হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ আগস্ট ২০২২, ৭:২৩:১৮ অপরাহ্ন

দুলাল শর্মা চৌধুরী
শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলা হয়। কেন তিনি জাতির পিতা? এসব প্রশ্নে কারো কারো সংশয় থাকতে পারে, থাকতে পারে ভিন্নমত, কিন্তু ইতিহাস ও রাষ্ট্র দর্শনের তাত্ত্বিক বিচারে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন নয়। কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষ শত সহস্র বছরের নানা উপাদান, নানা ক্ষেত্রের প্রতিভাবানের তাৎপর্যপূর্ণ অবদানে ধীরে ধীরে একটি জাতি হিসেবে বিকশিত হয়ে ওঠে, এবং কোনো একটা যুগে সেই জাতি তার সামাজিক সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও রাষ্ট্রসত্তাগত চেতনার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে।
দেশের সর্বস্তরের বিপুল মানুষের মনে এই সর্বোচ্চ চেতনার স্তর সৃষ্টিতে যে নেতার প্রধান ভূমিকা থাকে এবং সে ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত হয়ে যখন তা একটা যুগ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় তখনই কোনো জাতি বা জনগোষ্ঠীর মাহেন্দ্রক্ষণ। বাঙালি জাতির জীবনে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ। আর সেই চূড়ার ওপর দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বাঙালি জাতি হাজার বছর ধরে এই ঘোষণার অপেক্ষায় ছিল। আর এই জন্যই শেখ মুজিব হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। কারণ, তিনি বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নের এবং অন্তরের অন্তস্থলে গুমরে মরা স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন সেদিন। যুগের দাবিকে, সাহসে শৌর্যে, বীর্যে ভাষা দিয়েছিলেন তিনি, দখলদার বাহিনীর কামান, বন্দুক, হেলিকপ্টার গান শিপের যে- কোনো মুহূর্তে গর্জে ওঠার ভয়াল পরিস্থিতির মুখে। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো নেতা এমন জটিল পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে এতো অকুতোভয়ে স্বাধীনতার কথা উচ্চারণের সাহস করেননি। এই নজীর বিহীন ঘটনার জন্যই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা, নিজস্ব রাষ্ট্রসত্তাগত বাঙালি জাতির পিতা এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্রষ্টা।
তার চেয়ে প্রতিভাবান ও বহুগুণে গুণান্বিত বাঙালি অনেকেই ছিলেন, তবু যে তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও আধুনিক রাষ্ট্র নায়ক তার কারণ, তিনি হাজার বছরের বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে জীবনরূপী একনিষ্ঠ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা কারা যন্ত্রণা ভোগ করেই বাস্তবরূপ দিয়েই বাঙালির চেতনাকে করেছেন জাগ্রত। শিল্প বলুন, সাহিত্য বলুন, বিজ্ঞান বলুন, বা রাজনীতি প্রযুক্তি যাই বলুন কোনো কিছুই স্বাধীনতার চেয়ে বড় নয়। ওইসব বিষয়ে সিদ্ধিলাভ, আর এক অসংগঠিত জাতিকে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যে সময়োপযোগী মোক্ষম কর্মসূচির মাধ্যমে ধীরে ধীরে, ধাপে, ধাপে ঐক্যবদ্ধ করে মরণপণ মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে আধুনিক মারণাস্ত্র সমৃদ্ধ দখলদার বাহিনীর কব্জা থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে উপহার দেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, তাই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
১৯২০ এর ১৭ই মার্চ, এই মহান নেতার জন্ম হয়েছিল, গোপালগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। বিস্তীর্ণ মধুমতি নদী আর সবুজ বনান্তের আড়ালে কেটে গিয়েছে তাঁর দুরন্ত শৈশব আর কৈশোরকাল।
বাংলার জল-মাটি-হাওয়ায়, হাজার বছরের ঐতিহ্য সংস্কৃতির আবেগে গড়ে উঠেছে তাঁর মনোজগত। স্বদেশ প্রেমের উপলব্ধিতেই তিনি রূপসী বাংলাকে দেখেছেন। অসীম আকাশের মত মুক্ত হৃদয় নিয়ে ভালোবেসেছেন বাংলার মানুষ, সাগর, নদী, পাহাড়, পশু-পাখি-মাঠ-ঘাট আর অনাবিল প্রকৃতিকে। সাংবাদিক সিরিল ভান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে সেই কারণেই বলেছিলেন, বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমানই একমাত্র নেতা যিনি ভাষায়, সংস্কৃতিতে জন্মসূত্রে এবং জাতিসত্তার এক পরিপূর্ণ বাঙালি।
আর এই মন্তব্য উচ্চারিত হওয়ার মূলে ছিল বঙ্গবন্ধুর নিখাদ দেশপ্রেম। বাংলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, সাধারণ মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার টানেই মাতৃভূমি এবং জনমানুষের কল্যাণে তিনি আজীবন অকাতরে জীবন, যৌবন, মেধা, মননকে বিলাতে পেরেছেন। পাকিস্তানী শাসকদের নিষ্ঠুর নিপীড়ন, অন্যায়-অত্যাচার উপেক্ষা করেছেন শারীরিকভাবে। তুচ্ছ তৃণের মত ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন মৃত্যুর নিশ্চিত পরোয়ানাকে। হাজার বছরের রূপসী বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ভালোবেসে একদিকে তিনি আবেগের তরল স্রোতে ভেসেছেন। অন্যদিকে যুদ্ধরত সৈনিকের মতই নির্মোহ জবাবদিহিতার দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়ে স্বদেশবাসীর কল্যাণের জন্য উঠেছেন অকুন্ঠভাবে নির্ভীক। নেতৃত্বের এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্য মুগ্ধ করেছে জাতিকে। বিস্মিত করেছে আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে।
আজ থেকে একশো বছর আগে যে অখ্যাত গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন, সে গ্রাম বাইরের বিশ্বে তো বটেই, দেশবাসীর কাছেও ছিল নিতান্ত অপরিচিত। সেই গ্রামই পরবর্তীকালে তাঁর আবির্ভাবে পেয়েছিল বিশ্বপরিচিতির গৌরব। কোটি অন্তরে ভালোবাসায় অভিভূত হয়েছিল টুঙ্গিপাড়া। সপরিবারে তাঁর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পরে ১৯৭৫ থেকে ৯৫ অবধি তাঁর সব অবদানই আচ্ছাদিত থেকেছে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কূটিল ষড়যন্ত্রের আড়ালে। কিন্তু সত্য তো কখনও মানুষকে বঞ্চনা করতে জানে না। বহু বছর পরে পরিবর্তিত পটভূমিতে বঙ্গবন্ধু তাই তাঁর বিশাল সত্যসমেত জেগে উঠেছেন পূণর্বার। মাতৃভূমি ও স্বদেশবাসীর কল্যাণের জন্য যিনি নিঃশেষে জীবন দান করেছেন, তাই তো তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে অনাবিল ভালোবাসায়, অন্তরের কৃতজ্ঞতায়, অসীম শ্রদ্ধায়, গৌরবে ভরিয়ে দিতে জাতিও কোনও কার্পণ্য রাখেনি একটু। ২০২০ এর ১৭ই মার্চ থেকে ২০২১ এর ২৬শে মার্চ অবধি মহাসমারোহে পালিত হয়েছে বাংলাদেশের সব আপদময় এবং অন্ধকার ঘটনাপুঞ্জের প্রতিটি অধ্যায়। এই সুনির্দিষ্ট সময়টুকু ইতিহাসের পাতায় যাতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতই ভাস্বর হয়ে থাকে, সেই জন্য নির্দিষ্ট বছরটি চিহ্নিত হয়ে থাকবে মুজিববর্ষ হিসেবে।
বাংলাদেশের স্থপতি অত্যাচারিত জাতির মুক্তিদাতা হিসেবে যতখানি প্রশংসিত, ততটাই শ্রদ্ধেয় জাতির পিতা হিসেবে। কারণ বাইরের ধর্মের সংকীর্ণ গন্ডীর বাইরে দাঁড়িয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোয় তিনি নিজে যেমন আলোকিত হয়েছিলেন, তেমনি সবদিক থেকে পিছিয়ে থাকা কয়েক কোটি মানুষকেও পিতার মত নিবিড় স্নেহে এক স্বপ্নের সুতোয় বেঁধেছিলেন। এই অবদানই তাঁকে চিরঅম্লান করে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তাই শ্রদ্ধাভরে যোগ দিয়েছে বিশ্বনেতারা। স্বীকৃতি হিসেবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির পরিচয়ে তিনি গৌরবোজ্জ্বল হয়েছেন। অথচ এই স্বদেশ প্রেমিক নিঃস্বার্থ নেতাকেও চক্রান্তের আঁতাতে বিপর্যস্ত হতে হয়েছে বারবার। যুদ্ধ বিধ্বস্ত, দুঃস্থ, দরিদ্র সদ্য স্বাধীন জন্মভূমিতেও তার বিদেশনীতি থেকে অর্থনীতি, রাজনীতি থেকে সামরিক পলিসি সম্পর্কে হীন ব্যাখ্যা আর মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে দেশ এবং জাতিকে বারবার বিভ্রান্ত করা হয়েছে। আর এই বিচিত্র বিরোধিতার চরম পরিণতিতেই হত্যাকারীরা সঞ্চয় করেছে হত্যা করার দুঃসাহস।
দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কারণে অনাকাক্সিক্ষত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পৃথিবীতে বিরল নয়। রাজনৈতিক হত্যাকান্ড বহুবার বদলে দিয়েছে পৃথিবীর ইতিহাস। কিন্তু বাংলাদেশে ’৭৫-এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে জেলখানার অভ্যন্তরে জাতীয় নেতাদের হত্যাযজ্ঞের যে নারকীয় ঘটনা, সামরিক বিচারের প্রহসনে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের জীবননাশের ট্র্যাজিক ইতিহাস, বিরাট পাপাচারের এমন দৃষ্টান্ত জগতে আর কোথাও নেই।
কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের হত্যাযজ্ঞ বঙ্গবন্ধুর অমরত্বের পথ প্রতিরোধ করতে পারেনি। তিনি বেঁচে আছেন। তিনি বেঁচে থাকবেন ভবিষ্যতে। যখনই আসবে দুঃসময়, অনুপ্রাণিত করবেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়ে। এভাবেই বঙ্গবন্ধু বাংলার বাঙালির। তিনি বাঙালি জীবনে হিরন্ময় জ্যোতি। ইতিহাসের পাতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চির অম্লান। শোক দিবসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : প্রাবন্ধিক।