স্মরণ: দক্ষিণ সুরমার মনির ভাই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৪:৪০:৪৯ অপরাহ্ন

রফিকুর রহমান লজু
মনির উদ্দিন ভাইকে সমবয়সীরা ও বন্ধুরা মনির মিয়া বলে ডাকেন। অন্যরা বা বয়সে যারা ছোট তারা ডাকেন মনির ভাই। আমরা পরিচিতজন যারা তার কাছের মানুষ, তার সাথে সম্পর্কিত রাজনীতি সূত্রে তারাও মনির ভাই ডাকি। আরেকজন মনির উদ্দিন আছেন রাজনীতিবিদ ও এডভোকেট তাই মনির ভাইকে স্পষ্ট সনাক্ত করতে তাকে বরইকান্দির মনির মিয়া বলা হত।
দুরারোগ্য ক্যান্সার বাসা বেঁধেছিলো তাঁর দেহে। প্রথমে তিনি টের পাননি, যখন টের পেলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ব্লাড ক্যান্সার তখন তাঁকে কাবু করে ফেলেছে। তাঁর কণ্ঠনালী শুকিয়ে ছোট হয়ে গিয়েছিলো। পানি জাতীয় খাদ্য খেতেও তাঁর খুব কষ্ট হত।
মনির ভাই চিকিৎসার জন্য ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। অপারেশনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সে সময় হাসপাতালে অক্সিজেন ছিলো না। হাসপাতাল পরিচালনায় অব্যবস্থাও ছিলো। এতে চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটে। তিনি মনে খুব আঘাত পান। এর প্রতিবাদে তিনি হাসপাতাল থেকে চলে আসেন। পরে তাঁকে আর হাসপাতালে নেওয়া যায়নি।
একজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী হিসেবে মনির ভাই আমাদের নিকট পরিচিত। মুসলিম লীগ করেই তিনি রাজনীতিতে নাম লেখান। তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের সঙ্গে যুক্ত। ফলে মুসলিম লীগের কায়েমী স্বার্থবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে গোড়া থেকেই তাঁর বিরোধ ছিল।
মনির ভাই আটচল্লিশ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমলের সবক’টি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। ’৪৮ সালে বাংলা ভাষার সমর্থনে গোবিন্দচরণ পার্কে এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছিলো। পরবর্তীকালে গোবিন্দচরণ পার্ক হাসান মার্কেটে রূপান্তরিত হয়। মুসলিম লীগের গুন্ডাবাহিনী সন্ত্রাসের মাধ্যমে জনসভা পন্ড করে দেয়। যে ক’জন সাহসী যুবক সেদিন গুন্ডাদের রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, মনির ভাই ছিলেন তাদের অন্যতম।
নিজেকে জাহির করার বা প্রকাশ করার লোভ মনির ভাই’র মধ্যে ছিলো না। কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করতে তিনি দায়িত্বশীলভাবে অন্যদের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন, সক্রিয়ভাবে কাজ করতেন। এসব তিনি ঠিকই করতেন কিন্তু সবই করতেন নিরবে। পার্টি গড়ে তুলতে, পার্টির বৈঠক, আলোচনায় তাঁর জ্ঞান-প্রজ্ঞা নিয়ে ঠিকই তিনি অবদান রাখতেন। কিন্তু মঞ্চ, মাইক এসবের প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিলোনা।
পাকিস্তানি শাসনামলেই মনির ভাই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। পরে তিনি ন্যাশনাল পার্টি (ন্যাপ) করলেও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি তাঁর অটুট ছিল। মনির ভাই’র প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বেশি ছিল না। তিনি থিওরি বা পুঁথির বিদ্যা নিয়ে কচকচানি করতেন না। কিন্তু তাঁর ছিল অগাধ রাজনৈতিক জ্ঞান ও বাস্তব অভিজ্ঞতা। আর এই কারণে রাজনৈতিক ঘটনাবলী ও জটিল পরিস্থিতি তিনি খুব সহজ ও বোধগম্য করে বিশ্লেষণ করতে পারতেন। গ্রুপ বৈঠক বা শাখার বৈঠকে তাঁর বক্তব্য ও উপস্থাপনা কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সহজেই প্রভাব বিস্তার করতো।
পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর পার্টির এক বৈঠকে মনির ভাই বলেছিলেন, একদলীয় শাসন ঠেকানো বা তথাকথিত গণতন্ত্র রক্ষার নামে এই নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটলেও আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, অর্জিত সুফল ও সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেশকে প্রতিক্রিয়ার পথে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র থেকেই তা করা হয়েছে। ক্রমে ক্রমে আজ হোক কাল হোক এই চক্রান্ত ধরা পড়বেই জনগণের কাছে।
স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট ও সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে অনবরত বলতে থাকেন তিনি এসেছেন গণতন্ত্র রক্ষা করতে, জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। জিয়া আরো বলেন, প্রয়োজন ফুরালেই তিনি জনগণের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে স্বস্থানে ফিরে যাবেন। এ সময় আমরা কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মী পরিস্থিতি বুঝার জন্য মনির ভাই’র বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখন তিনি বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান খুব সুন্দর সুন্দর কথা ও গালভরা বুলি আওড়াচ্ছেন। এই বুলির আড়লে তার মধ্যে আমি এক ভয়ঙ্কর উচ্চাকাঙ্খা লক্ষ্য করছি। জিয়া স্বস্থানে ফিরে যাবেন না। তিনি ক্ষমতা আকড়ে থাকবেন। ক্ষমতায় থাকার জন্য কথা পাল্টাবেন, নতুন যুক্তি দেবেন এবং বৈধ-অবৈধ সবকিছু করবেন। এমনকি ক্ষমতার মসনদ ঠিক রাখার জন্য নিজস্ব রাজনৈতিক দলও গঠন করতে পারেন। এ সময় মনির ভাই ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দ্রষ্টা হয়ে ওঠেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল গঠনের সময় সব কিছু মেনে নিয়েও তিনি কিছু দূরদর্শী মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতা রক্ষা ও দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের ধারা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশী-বিদেশী শত্রুর নাশকতামূলক তৎপরতা প্রতিহত করার জন্যে এরকম বিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু কথা হলো এই বিপ্লবী পদক্ষেপ ও বিভিন্ন কর্মকান্ড সফল করে তোলার জন্যে যে কর্মীবাহিনীর দরকার তা কি আছে? তাছাড়া রাজনীতি ও সংগঠনগতভাবে আওয়ামী লীগ সে রকম শক্তিশালী দলও নয়।
ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্টি আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়লে মনির ভাইকে সঠিক অবস্থান বেছে নিতে একটুও কালক্ষেপণ করতে হয়নি। তিনি প্রথম থেকেই মস্কো লাইনের প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করে আসছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) ভাঙ্গন দেখা দিলে সে ক্ষেত্রেও মনির ভাই মোটেই দেরি করেননি বা অন্য অনেকের মতো দ্বিধা-দ্বন্দেও ভুগেননি। তিনি সরাসরি মস্কো লাইন সমর্থন করেন।
আমাদের রাজনৈতিক ভুবনে মনির ভাই’র মতো রাজনীতিবিদের যতবেশি আবির্ভাব ঘটবে আমাদের দেশের রাজনীতিও এগিয়ে যাবার সম্ভাবনা তত বেশি সমৃদ্ধ হবে।