স্বপ্নের পদ্মা সেতু
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ জুন ২০২২, ৫:৪২:৪০ অপরাহ্ন

জসীম আল ফাহিম
বাবা অফিস থেকে ফিরে আমার মাকে বললেন, ‘এই যে শুনছো! আগামীকাল আমরা কোথাও বেড়াতে যাব।’
বাবার কথা শুনে মা কৌতূহলী হয়ে বললেন, ‘কোথায় বেড়াতে যাবে?’
বাবা মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘সেটা আপাতত বলছি না। রহস্য রেখে দিলাম। কিছুটা রহস্য থাকা ভালো।’
মা আর রহস্য ঘাঁটাতে গেলেন না। কোনো কিছু বললেনও না। বলে অবশ্য লাভও হবে না। কারণ মা বুঝে গেছেন বাবা আপাতত রহস্যের বিষয়টা ভাঙবেন না।
পরে মা আমাকে বললেন, ‘রাফিদ! শুনেছিস তো। তোর বাবা আগামীকাল কোথাও বেড়াতে যাবেন। সাথে আমরাও যাব। তুই এখুনি তোর ব্যাগটা রেডি করে ফেল।’
আমি বললাম, ‘জি আচ্ছা আম্মু।’
আমি আমার রুমে এসে ব্যাগ গোছাচ্ছি। আর মনে মনে ভাবছিÑকোথায় বেড়াতে যাবেন বাবা! বাবা তো কিছু বললেন না। মাও বললেন না। বাবার কথায় কেমন যেন একটা রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কী সেই রহস্য! আমাকে তা জানতেই হবে। ভেবে আমি ধীর পায়ে বাবার কাছে গেলাম। মিনমিন করে বললাম, ‘আচ্ছা বাবা! আগামীকাল আমরা সত্যিই বেড়াতে যাব নাকি?’
বাবা জোর গলায় বললেন, ‘নিশ্চয়ই। তোর কোনো সন্দেহ আছে?’
আমি বললাম, ‘সন্দেহ নেই বাবা।’
তারপর বাবা একটু গম্ভীর ভাব ধরে রইলেন। বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেন। আমি মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু বলছ বাবা! কোথায় বেড়াতে যাব আমরা?’
বাবা কোনো জবাব না-দিয়ে বললেন, ‘তার আগে পাঁচটি নদীর নাম বল তো শুনি?’
আমি বললাম, ‘নদীর নাম তো আমি জানি বাবা।’
বাবা বললেন, ‘জানিস বলছিস। তাহলে বলছিস না কেনÑবল?’
আমি আর কী করি। বললাম, ‘পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা ও ব্রহ্মপুত্র।’
বাবা বললেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো নদীটার নাম কী বল?’
আমি একটু চিন্তিত ভাব করে বললাম, ‘বড়ো নদী! বড়ো নদী তো বাবা পদ্মা।’
আমার জবাব শুনে বাবা মৃদু হাসলেন। হেসে হেসেই বললেন, ‘উত্তর ঠিক হয়েছে। দশে দশ পেয়েছিস।’
আমি বললাম, ‘আপাতত দশে দশ আমার দরকার নেই বাবা। আগে বলো আগামীকাল আমরা কোথায় বেড়াতে যাব।’
আমার কথা শুনে বাবা একটু নীরব হয়ে রইলেন। জবাব দেয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করছেন বলে মনে হলো না। তারপর নীরবতা ভেঙে বাবা বললেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় মাছের নাম কী রে?’
জবাবে বললাম, ‘ওটাও তো আমি জানি বাবাÑইলিশ মাছ।’
বাবা বললেন, ‘ইলিশ মাছ খেতে কেমন বল।’
আমি বললাম, ‘বড়োই সুস্বাদু!’
বাবা বললেন, এখন বল শুনি কোন নদীর ইলিশ মাছ খেতে বেশি সুস্বাদু।’
এবার আমি গভীর ভাবনায় পড়ে গেলাম। বললাম, ‘উত্তরটা আমার জানা নেই বাবা।’
বাবা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘বলিস কী রে বেটা! আমার ছেলে হয়ে তুই জানিস না যে পদ্মার ইলিশই বেশি সুস্বাদু। না না এটা হতে পারে না। এটা তোর জানা দরকার ছিল।’
আমি বললাম, ‘এত কিছু আমি জানব কেমন করে বাবা? তাছাড়া সবাই সবকিছু জানে নাকি?’
বাবা বললেন, ‘জানে না ঠিক আছে। তাই বলে তুইও জানবি না নাকি?’
আমি মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম, ‘সরি বাবা। ভুল হয়ে গেছে। এমনটি কখনো আর হবে না।’
আমার বিনয়াবনত কথা শুনে বাবা বেশ খুশি হলেন। ফিক করে তিনি হেসে দিলেন। বেশি খুশি হলে বাবা এভাবে হেসে ফেলেন। আমি বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘বলোই না বাবা। আগামীকাল আমরা কোথায় বেড়াতে যাব?’
বাবা এবার মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘পদ্মা বহুমুখী সেতুটা কী আমাদের একবার দেখা দরকার না।’
বাবার কথা শুনে আমি খুশিতে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলাম, ‘বুঝেছি পদ্মা সেতু দেখতে যাব আমরা! ওহ্ কী যে মজা হবে না। যাই মাকে খবরটা দিয়ে আসি।’
আমি মায়ের উদ্দেশ্যে ছুট লাগাব, ঠিক এমন সময় বাবা খপ করে আমাকে ধরে ফেললেন। আমার কানে মুখ রেখে ফিসফিস করে বললেন, ‘এই কথা তোর মাকে এখন বলা যাবে না। এটা তোর মায়ের জন্য সারপ্রাইজ, ওকে?’
আমি হাসি হাসি মুখ করে বললাম, ‘ওকে বাবা।’
পরদিন সকালবেলা। জাতীয় পাখি দোয়েলের মিষ্টি গান শুনে আমার ঘুম ভাঙল। ঘুম থেকে জেগে আমি উঠোনে নেমে এলাম। আমাদের উঠোনের কোণে গন্ধরাজ ফুল গাছে কয়েকটি সাদা ফুল ফুটে আছে। ফুলের মিষ্টি সুবাস ছড়াচ্ছে। আমি ফুলেদের কাছাকাছি গেলাম। ফিসফিস করে বললাম, ‘এই যে ফুলেরা! খবর কিছু শুনছ? আজ আমরা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো সেতুটা দেখতে যাব। সেতুর নামÑপদ্মা বহুমুখী সেতু। অনেক বড়ো সেতু। কী যে সুন্দর না!’
ফুলেদের জবাব আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে সে সময় হঠাৎ এক পশলা হাওয়া দিলো। বাতাসের দোলায় ফুলগুলো হঠাৎ দোলে ওঠল। দেখে মনে হলো আমার কথা শুনে ফুটন্ত গন্ধরাজ ফুলগুলো যেন খুশিতেই দোলে ওঠল। দোলে দোলে ওরা যেন বলছে, ‘যাও। গিয়ে সুন্দর সেতুটা একবার দেখে এসো। তোমার জন্য ভোরের আশিস রইল।’
সে সময় কোথা থেকে যেন একটা ছোটো টুনটুনি পাখি উড়ে এল। পাখিটা কাছেই একটা ডালিম গাছের ডালে এসে বসল। তারপর সে ব্যস্ত হয়ে লেজ দুলিয়ে কী যেন খুঁজতে লাগল। আমি টুনটুনি পাখিটাকেও পদ্মা সেতুর খবরটা জানালাম। আমার কথা শুনে পাখিটা কী বুঝল কে জানে। তবে সে খুশিতে টুনটুন টুইস টুইস বলে একবার গান গেয়ে ওঠল। ওর গান থামল না। গান চলতেই লাগল। পরক্ষণে আবার কী মনে করে যেন পাখিটা গান গেয়ে গেয়েই ডালিম গাছ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেল। দেখে আমার মনে হলো টুনটুনি পাখিটা যেন গানে গানে বলে গেল, ‘শুভ হোক। তোমাদের পদ্মা সেতু দর্শন শুভ হোক।’
ততক্ষণে সুয্যিমামাটাও আলোক হেসে উঁকি দিলো। ঝলমল করে উঠল দশদিক। সূর্যের আলোয় ভোরের দূর্বাঘাসে ঝুলে থাকা শিশিরকণা মুক্তোদানার মতো জ¦লছিল। আমি সকলকেই উদ্দেশ্য করে জানিয়ে দিলাম, ‘শুনে রাখো তোমরা। আজ আমরা পদ্মা সেতু দেখতে যাব। এতদিন শুধু টেলিভিশনের পর্দায় সেতুটা দেখে এসেছি। আজ নিজের চোখে বাস্তবে দেখব।’
আমার কথা শুনে মনে হলো প্রকৃতিরাজ্যের সকলেই যেন খুব খুশি হয়েছে। মনে হলো পদ্মা সেতু তৈরি হোক এটা সকলেই প্রত্যাশা করেছিল। তাদের সেই প্রত্যাশা যেন আজ সফল হয়েছে। তাই ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে প্রকৃতিরাজ্যে আনন্দ জোয়ার বইছে।
সকাল দশটায় আমাদের বাড়ির সামনে সবুজ রঙের একটা সিএনজি এসে থামল। সিএনজিটা আমার বাবা আগেই ভাড়া করে রেখেছিলেন। আমরা সিএনজিতে উঠে বসলাম। ড্রাইভার পদ্মা সেতুর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। পদ্মা সেতুর কাছাকাছি পৌঁছতে আমাদের প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লেগে গেল। সিএনজি থেকে নামতে নামতে আমার মা মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘আমি ধারণা করেছিলামÑপদ্মা সেতুই হয়তো হবে বেড়ানোর জায়গাটা। আমার ধারণাই দেখছি সত্যি হলো।’
মায়ের কথা শুনে বাবা কিছু বললেন না। শুধু মিটিমিটি হাসলেন। সিএনজি ড্রাইভারের ভাড়া মিটিয়ে আমার একটা হাত ধরে বাবা হাঁটতে শুরু করলেন। মা বললেন, ‘আমরা এখন কোথায় যাব?’
জবাবে বাবা বললেন, ‘একটা ইঞ্জিনের নৌকা ভাড়া করতে হবে। ইঞ্জিনের নৌকা চড়ে আমরা কিছুসময় পদ্মা নদীতে ঘুরে বেড়াব। সেতুটাকে একদম কাছে থেকে দেখব।’
আমার মনে তখন সে কী তোলপাড়! কারণ সেতু তো দূর থেকে দেখাই যাচ্ছে। কিন্তু এই দেখা আর ওই দেখা কী এক হলো? বাবা বলেছেন ইঞ্জিনের নৌকা চড়ে আমরা কাছে থেকে পদ্মা সেতুটা দেখব। কাছে থেকে পদ্মা সেতু উপভোগের আনন্দে আমার মনটা উথালপাতাল করতে লাগল।
ইঞ্জিনের নৌকায় চড়ে আমরা পদ্মার বুকে ভেসে চলেছি। দূরে দেখা যাচ্ছে জেলেরা নদীতে মাছ ধরার জাল ফেলেছে। রূপালি নদীর জল সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছে। কতগুলো নৌকা রং-বেরঙের পাল উড়িয়ে দূরে কোথাও ধেয়ে চলেছে। আমাদের মাথার উপর দিয়ে আকাশে উড়ে চলেছে ঝাঁকে ঝাঁক গাঙচিল, শঙ্খচিল। আমি অবাক চোখে ওসব দেখছি। আর তন্ময় হয়ে ভাবছি। হঠাৎ আমার ভাবনার মাঝেই বাবা বললেন, ‘রাফিদ! সেতুটা দেখতে কেমন রে?’
আমি বললাম, ‘অপূর্ব বাবা! এত দীর্ঘ এত সুন্দর সেতু! আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’
আমার জবাব শুনে বাবা হাসলেন। আমি বললাম, ‘আচ্ছা বাবা এই সেতুটার দৈর্ঘ কত জানো?’
বাবা বললেন, ‘এটা পৃথিবীর এগারোতম দীর্ঘ একটা সেতু। এর দৈর্ঘ ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮ দশমিক ১০ মিটার।’
বাবার কথা শুনে আমি তো থ। কারণ আমি মনে মনে ভেবেছিলামÑএকদিন এই সেতুটা হেঁটে হেঁটে পার হব। কিন্তু এত দীর্ঘ সেতু হেঁটে পার হতে গেলে তো আমার অনেক কষ্ট হবে। আমি আবার বেশি পরিশ্রম করতে পারি না। অল্প পরিশ্রম করলেই কেমন ক্লান্ত হয়ে যাই। মনে মনে ভাবিÑবড়ো হলে নিশ্চয়ই আমি সেতুটা হেঁটে পার হতে পারব।
আমার মা এতক্ষণ একদৃষ্টে পদ্মা সেতুর শোভা উপভোগ করছিলেন। হঠাৎ মা বললেন, ‘ভালোই তো হলো। মুন্সিগঞ্জ জেলার সঙ্গে শরিয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হলো।’
মায়ের কথা শুনে বাবা বললেন, ‘শুধু যে মুন্সিগঞ্জ, শরিয়তপুর ও মাদারীপুরের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হবেÑতা কিন্তু নয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯টি জেলার মধ্যে আন্তঃ যোগাযোগ ত্বরান্বিত হবে।’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা বাবা! এই সেতু দিয়ে শুধু বাস আর ট্রাকই চলবে নাকি?’
আমার কথা শুনে বাবা বললেন, ‘বোকা ছেলের কথা শোনো। এটা একটা দোতলা সেতু রে বেটা। এর ওপর তলা দিয়ে চলবে বাস, ট্রাক, মোটরগাড়ি এসব। আর নীচতলা দিয়ে চলবে বড়ো বড়ো রেলগাড়ি।’
বাবার কথা শুনে আমি রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কারণ সেতুও যে কখনো দোতলা হতে পারে, আমার জানা ছিল না। তাই বিড়বিড় করে বললামÑভারি আশ্চর্য ব্যাপার! পরে বাবাকে শুনিয়ে বললাম, ‘কম করে হলেও এই সেতু দিয়ে প্রতিদিন কয়েক শত যানবাহন চলাচল করতে পারবে, তাই না বাবা?’
আমার কথা শুনে বাবা হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন। পরে হাসি থামিয়ে বললেন, ‘বলিস কী রে তুই বেটা। মাত্র কয়েক শত যানবাহন! হা হা হা। এই সেতু দিয়ে দৈনিক গড়ে ৭৫ হাজার যানবাহন চলাচল করবে, বুঝেছিস?’
আমি অবাক কণ্ঠে বললাম, ‘৭৫ হাজার যানবাহন বাবা!’
আমার মা এতক্ষণ আমাদের কথাবার্তা সবই শুনছিলেন। এবার তিনিও মুখ খুললেন। বললেন, ‘এই সেতুটা আমাদের জাতীয় সম্পদ। এই সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি।’
মায়ের কথা শুনে বাবা বললেন, ‘ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পদ্মা সেতু রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়েজিত আছে।’
সুদৃশ্য পদ্মা সেতুটা দেখতে দেখতে আমাদের নৌকাটি তীরের দিকে ছুটে চলল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো আমরা তীরে পৌঁছে যাব।
হঠাৎ বাবা বললেন, ‘রাফিদ! পদ্মা সেতুটা কেমন দেখলি রে বেটা?’
আমি বললাম, ‘খুবই চমৎকার সেতু বাবা! এমন সুন্দর একটা সেতু বাংলাদেশ সরকার তৈরি করতে পেরেছে, এটা আমাদের জন্য গৌরবের। আমার পক্ষ থেকে সরকারকে অভিনন্দন।’
আমার কথা শুনে বাবা বলেন, ‘এই সেতুর স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু কন্যা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর দূরদর্শিতার জন্যই এই অসাধ্য সাধন হয়েছে।’
বাবার কথা শুনে আমি বললাম, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনাকেও অভিনন্দন জানাই। আজকের বেড়ানোটা আমার মনের মাঝে অনেকদিন গাঁথা হয়ে থাকবে।’
আমার কথা শুনে মা বললেন, ‘শুধুই কী গাঁথা হয়ে থাকবে! আর কিছু না রে খোকা?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ মা। পদ্মা সেতুটা আমার বড়ো পছন্দ হয়েছে। বড়ো হয়ে আমিও এরূপ একটা কিছু তৈরির স্বপ্ন দেখি।’