় কিছু ইফতার শেষ করে সুরুজ মিয়া প্রতিদিনের মতো মাগরিবের নামাজে মসজিদে চলে গেছে। ছায়ারুন চিন্তায় পড়ে গেছে পায়েসের এত সুন্দর ঘ্রাণ ছিল, সে খেয়াল করে দেখেছে পায়েসের বক্সের ঢাকনা খুলার সাথে সাথে সুরুজ মিয়ার জ্বিবে জল চলে আসছিল। কিন্তু পাথরের শব্দে আর পায়েস খাওয়া যাবে না। তারপরও ছায়ারুন চামচ দিয়ে একটু পায়েস জিবে দিয়ে দেখলো না, বালি বালি করতেছে না, তারমানে পাথরটা ভাল একটু আঙ্গুল ঢুকিয়ে পায়েসের বাটিতে পাথর খুঁজতে বেশি বেগ পেতে হল না, কিন্তু আঙ্গুলে যে জিনিস উঠে আসলো তা দেখে ছায়ারুনের চোখ চড়কগাছ। এ যে পুরাই একটা ব্রেসলেইট, দেখে মনে হচ্ছে স্বর্ণের। আবার ছোট ছোট সাদা পাথর বসানো। ব্রেসলেইট হাতে নিয়ে ছায়ারুন মুখ হা করে বসে আছে। নামাজ থেকে ফিরে সুরুজ মিয়া ছায়ারুনের দিকে তাকিয়ে আছে, কারেন্ট নাই, মোমবাতির আলোয় ছায়ারুনের হাতের জিনিসটা চকচক করছে। সুরুজ খাবারের প্লেইট হাতে নিয়ে ছায়ারুনকে বলে ও বউ এ জিনিসটা কি, কই থেকে নিয়ে আসছো। ছায়ারুন বলে আমি আনি নাই। আমি এর কিছুই জানিনা। সুরুজ মিয়া খাবার রেখে ছায়ারুনের হাত থেকে চকচকে জিনিসটা নিয়ে পানি দিয়ে পায়েস ছাড়িয়ে হাতে নিয়ে দেখছে। এতো স্বর্ণ,ও বউ আমাদের আল্লাহ গায়েবি আলাদিনের চেরাগ দিসে। এই জিনিস অনেক দামী। যাই হোক আমাদের কলোনির মাঝখানের সারির যে জব্বার আছে তারে নিয়া দেখাই। জব্বার স্বর্ণের দোকানে কাজ করে। শোন বউ জব্বার একদিন আমারে একটা কালো পাথর দেখাইছে। হেই পাথরের নাম কষ্টি পাথর। কিন্তু ফুলের বাপ এই জিনিস আমাদের না এইটা স্বর্ণ হউক আর যাই হোক তাতে আমার কিছু যায় আসে না আমি এইটা ফেরত দিয়া আসি। সুরুজ মিয়া, চুপ থাক বলে এক ধমক দেয় ছায়ারুনকে। ব্রেসলেইটটা নিয়ে চলে যায় জব্বারের ঘরে। জব্বার ঘরেই ছিল। কষ্টি পাথরে এই জিনিস দেখে জব্বার এর দাম বলে, দেড় দুই লাখ টাকা হবে। সুরুজ মিয়া ঘরে এসে সব কথা বলে ছায়ারুনকে। বলে, কাল এটা আমরা বিক্রি করবো। গ্রামে চলে যাব। ভাঙ্গা ঘর ঠিক করবো। একজোড়া বলদ কিনবো কিছু জমি রাখবো। আর অন্যের ঘরে তোকে কাজ করতে হবে না। এখন সব সুখ আমার হাতের মুঠোয়। এই ঈদের আগেই বাড়ি যাব। আহা কে জানতো এই ঈদের আগে আমরা এতো বড়লোক হব সব আল্লাহর ইচ্ছা।
পরদিন সকালে ছায়ারুন কাজে যাওয়ার সময় ব্রেসলেইটটা ব্লাউজের ভিতরে করে সাথে নিয়ে যায়, কথা হয় সুরুজ মিয়া স্বর্ণের দোকানে গিয়ে ফাইলান কথা বলে পরে এই জিনিস নিয়ে যাবে। ছায়ারুন যে ঘর থেকে পায়েস দিছিল সেই ঘরে গিয়ে দেখে সবার মুখ অত্যন্ত বেজার। কি হইছে বলতেই সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। মেমসাহেব বলে আমাদের অনেক মূল্যবান একটা জিনিস হারাইয়া গেছে। একটা ব্রেসলেইটই তোর সাহেব এর এখন ব্যাবসা খুব খারাপ যাচ্ছে। এই ঈদে বাসার ভাড়া আটকে আছে, বাচ্চাদের কাপড় কেনা কিছ্ইু করা যাবে না। তাই আমার অনেক আগের একটা স্বর্ণের ব্রেসলাইট ছিল তা বিক্রি করে দিব। আজ এসে একজন নিয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু গতকাল আমি এই ব্রেসলেইট ভাবলাম শেষমেষ একটু হাতে দেই। হাতে দিয়ে দিলাম। কিন্তু ইফতারের পর থেকে আর খুজে পাচ্ছি না। এ দিকে তোর সাহেব বলতেছে আমি এইটা সরাই ফেলছি যাতে বিক্রি না করতে পারে। আমি কেন তা করতে যাব। আজ অনেক দিন থেকে সমস্যা যাচ্ছে। বাসা ভাড়া প্রায় ছয়মাস বাকি। বাচ্চাদের স্কুলের ফি বাকি। দোকানদার তাকদা দিচ্ছে বাকি টাকার জন্য। তার উপর বাচ্চারা ঈদেও নতুন কাপড় চাইছে। আমি দিশেহারা, তোর সাহেবকে দেখলে মনে হচ্ছে খুন চেপে আছে মাথায়। কালরাত থেকে সারা ঘর খুঁজেছি, কোথাও পেলাম না। আর বাইরে থেকে কেউ আমাদের ঘরেও আসে নি। মেম সাহেবের চোখের পানি দেখে ছায়ারুনের মন কেদে উঠলো।
সে মুখে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, মেম সাহেব যে জিনিস ঘরে নাই, সে জিনিস ঘরে খুঁজে কেমনে পাবেন। কথা শেষ করতে না করতেই সাহেব বলে উঠলেন দেখেছো, এই বেটি চুরি করছে। তুমি বলছো এ হতে পারে না।এখন দেখলে তো, দাঁড়াও পুলিশে ফোন দিচ্ছি। ছায়ারুন বলল, স্যার আমি যদি এই জিনিস চুরি করতাম আহলে এখন কি তা আপনাদের বাসায় নিয়ে আসতাম। এরপর এক এক করে সব ঘটনা বলে ছায়ারুন ব্রেসলেইটটা ওদের খাবার টেবিলে রাখলো।