সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি
হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে বাড়ছে পানি ॥ নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জুন ২০২২, ৬:০৩:২০ অপরাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার : সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে পানি বাড়ছে। প্লাবিত হচ্ছে আরো নতুন নতুন এলাকা। সিলেট নগরীর শাহজালাল উপশহর, তেররতন, কুয়ারপাড়, লালাদীঘির পাড়, মির্জাজাঙ্গাল, লামাবাজার, তালতলা এলাকায় পানি আগের অবস্থানে রয়েছে। এখনও নৌকা চলাচল করছে নগরীর নিচু এলাকাগুলোতে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বুধবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত সিলেটের পাঁচটি স্থানে নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ৯৫ সেন্টিমিটার, সিলেটে সুরমা ২৮ সেন্টিমিটার, আমলসিদ পয়েন্টে কুশিয়ারা ১০৯ সেন্টিমিটার, শেওলায় কুশিয়ারা ৬৫ সেন্টিমিটার এবং ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা ১১৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আমাদের জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিরা জানান, বন্যা উপদ্রুত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট বিরাজ করছে। সেই সাথে দেখা দিয়েছে গো খাদ্যের চরম সংকট। নৌকা না থাকায় অনেকেই গৃহ বন্দি হয়ে পড়েছেন। আবার হাওর পারের কোনো কোনো আশ্রয় কেন্দ্রেও পানি উঠতে শুরু করেছে। সুনামগঞ্জে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ লাইন মেরামত করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক বিদ্যুৎ কর্মীর মৃত্যু হয়েছে।
জৈন্তাপুর ঃ জৈন্তাপুর (সিলেট) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, জৈন্তাপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতি হয়েছে। ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে চারিকাটা, জৈন্তাপুর, দরবস্ত, ফতেপুর ও চিকনাগুল ইউনিয়নের নীচু এলাকার অনেক বাড়িঘরে এখনও পানি রয়েছে। নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে, পানি বন্দি মানুষের কষ্টের শেষ নেই। উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে এখনও কয়েক হাজার মানুষ অবস্থান করছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে শুকনো খাবারের পাশাপাশি আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। বন্যায় উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের বহু মানুষের বসতবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল বশিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা তৈরী করা হচ্ছে।
কানাইঘাট ঃ কানাইঘাট (সিলেট) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, কানাইঘাট উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে তাৎক্ষণিক উপজেলা প্রশাসন, আওয়ামীলীগ, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় করেছেন কানাইঘাট-জকিগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ¦ হাফিজ আহমদ মজুমদার। কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন শেষে গতকাল বুধবার দুপুরে উপজেলা সভা কক্ষে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সংসদ সদস্য আলহাজ¦ হাফিজ আহমদ মজুমদার উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ প্রশাসনের কর্মকর্তা, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি ও সূধীজনদের সাথে কথা বলেন।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মুমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাজমুল ইসলাম হারুনের পরিচালনায় মতবিনিময় সভায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন্ত ব্যানার্জি, জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মস্তাক আহমদ পলাশ, উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, এবারের বন্যায় গোটা উপজেলার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বন্যার হাত থেকে কানাইঘাটবাসীকে রক্ষা করতে হলে সুরমা নদীর ভাঙন কবলিত ডাইকগুলো উঁচু করে টেকসই বাঁধ নির্মাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত ভাঙনের সম্মুখীন সুরমা ডাইকগুলো মেরামত কানাইঘাট-দরবস্ত, গাজী বোরহান উদ্দিন ও কানাইঘাট-সুরইঘাট সড়কে ভয়াবহ বন্যায় বড় বড় ভাঙনের স্থানগুলো সংস্কার করে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার এবং পর্যাপ্ত সরকারি ত্রাণ সামগ্রি বিতরণের দাবি জানান তারা। এ সময় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পৌর মেয়র লুৎফুর রহমান, সহ সভাপতি জামাল উদ্দিন, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান খাদিজা বেগম সহ আওয়ামীলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া, গতকাল বুধবার কানাইঘাটে বন্যার্ত পরিবারে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিতে প্রশাসনের সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সুনামগঞ্জ ঃ সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হলেও শহরের অধিকাংশ ঘরবাড়ি এখনও পানির নীচে। বিদ্যুৎ সঞ্চালন পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় লোকজন চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। গতকাল বুধবার বিকেলে পৌর শহরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ লাইন মেরামত করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক বিদ্যুৎ কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। শহরের হোসেন বখত চত্বরে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত বিদ্যুৎ কর্মী তফসিরুল আলম জুম্মান ধর্মপাশা উপজেলা পাইকুরাটি ইউনিয়নের রেখাইজুরা গ্রাামের বাসিন্দা আলী হোসেনের ছেলে। সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রফিকুল ইসলাম বিদ্যুৎ কর্মীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তাহিরপুর ঃ তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, বন্যায় তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়ক থেকে শুরু করে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামীণ সড়কে ভাঙন ও খানাখন্দ দেখা দিয়েছে। পানি নেমে যাওয়ায় দৃশ্যমান হচ্ছে এসব ভাঙাচোরা। এক সপ্তাহ পূর্বেও তাহিরপুর উপজেলা থেকে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে সড়কপথে পৌঁছতে মাত্র ৪০ মিনিট সময় লাগতো। যেখানে প্রতি যাত্রীর খরচ হতো ১শ টাকা, সেখানে বন্যা হওয়ার পর থেকে জেলা শহরে পৌঁছতেই চলে যায় প্রায় সারাদিন। যাত্রীদের ব্যয় হচ্ছে তিনগুণ টাকা।
সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ (সওজ) সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের বিভিন্ন স্থান ভেঙে গেছে। বন্যার শুরু থেকে গত সপ্তাহ দিন ধরে জেলা শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে তাহিরপুর উপজেলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চালবন, শক্তিয়ার খলা, বালিজুরি, আনোয়ারপুর সড়কের। তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি থাকা একাধিক রোগী জানান, তাদের শারীরিক অসুস্থতা গুরুতর হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলেও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় চিকিৎসার জন্য সুনামগঞ্জ-সিলেট যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকার হকার শ্যামল বর্মন বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে তাহিরপুর উপজেলায় কোনো পত্রিকা পৌঁছায়নি। তাহিরপুর উপজেলা প্রকৌশলী মো. ইকবাল কবির বলেন, পাহাড়ি ঢলের তান্ডবে রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আমরা ভেঙে যাওয়া রাস্তা দ্রুত মেরামত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রায়হান কবির বলেন, বন্যায় ভেঙে যাওয়া তাহিরপুর উপজেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে খুব শীঘ্রই মেরামত কাজ শুরু করে যান চলাচলের উপযোগী করে তোলা হবে।
মৌলভীবাজার ঃ মৌলভীবাজার থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, মৌলভীবাজারে হাওরঅঞ্চলে পানি বাড়ছে। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন হাওর পারের কয়েক লক্ষ বাসিন্দা। বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গো খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। নৌকা না থাকায় অনেকেই গৃহ বন্দি হয়ে পড়েছেন। আবার হাওর পারের কোনো কোনো আশ্রয় কেন্দ্রেও পানি উঠতে শুরু করেছে। তবে আশার দিক হলো ইতোমধ্যে জেলার নদীগুলোতে পানি কমতে শুরু করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার হাকালুকি, কাউয়াদীঘি ও হাইল হাওরে দ্রুত গতিতে পানি বাড়ছে। জেলার জুড়ী উপজেলার শাহপুর এলাকা থেকে সাইফুল ইসলাম বলেন, ওই গ্রামের প্রায় ৯০ শতাংশ বাড়িতে পানি উঠেছে। আশ্রয় কেন্দ্রে গাদাগাদি করে বন্যার্তরা বসবাস করছেন। শহরের আশাপাশ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হলেও প্রত্যন্ত এলাকায় কেউ যাচ্ছে না। যার ফলে গ্রামের মানুষের মধ্যে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।
কুলাউড়া ঃ কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল গ্রামের জাবেদ আহমদ বলেন, পানি বাড়ার সাথে সাথে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। অধিকাংশ বাড়ির টয়লেট তলিয়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছেন বাসিন্দারা। আবার কেউ কেউ বিশুদ্ধ খাবার পানি পাচ্ছেন না। বিশেষ করে বেশি সমস্যা হচ্ছে যোগাযোগের ক্ষেত্রে। নৌকা ছাড়া কেউই বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না। সরকারি ত্রাণ সহায়তা নেই বললেই চলে।
রাজনগর ঃ সরেজমিন রাজনগর উপজেলার সুয়াইজুড়ি গ্রামে গেলে দেখা যায়, পানি বাড়ায় বাসস্থান নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে গবাদিপশু নিয়ে মানুষ বিপাকে পড়েছেন। কোথায় নিয়ে যাবেন কোনো ঠাই পাচ্ছেন না। বিশেষ করে ঘরে পানি উঠে যাওয়ায় রান্না করতে পারছেন না অনেকেই। কেউ কেউ ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে পানির উপরে ভাসমান চুলায় রান্না করছেন।
হবিগঞ্জ ঃ হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, হবিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গতকাল বুধবার ২৪ ঘন্টায় নতুন করে আরো ৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এ নিয়ে ৭টি উপজেলার ৫১টি ইউনিয়ন এখন বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলো হচ্ছে, বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ, নবীগঞ্জ, লাখাই, হবিগঞ্জ সদর, বাহুবল ও মাধবপুর। এর মধ্যে আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং ও লাখাই উপজেলার সবকটি ইউনিয়নে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। ভাটি অঞ্চলে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্র জানায়, বন্যা কবলিত এলাকায় ২২৫টি আশ্রয় কেন্দ্রে ১৭ হাজার ৩শ ৪৭ বন্যার্ত আশ্রয় নিয়েছেন। ২৩ হাজার ২শ’ ৩৫টি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। ৭৯হাজার ৭শ’ ২০জন লোক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও বেসরকারী হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা দ্বিগুন। জেলা প্রশাসন এ পর্যন্ত বন্যা কবলিত এলাকায় ২০০ মেট্রিক টন চাল, ১০ লক্ষ টাকা নগদ এবং ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, গতকাল বুধবার দুপুরে খোয়াই ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও আজমিরীগঞ্জে কালনী-কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ১৪৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।