logo
৮ই মার্চ, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ | ২৩শে ফাল্গুন, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ
  • হোম
  • আজকের পত্রিকা
    • প্রথম পাতা
    • শেষ পাতা
  • সিলেট বিভাগ
    • সিলেট
    • সুনামগঞ্জ
    • হবিগঞ্জ
    • মৌলভীবাজার
  • অনলাইন
  • জাতীয়
  • আন্তর্জাতিক
  • ক্রীড়া
    • ক্রিকেট
    • ফুটবল
    • অন্যান্য খেলা
  • ডাক বিনোদন
  • প্রবাস
  • শিক্ষা
  • ধর্ম ও জীবন
    • ইসলাম
    • অন্যান্য
  • মুক্তমত
  • সম্পাদকীয়
  • অন্যান্য
    • সাহিত্য
    • মুক্তিযুদ্ধ
    • স্বাস্থ্য
    • শিশু মেলা
    • ইতিহাস- ঐতিহ্য
    • সাজসজ্জা
    • লাইফস্টাইল
    • মহিলা সমাজ
    • পাঁচ মিশালী
    • আমাদের পরিবার
  • হোম
  • আজকের পত্রিকা
  • প্রথম পাতা
  • শেষ পাতা
  • সিলেট
  • মৌলভীবাজার
  • সুনামগঞ্জ
  • হবিগঞ্জ
  • অনলাইন
  • জাতীয়
  • আন্তর্জাতিক
  • বিশেষ প্রতিবেদন
  • মুক্তমত
  • ফিচার
  • অন্যান্য দেশ
  • যুক্তরাজ্য
  • যুক্তরাষ্ট্র
  • অর্থনীতি
  • করোনা
  • ক্রীড়া
  • অন্যান্য খেলা
  • ক্রিকেট
  • ফুটবল
  • স্থানীয় ক্রিকেট
  • ডাক বিনোদন
  • ধর্ম
  • অন্যান্য
  • ইসলাম
  • পাঁচ মিশালী
  • প্রবাস
  • বিজ্ঞপ্তি
  • মহিলা সমাজ
  • মাল্টিমিডিয়া
  • মুক্তিযুদ্ধ
  • লাইফস্টাইল
  • ইতিহাস- ঐতিহ্য
  • শিশু মেলা
  • সাজসজ্জা
  • শিক্ষা
  • সম্পাদকীয়
  • সাহিত্য
  • শিল্প
  • স্বাস্থ্য
  • আমাদের পরিবার
শিরোনাম
  • করোনায় একদিনে ১৪ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৮৪৫
  • শিবগঞ্জে অটোরিকশায় ছিনতাইয়ের চেষ্ঠা, গ্রেফতার ৩
  • সিলেটে ফুটপাতে মিললো বস্তাভর্তি জাতীয় পরিচয়পত্র
  • খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ বাড়ছে আরও ৬ মাস
  • ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের শোষিত-নির্যাতিত মানুষের মুক্তি আন্দোলনের আলোকবর্তিকা
  1. হোম
  2. সাহিত্য

‘হিম শিতল স্পর্শ’: একটি পর্যালোচনা


সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ জানুয়ারি ২০২১, ৩:৫১:১৭ অপরাহ্ন
‘হিম শিতল স্পর্শ’: একটি পর্যালোচনা

সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝর
নিভৃতচারী লেখক আবদুস সবুর মাখন। মূলত কবি ও গীতিকার হিসাবে সমধিক পরিচিত। আশির দশকে সিলেটের সাহিত্য জগতে আবির্ভাব। একাধারে গীতিকার, কবি, ছোটগল্পকার এবং সর্বোপরি একজন প্রথিতযশা পেশাগত সাংবাদিক। সাহিত্য জগতে প্রবেশের অনেক পরে তাঁর কয়েকটি গল্প নিয়ে বের হলো ‘হিম শিতল স্পর্শ’। অনেক দেরিতে গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হবার একটি বড় কারণও বোধ হয় এই নির্ভৃতচারীতা। আবদুস সবুর মাখন এর লেখা মানেই গভীর জীবনবোধ, দেশজ ছোঁয়া, অসম্ভব প্রকৃতি প্রেম, রোমান্টিকতা, আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যাওয়া, সব ধরনের কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসা ইত্যাদি অনেক বিষয়ের একত্র গাঁথুনি। প্রথাগত চিন্তায় তাঁর লেখা আঘাত হানে যেন। চমৎকার সব উপমা বা রূপকের মাধ্যমে তিনি সমাজ, চারপাশ ও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে ফুটিয়ে তুলে পরিশেষে জীবনের জয়গান গেয়েছেন এ গ্রন্থের প্রতিটি গল্পে।
ছোটগল্পের সবকটি বৈশিষ্ট ‘হিম শিতল স্পর্শ’ গ্রন্থে বিরাজমান। পাঠকদের কোনভাবেই পড়তে বেশি সময় লাগবে না। প্রতিটি গল্পের বিষয়বস্তু ও ভাষা একটির থেকে আরেকটি আলাদা। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হচ্ছে, একবার গল্পগুলো পড়া শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না। গল্পগুলোই তার আপন গতিতে মনের অজান্তে পাঠকের চোখকে টেনে নিয়ে যায় গল্পের সমাপ্তির দিকে।
এ গল্পগ্রন্থের প্রায় সবগুলো গল্পই বেশ ছোট ছোট। আর গল্পের নামকরনেও আছে আলাদা এক বৈশিষ্ট। এমনকি গল্পের চরিত্রগুলোর নামকরণে লেখকের রোমান্টিক ভাবটা ধরা পড়ে। গল্পগ্রন্থের আরেকটা বৈশিষ্ট হচ্ছে দেশের সনাতন ধর্মের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবনকে উপজীব্য করে গল্প রচনা। সাধারণত বাংলাদেশের সাহিত্যে খুব কমই সনাতন ধর্মের মানুষদের মূল উপজীব্য করে গল্প, উপন্যাস বা নাটক লেখা হয়। সেদিক দিয়েও এ গল্পগ্রন্থটি বেশ ব্যতিক্রম।
‘হিম শিতল স্পর্শ‘ গল্পগ্রন্থের বেশিরভাগ গল্পজুড়েই আছে প্রকৃতি, চারপাশের চেনাজানা মানুষ, অন্ধকার, প্রেম,বিরহ,বিচ্ছেদ, নিস্তব্ধতা, জীবনের ধ্রুব সত্য ও অবধারিত মৃত্যু। সত্যিকার অর্থে তাঁর ঐ গল্পগুলো লেখক ও পাঠকের জন্য এক সম্পদই বটে। গল্পগুলোতে এমনভাবে স্থানকালের বর্ণনা দেয়া আছে যে, মনে হয় পাঠকের চোখের সামনে সত্যি সত্যি সব ঘটনা ঘটে চলেছে। লেখকের গল্প বলার ধরনে গল্পের চরিত্র ও স্থান-কাল যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। তবে গল্পের সবচেয়ে অনবদ্য যে বিষয়টি পাঠকদের নজর কাড়বে, সেটি হচ্ছে গল্প বর্ণনায় কাব্যময়তা। গল্পলেখক খাসা কবি বলেই তাঁর গল্পভাষা এক ধরনের ঝরঝরে কাব্যময়তা তৈরি করে। ছোট ছোট এক একটা গল্পের মধ্যে লেখক প্রকৃতিকে তুলে এনেছেন অত্যন্ত চমৎকারভাবে, মায়াময়ভাবে ও অত্যন্ত জীবন্তভাবে। গ্রাম বাংলা, চাঁদ, জোছনা, বৃষ্টি, আলো-আঁধারের খেলা ইত্যাদি মায়াবী রোমান্টিক ব্যাপারগুলো তাঁর প্রতিটি গল্পেই লক্ষ্য করা যায়। আমাদের চারপাশের দেখা সাধারণ প্রকৃতি লেখকের বর্ণনাগুণে খুবই স্নিগ্ধ রূপ লাবণ্যময় আকারে পাঠকের কাছে ধরা দেয়।
এখানে একটি কথা না বললেই নয়। আজকাল অনেকে অভিযোগ করেন, বাংলা সাহিত্যে ভাল গল্পের অভাবে দেশে নাটক/চলচ্চিত্রের গল্পের অভাব দেখা দিয়েছে। সেজনই নাকি দেশের অনেক টিভি চ্যানেলে যাচ্ছেতাই নাটক তৈরি হচ্ছে। আবদুস সবুর মাখনের এ গল্পগুলো মনযোগ দিয়ে পড়ার পর আমি মেধাবী নাট্যকারদের অনুরোধ করবো- এ গল্পগুলো পড়ার জন্য। আমি তো খুব দৃঢ়ভাবে বলবো যে, এ গল্পগ্রন্থের ১৩টি গল্প থেকে চমৎকার ১৩টি টিভি নাটক তৈরি করা যায় অনায়াসে। গল্পগ্রন্থ পড়ার পর আমি ব্যক্তিগতভাবে এতই অনুপ্রাণিত হয়েছি যে, ইতোমধ্যে দুটো ছোটগল্প থেকে (লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে) নাটক করার জন্য ‘চিত্রনাট্য’ তৈরি করে ফেলেছি। আশা করছি করোনার তান্ডব কমলে আমরা নাটকগুলো তৈরিতে কাজে নেমে পড়তে পারবো।
‘হিম শিতল স্পর্শ’ গল্পগ্রন্থে মোট ১৩টি গল্প সন্নিবেশিত হয়েছে। গল্পগ্রন্থে ধারাবাহিকভাবে গল্পগুলো এভাবে সাজানো হয়েছে ডিগবাজি, স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্নের ঘর, হিমশীতল স্পর্শ, সামলে রাখো জোসনাকে.., সে, সেঁজুতি, মুক্তিযোদ্ধার জবানবন্দী, অনিন্দ্য মুখোশ, দূরে… আরও দূরে.., চাঁদহীন আকাশ, রক্তিম সূর্য, নাহিদের স্বপ্ন, বিবর্ণ আলো।
গল্পগ্রন্থে প্রথম যে গল্পটি স্থান পেয়েছে সেটি হচ্ছে ‘ডিগবাজি’। গল্পটার মূল কথা হচ্ছে দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কারো সাথেই কোন আপোস নেই। গল্পে দেখা যায় ঢাকা থেকে সিলেটগামী একটি ট্রেনে গল্পের নায়ক শায়নের সাথে নায়িকা শান্তার পরিচয় হয়। অবিবাহিত। গল্পটা আর দশটা প্রচলিত গল্প থেকে অনেক আলাদা। যদিও অবধারিতভাবে নায়ক ও নায়িকার মাঝে হৃদয়গঠিত ব্যাপারস্যাপারের আদান প্রদানের ব্যাপার আছে। গল্পের উপস্থাপনা গল্পটিকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। দেখা যায় নায়ক একজন পরিপক্ক মানুষ। এখানে কিন্তু নায়কের বয়স ২৫/২৬ বছর নয়। নায়কের বয়স ৪৮। নায়িকার বয়স ত্রিশের নিচে। ট্রেন যাত্রার বেশ পরে তাদের মধ্যে হৃদ্যতা হয়। দু’জন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দু’জনকে নিয়ে। এক পর্যায়ে যখন আবিস্কার হয় যে নায়িকার বাবা একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন রাজাকার ছিলো, তখন নায়ক সেটা মেনে নিতে পারে না। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে, এক সমমনা সঙ্গিনী পেয়েও নায়ক তাকে প্রত্যাখ্যান করে আজীবনের জন্য। যদিও এখানে নায়িকার কোন অপরাধ নেই, তবুও নায়ক ‘রাজাকারের মেয়ে’ হিসাবে নায়িকাকে মেনে নিতে পারে না। অবধারিতভাবে গল্পটা ট্রেজিডির দিকে মোড় নেয়।
‘ডিগবাজি’ গল্প থেকে কিছু অংশ তুলে দেবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। যেমন, ‘মনে হচ্ছে যেন দূরে সবুজের ছায়াঘেরা গ্রামগুলোর পেছনেই আস্তে আস্তে সূর্যটা হারিয়ে যাচ্ছে। এই সময়টির অপেক্ষাই করছে শায়ন। কারণ সূর্য ডুবে যাওয়ার সাথে সাথে পূবাকাশে উঠবে চাঁদ; পূর্ণিমার চাঁদ। আর এই শরতের পূর্ণিমা রাতের অপরূপ দৃশ্য উতলা করে দেয় শায়নকে। বিকেলের ট্রেনে ভ্রমণ করার উদ্দেশ্যই হচ্ছে চলতি পথে বিকেলের প্রকৃতি আর জোসনা ধোয়া রাতের সৌন্দর্য্যে অবগাহন করা। শায়ন বাঁ হাতের কনুই জানালার রেলিংয়ে রেখে চেয়ে আছে বাইরে এক দৃষ্টিতে।’ পাঠকের জন্য বাকিটা বাকি রইলো।
গল্পগ্রন্থের দ্বিতীয় গল্প হচ্ছে, ‘স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্নের ঘর’। এ গল্পের বিষয়ও প্রেম। এখানেও গল্পলেখকের গল্পবলার স্টাইলে ও চরিত্র চিত্রনে মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। গল্পের শুরু সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। গল্পের নায়ক শাহান গেছে এয়ারপোর্ট থেকে তার বাবাকে আনতে। শাহান বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। শাহানের বাবা শাহরিয়ার সাহেব লন্ডন বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আজকে তিনি ফিরছেন। বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে করতে শাহান লন্ডন থেকে আসা এক তরুণীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। পরে দেখা যায় সেই তরুণী এসেছে তার বাবার সাথে একই প্লেনে, পাশাপাশি বসে। একটু পরে শাহানের বাবাই পরিচয় করিয়ে দেন ঐ তরুণীর সাথে। তার নাম চাঁপা। পরে জানা যায় লন্ডন থেকে চাঁপার মা চাপাকে একটু দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছিলেন শাহানের বাবাকে। সেই পরিচয় সূত্রে পরে শাহান ও চাঁপার যোগাযোগ হয়।
তরুণ বয়সে ‘চাঁপার মা’ পত্রমিতালী করতেন শাহানের বাবার সাথে। অজ্ঞাত কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে তাদের না পাওয়ার বেদনা দু’জনের ছেলেমেয়েদের দিয়ে পূরন করেন।
সংলাপপ্রধান এ গল্পে আছে আমাদের চোখে দেখা চারপাশের প্রকৃতি। লেখক এ গল্পে পত্রমিতার বাড়ির চারপাশ বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : ‘মাঠের পশ্চিম প্রান্তে হিজল, তমাল, বট, কদম ইত্যাদি বিশালায়তনের কয়েকটি বৃক্ষ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছায়া ফেলেছে। নিচে পড়ে আছে শুকনো পাতাগুলো। হাঁটতে থাকেন শাহরিয়ার আহমদ শুকনো পাতার ওপর। একে একে সবাই হাঁটা শুরু করে গাছের নিচে। শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনিতে মুখরিত হয় শীতের বিকেল। গুনগুনিয়ে শুরু করে দেন শাহরিয়ার আহমদ …… আয় আরেকটিবার আয়রে সখা প্রাণের মাঝে আয়, মোরা সুখের দুঃখের কথা কবো- প্রাণ জুড়াবে তায়…..।’ এ বর্ণনা পড়ার পর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ক্লাসিক গল্পকার ও ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘দিবাবসান’ গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। এ ধরনের হৃদয়কাড়া কাব্যিক ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে প্রায় সবকটি গল্পে।
এ গল্পে মূলত দু-জোড়া নায়ক নায়িকা। শাহরিয়ার সাহেব ও চাঁপার মায়ের মধ্যে পত্রমিতার মাধ্যমে লেখক মোবাইল ফোনের পূর্ববর্তী একটা যুগকে তুলে ধরেছেন। তখন পত্র-পত্রিকা থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে অনেক তরুণ তরুণী পত্র মিতালী করতো। এভাবে লিখতে লিখতে অনেক সময় সম্পর্ক মোড় নিতো বন্ধুত্ব থেকে প্রণয়ে। অনেকে আবার প্রতারিতও হতো। অনেক ছেলে, মেয়ে সেজে চিঠি লিখেও প্রতারণা করতো। এখন তো এমনিতেই চিঠি চালাচালি উঠে গেছে। চিঠির মধ্যে কিন্তু এক ধরনের নিজস্ব একটা আবেগ থাকতো, এক ধরনের স্পর্শ থাকতো, ভাললাগার আবেশ থাকতো। চমৎকার এ সুখপাট্য গল্পটি পাঠককে চিঠি চালাচালির সেইসব দিনগুলোতে অবগাহন করাবে।
গল্পগ্রন্থের শিরোনাম হয়েছে যে গল্প দিয়ে সেই ‘হিমশীতল স্পর্শ’ গল্পটি গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তৃতীয় হিসাবে। এ গল্পটি ট্র্যাজিক বা বিয়োগান্তক গল্প। গল্পে সমাজের খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের সাথে উঁচুতলার মানুষের যে পার্থক্য সেটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে জমিরুণ ও রাজিব চৌধুরী পরিবারের মধ্য দিয়ে। গল্পের মূল চরিত্র জমিরুন। সে থাকে সিলেট শহরের একটা বস্তিতে।
তরুণী জমিরুন কাজ করে চিত্তহীন বিত্তবান রাজিব চৌধুরীর বাড়িতে। গল্পের শেষ দিকে বন্যার পানিতে ডুবে বস্তির ঘরে একা একা জমিরুনের ছেলেটি মারা যায়। সন্তান মারা যাবার পর মা জমিরুনের মনের অবস্থা বুঝাতে লেখক এর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে: ‘শক্ত কংকালসার ছোট্ট নিথর দেহটিকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে নেয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে জমিরুন। চিৎকার দেয়। ঝড়ের গতি বাড়ে। শাঁ শাঁ শব্দে চাপা পড়ে যায় জমিরুনের গগনবিদারী আর্তনাদ।’ গল্পের শেষে জমিরনের হাহাকারের সাথে পাঠকেরও মনটা তখন মোচড় দিয়ে ওঠে। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মনের অজান্তে। ঝড়ের উপমার সাথে লেখক এখানে মূলত তরুণী মায়ের মনের প্রকৃত অবস্থা বোঝাতে চেয়েছেন।
‘সামলে রাখো জোসনাকে’ নামক গল্পে গল্পকার শাওন নামক যুবকের হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে মহিমান্বিত করে তুলেছেন। নায়ক শাওন তার পরিচিত লোকজ জীবন ছেড়ে শহরে এসে গতানুগতিক চাকুরী জীবন বেছে নেয় জীবনের তাগিদে। কিন্তু শহুরে জীবনে শান্তি পায় না। প্রাণ খুঁজে পায় না এখানে। সবই শাওনের কাছে কৃত্রিম মনে হয়। সে নষ্টালজিক হয়ে ওঠে। সেলুলয়েডের পর্দার মতো অর্হনিশি তার চোখে ব্যাকফ্লাশের মতো ভাসতে থাকে ফেলে আসা শৈশব, কৈশোর আর ভাললাগা সেই বীণাকে।
শাওনের কাছে বীনার তারের মতো ঝংকার তোলা এক নাম -বীণা। বীণা ছিল সনাতন ধর্মের। এ গল্পের মধ্যেও হৃদয় ব্যাকুল করা মিষ্টি কাব্যিক বর্ণনা আছে। যেমন-‘নদীর বুকে ঢেউয়ের দোলায় লুটোপুটি খাবে শরতের ভরা পূর্ণিমার চাঁদটি। কিন্তু নদী কই! এ তো এপার-ওপার কচুরিপানায় আচ্ছাদিত সবুজ প্রান্তর! নদী গুমরে কাঁদে। কেউ শুনে না। কাঁদে চাঁদ। জলের আবাহনের অপেক্ষায় তার বিমূর্ত সময় কাটে। ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়। চাঁদের সঙ্গে নদীর সখ্যতা জন্মাবধি। দেখেছে শাওন। দূর থেকে দেখেছে; কাছেও এসেছে বারবার। জোসনা ধোয়া স্বচ্ছ জলে সাঁতার কেটেছে কতো রাত স্বপ্নের ঘোরে।’
‘সে’ গল্পটি এ গল্পগ্রন্থের মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী একটা গল্প। এ গল্পে মূল চরিত্রই মনে হয় প্রকৃতি। এ গল্পে দোদুল দোলানো ঢেউ খেলানো কাব্যিক ভাষা যা হৃদয়ে এক ধরনের দ্যোতনা সৃষ্টি করে। পুরো গল্পটা আমার কাছে মনে হয়েছে আবৃত্তি করার মতো একটা অসাধারণ ব্যাঙময় বড় কবিতা। ছোট ছোট দৃশ্যকল্প। ছোট ছোট বাক্য বিন্যাসে তরতরিয়ে এগিয়ে গেছে গল্পটি। এ গল্পেও গল্পকারের গ্রাম বাংলার চিরচেনা রূপটা অতি মনোহর, অতি জীবন্ত করে ফুটিয়ে তুলেছেন।
তিনটা ঋতু পর্বে মনের তিন অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। অবশ্য সব শ্রেণীর পাঠক একবারের পাঠে হয়তো গল্পটা সহজে ধরতে পারবেন না। লেখকের বর্ণনাগুণে পাঠকের সামনে বাংলার বিভিন্ন ঋতুচক্র জীবন্ত হয়ে ওঠে। যেমন লেখক বলেন, ‘পথের দু’ধারে মাঠে সোনালী ধান গাছগুলো হাতছানি দেয়। ডাকে নবান্নের উৎসব। ডাকে চিরায়ত বাংলা। ডাকে মৃতপ্রায় নদীটি।’ তখন পরিচিত হেমন্ত আর নব্বান্ন উৎসব পাঠকের চোখের সামনে সাথে সাথে প্রাণময় হয়ে উঠতে বাধ্য।
আবার যখন বসন্তের কথা আসে তখন বলেন, ‘সে হারিয়ে যেতে চায় অজানার পথে। পারে না। চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে থামে চেনা বৃক্ষটির নিচে। বিশাল ডানা মেলে আলিঙ্গন করে। বাতাস সুর তোলে পাতায় পাতায়। স্মৃতিরা ঘিরে ধরে। জড়োসড়ো হয়ে পড়ে। এই বৃক্ষ তলায় একদিন ঘর ছিলো। বেড়ার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো খেলা করতো বাসন্তি পূর্ণিমা রাতে। খেলা করতো এক জোড়া বাবুই পাখী। ঘুমিয়ে পড়তো নিশ্চিন্তে। ভোরে ডানা মেলতো খোলা আকাশে। দিন শেষে ফিরতো ঘরে ক্লান্ত দেহে। আজ নেই সেই ঘর; বিবর্ণ গাছের পাতা। বয়েসের ভারে নুয়ে এসেছে বৃক্ষটি। কালের ছুরির নির্মম আঘাত বিধ্বস্ত করেছে বৃক্ষ লতায়-পাতায় গড়ে তোলা স্বপ্নীল ফুলশয্যা।’ কী চমৎকার সব উপমা! বর্ণনাগুণে বসন্তের স্নিগ্ধ অপরূপ রূপ খুব রূপময় হয়ে ওঠে পাঠকের মনে। এ আলোচনাটা লেখার সময়, সুদূর লন্ডনে বসে গভীর শীতের রাতেও যেন বাংলার বসন্তের ছোঁয়া অনুভব করছি শরীরে ও মনে। শরীরের প্রতিটি তন্ত্রীতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে সেই স্বাপ্নিক বাসন্তী হাওয়া।
গল্পের শেষ পর্বে ‘সে’ যখন বর্ষার মধ্যে নিজেকে একাকার করে দেয় তখন লেখকের ভাষায়-‘মেঘের ফাঁকে উঁকি দেয় শুক্লাদশী চাঁদ। হাত তোলে ওপরে। চাঁদের নাগাল পায় না। তবু ডাকে একবার-বারবার। চোখ বুজে আলিঙ্গন করে চাঁদকে।’ বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের প্রকৃতিঘেষা ছোটগল্প বিরল।
‘সেঁজুতি’ গল্পটি রোমান্টিক ট্র্যাজিডি। গল্পের নায়িকা সেঁজুতি যেনো অনিন্দ্য সুন্দর দেবী প্রতিমা’। সে ভালবাসে প্রদীপকে। সেঁজুতি ও তার মা রঞ্জিতার একমাত্র প্রতিবেশি সাবিনা। সাবিনা সেঁজুতির বান্ধবী। এক চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় পরিচয় প্রদীপের সাথে সেঁজুতির। এরপর থেকে প্রদীপের নিত্য আসা-যাওয়া সেঁজুতির বাড়িতে। সেঁজুতি প্রদীপকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
তারপর কিছুদিন পর প্রদীপের দেখা নেই। হঠাৎ আরেক চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় প্রদীপের সাথে দেখা হয় সেঁজুতি ও সাবিনার। তখন প্রদীপ পরিচয় করিয়ে দেয় তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর সাথে। সেঁজুতির আশার প্রদীপ যেনো ধপ করে নিভে যায়। লেখক বলেন, ‘কিন্তু বাতাসের এতোই শক্তি ছিলো যে, তার কাছে পরাজিত হলো সেঁজুতি। ছিটকে পড়লো ঘরের এক কোণে। নিভে গেলে সান্ধ্যপ্রদীপটিও।’ বস্তুত এ সান্ধ্যদীপটির রূপকে সেঁজুতির জীবনের শেষ আশার প্রদীপটি যে নিভে গেলো-তা বোঝা যায়। সংলাপ ও গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের এ অনবদ্য গল্পটি দিয়েও চমৎকার একটা নাটক তৈরি করা যায়।
‘মুক্তিযোদ্ধার জবানবন্দী’ গল্পটি খাঁটি বন্ধুত্ব, ঈর্ষাপরায়ণ মানুষের কুমন্ত্রণা, বিশ্বাসঘাতকতা, অনুশোচনার গল্প। গল্পের নায়ক মূলত দুই মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু। সাজু আর রশীদ। তারা একে অন্যের প্রাণের বন্ধু-ঠিক যেন বটবৃক্ষের ছায়ার মতো। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে সাজু আর রশীদ নেমে পড়ে দেশ গড়ার কাজে। সাজু এক সময় ইউপি চেয়ারম্যান হয়। রশীদই তার ইলেকশনের সব দায়িত্ব নেয়। সাজু চেয়ারম্যান হবার পরও তাদের বন্ধুত্ব ছিল বাঁধভাঙা।
কিন্তু অনেকেই সাজু আর রশীদের এই প্রগাঢ় বন্ধুত্বের জন্য হিংসায় জ্বলে পুড়ে খাঁক হতে থাকে। এ ধরনের একজন মানুষ রবীন। সে-ই এ গল্পের মূল ভিলেন। সে রশীদের কাছে ‘বটবৃক্ষের ছায়া’র মতো বন্ধু চেয়ারম্যান সাজুর প্রতি মনটা বিষিয়ে তোলে। ভুল বুঝে রশীদ বন্ধু সাজুকে খুন করতে বন্ধুর বাড়িতে যায়। সাজু বুঝতে পারে না যে রশীদ তাকে খুন করতে এসেছে। সাজু চিরাচরিত নিয়মে স্বাভাবিকভাবে বন্ধুর কাছে জানতে চায় এত রাতে কি কোনো প্রয়োজনে রশীদ দেখা করতে এসেছে। কিন্তু তখনই সাজুর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রবিনের প্ররোচনায় হিংসাবশত বন্ধুকে গুলি করে রশীদ।
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, পুলিশ যখন মৃত্যুপথযাত্রী সাজুর কাছে খুনির নাম জানতে চায়, তখন রশীদ বন্ধু সাজুর নামটি বলে না। ইচ্ছে করেই সাজু পুলিশের কাছে বন্ধুর নামটি চেপে যায়। কারণ সাজু তো জানে রশীদ তার প্রাণের বন্ধু। এ অবস্থায় সাজু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এদিকে রশীদ তার ভুল বুঝতে পারে। এই মানসিক যন্ত্রনায় এক সময়ে সে উম্মাদ হয়ে যায়। গল্পটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আন্তরিকতা, দুষ্ট লোকের কথায় ভুল বুঝাবুঝি, হিংসা, পরিশেষে হিংসার পরিণাম তুলে ধরা হয়েছে। এ গল্প দিয়ে মু্ক্িতযুদ্ধ ও তার অব্যবহিত পরের অবস্থার উপর ভিত্তি করে একটি চমৎকার টিভি নাটক তৈরি করা সম্ভব।
‘অনিন্দ্য মুখোশ’ মিঠু ও রুমি নামের দুই তরুণ-তরুণীর গল্প। কলেজ জীবনে তারা উভয়কে পছন্দ করতো। কলেজে পড়ার সময়ই রুমির বিয়ে হয়ে যায়। সে চলে যায় স্বামীর সাথে বিদেশে। কিন্তু স্বামী পর-নারীতে আসক্ত। পরিণতিতে সেপারেশন। পাঁচ বছর পর আবার দেশে ফিরে দেখা হয় মিঠুর সাথে। মিঠু তখন রুমিকে উপেক্ষা করে।
গল্পের মধ্যে নায়ক মিঠুর মনের অবস্থা উঠে এসেছে এভাবে: ‘মিঠুর জীবন থেকে পালিয়ে গেছে রোমাঞ্চিত দিনগুলো; পালিয়ে গেছে কবিতা লেখার সময়গুলো, হারিয়ে গেছে গানের সুর। আজ কেবল মনে পড়ে সেই প্রথম দিনের কথা, প্রথম পরিচয়ের কথা, প্রথম চোখাচোখির কথা; সেই অভিষেক অনুষ্ঠানের কথা। মিঠু তার ভরাট কন্ঠে গেয়েছিলো সেদিন রবি ঠাকুরের সেই গানটি, ‘আমারও পরানও যাহা চায় তুমি তাই তুমি তাই গো …।’
‘দূরে… আরও দূরে..’ গল্পটি ডেজি আর শিমন নামের দু’জন তরুণ-তরুণীর না পাওয়ার বেদনার গল্প। এক সময় দু’জনের সম্পর্ক ছিল খুবই গভীর। অতি রোমান্টিক দু’জন প্রেমিক-প্রেমিকার অনেক দিন পর দেখা হয়। পড়ন্ত এক বিকেলে এক শুন্য রেস্তোরায় তাদের আলাপ হয়। তারা ফেলে আসা দিনগুলোর কথা বলে স্মৃতিকাতর হয়। এক সময় তারা প্রতিবেশি ছিল। ছিল একে অন্যের হৃদয়ের গহীনে। তাদের সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে তারা যেনো একেকজন অমিত আর লাবণ্য।
গল্প থেকে উদাহরণ দিচ্ছি। যেমন নায়ক শিমন বলে: ‘আমি তো পারি একটি খরস্রোতা নদী টপকে ভাসতে, সবুজ তেপান্তরের শেষে ছোট্ট একটি পাখির নীড় উপেক্ষা করে চলে আসতে, শরতের ঘুঘু ডাকা একটি পূর্ণিমার রাতকে পেছনে রাখতে।’ শিমনের কথা শুনে ডেজির মনের যে অবস্থা গল্পকার সেটি তুলে ধরেছেন এভাবে: ‘রাজ্যের সব ভাবনা যেন ভর করে তার দু’চোখ জুড়ে। বাইরে তাকায়, পলকহীন। দমকা হাওয়ার সাথে এক পশলা বৃষ্টি। হাওয়ার ঝাপটায় আলতো ভিজিয়ে গেলো ডেজির মুখোমন্ডল, কপালে ছিটকে আসা একগোছা চুল, চোখের পাতা। বৃষ্টি আরও জোরে বইতে শুরু করলো। ভিজে একাকার হলো ডেজি।’ এরপর ডেজি যখন বাস্তবতায় ফিরে আসে তখন তার মনে পড়ে ঘরে তার স্বামী ইমন ও ছোট্ট মেয়ে ইরিনার কথা। গল্প এভাবে শেষ হয়- দু’জন উচ্ছল তরুণ-তরুণীর দীর্ঘশ্বাস আর না পাওয়ার বেদনার মধ্য দিয়ে।
‘চাঁদহীন আকাশ’ গল্পটি নয়ন ও অঞ্জনার মিলন-বিরহ ও বিচ্ছেদের গল্প। নয়নের সাথে সিলেট শহরের চৌরাস্তায় এক ঘটনার মধ্য দিয়ে উভয়ের পরিচয়। তারপর হৃদয়ের একুল-ওকুল ভাসিয়ে রোমাঞ্চকর দিনগুলো পার করার পর পরিণতিতে মিলন। দু’জন একসময় পাড়ি জমায় বিলাতে। সেখানে বৈরী পরিবেশে জীবন এগিয়ে যায়। সন্তানরা আসে ঘর আলো করে। কিন্তু অঞ্জনার জীবনের আলো এদিকে নিভে যেতে থাকে। মরণঘাতী কর্কট রোগ বাসা বাঁধে শরীরে। এক সময় জীবন থেকে বিদায় নেয় অঞ্জনা। নয়ন অঞ্জনার স্মৃতি আর পেছনে ফেলা আসা স্মৃতিময় স্বপ্নদিয়ে ঘেরা দিনগুলো নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে।
‘রক্তিম সূর্য’ গল্পটা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এক বীর শিমুল ও তার স্ত্রী পারুলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। শিমুল-পারুল একে অন্যকে পছন্দ করে বিয়ে করে। বিয়ের পর শিমুল চলে যায় মুক্তিযুদ্ধে। পেছনে রেখে যায় স্ত্রী পারুল ও ছোট্ট সন্তানকে। এদিকে পারুল ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে স্বামীর পথ চেয়ে পার করতে থাকে যুদ্ধের দিনগুলো।
পারুল স্বপ্ন বুনতে থাকে মুক্তিযোদ্ধা স্বামীকে নিয়ে। সে ভাবতে থাকে স্বামী দেশ স্বাধীন করে একদিন নিশ্চয় ফিরে আসবে। ছোট্ট খোকা বাবার কথা বারবার জানতে চায়। ছেলে সবুজ জানতে চায়: ‘বাবা কোথায়? বাবা ফিরে আসছে না কেন?’ কথা বলছোনা কেন মা, বলোনা আমার বাবা কবে আসবে? সেই যে চলে গিয়েছিলো বাবা একদিন সন্ধ্যায় আর এলোনা! আর কি আসবেনা বাবা? চুপ করে থেকোনা।’ পারুল উত্তর দেয় : ‘দেখো তোমার বাবা ঠিকই আসবে একদিন, এসে তোমাকে কত্তো আদর করবে। দেশ যেদিন স্বাধীন হবে, সেদিনই তোমার বাবা আসবে বীর সৈনিকের বেশে; দেখবে সে প্রাণ খুলে হাসবে। সবাই তাকে বরণ করবে ফুলের মালা দিয়ে। তুমি ভেবোনা সোনামণি। এবার ঘুমোও।’
কিন্তু পারুল তো একদিনও ঘুমোতে পারেনি এই ন’মাসে। প্রতিটি রজনী কেটেছে তার আকাশের তারা গুণে আর ঝিঁঝির ডাক শুনে শুনে। দেশ যেদিন স্বাধীন হলো তখন অনেকেই ফিরে এলো মিছিল করতে করতে। ফিরে আসা বীর যোদ্ধারা স্লোগান দিতে থাকে: শহীদ স্মৃতি অমর হোক! শিমুল ভাইয়ের স্মৃতি অমর হোক! মুহূর্তেই কাঁচের আয়নার মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যায় পারুল আর সবুজের সব স্বপ্ন। সত্যিই এমনি অনেক পারুল আর তাদের সন্তানদের হাহাকার লুকিয়ে আছে বাংলাদেশ নামক ছোট্ট এ ভূখন্ডের পরতে পরতে। মহান মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে লেখা গল্পটি লেখকের গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় বহন করে।
‘নাহিদের স্বপ্ন’ গল্পটি একটি মানবিকতার গল্প। গল্পের মূল চরিত্র দু’জন। একজন কলেজ ছাত্র নাহিদ। অপরজন রাস্তার ভিখারী রফিক। কলেজে যাবার পথে একদিন ভিক্ষুক রফিক ভিক্ষা চায় নাহিদের কাছে। নাহিদ শুনতে চায় রফিকের অতীত জীবনের গল্প। নাহিদ রফিকের করুণ জীবনের কথা শুনে তাকে সাহায্য করতে চায়। তার বাবাকে রফিকের কথা খুলে বলে। বাবা নাহিদকে ৫০০ টাকা দিয়ে বলেন রফিককে কিছু ছোটখাটো ব্যবসা করার কথা বলতে। এখানে উল্লেখ্য যে, লেখকের এ গল্পটি ১৯৮০ সালে লেখা। লেখকও সেই সময় কলেজে পড়তেন। মনে হচ্ছে লেখকের বাস্তব জীবনের দেখা কোন ঘটনার ছায়া অবলম্বনে এ গল্পটি লেখা হতে পারে। সে যাই হোক। আশির দশকের সেই ৫০০ টাকা নিয়ে নাহিদ রফিকের খোঁজে ছুটে যায়। ওখানে গিয়ে শুনে এক ঘাতক ট্রাকের দ্বারা মারাত্মক জখম হয়েছে ভিখারী রফিক।
নাহিদ হাসপাতালে ছুটে যায়। রফিককে বলে ‘রফিক, এই তো আমি এসেছি তোমার জন্য টাকা নিয়ে, অনেক টাকা। একবার তুমি তাকাও, দেখো চোখ মেলো।’ তখন ভিখারী রফিক জবাব দেয়: ‘না… আর ট্যাকা লাগতো নায় সাব! আপনে আমারে মাফ কইরা দেউক্কা। আমি যাইরাম গি-হিখানো খুব আরামো থাকমু’…।’ নাহিদ ভিখারী রফিককে স্বাবলম্বী করতে চেয়েছিল। ঘাতক ট্রাকে রফিকের অকাল মৃত্যুতে একজন মানবিক হৃদয়ের তরুণ নাহিদের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। আজ একচল্লিশ বছর পর এসেও আমরা দেখি প্রতিদিন এভাবে কত রফিক, কত নাহিদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে ঘাতক গাড়ী। আজ এত বছর পরেও আমরা দেখি, বাংলাদেশে যত মানুষ ঘাতক করোনার কবলে মারা যাচ্ছে, তার চেয়ে বরং ঘাতক বাস, ট্রাক ইত্যাদির নিচে পড়ে বেশি মানুষ মারা পড়ছে। তাই আজও গল্পটির আবেদন অটুট।
‘বিবর্ণ আলো’ একটি সমাজ বাস্তবতার গল্প। গল্পের মূল চরিত্র শায়লা। লেখকের ভাষায়: ‘শায়লা কবিতা লিখতো। পত্রিকায় ছাপা হতো কবিতা। তার এক দল ভক্ত পাঠকও ছিলো। রাজনীতি; জীবন, মানুষের অব্যক্ত অনুভূতিগুলোই ছিলো তার কবিতার বিষয়। সে স্বপ্ন দেখতো রঙিন ভবিষ্যতের। ‘জীবন’ তাকে দেখাতো ভবিষ্যতের আলোকোজ্জ্বল রাজপথ। মসৃণ সুন্দর সেই পথ জুড়ে কেবলই তাদের দু’জনের হেঁটে চলা হাতে হাত ধরে; আর পথের শেষে ছোট্ট একটা ঘর, যেখানে একজোড়া কপোত-কপোতির বসবাস।’ সেই শায়লার জীবন বাস্তবতা টানাপড়েনে ক্ষত বিক্ষত হতে হতে শেষ পর্যন্ত কিভাবে কিভাবে স্বপ্নগুলো ‘বিবর্ণ’ হয়ে যায় তা-ই উঠে এসেছে গল্পে। ‘বিবর্ণ আলো’ গল্পটিতে জীবনের দাবি সমাজকে অতিক্রম করেছে।
গল্পকার আবদুস সবুর মাখনের গল্পরীতির যে বৈশিষ্ট সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে সেটি হচ্ছে,মানবপ্রেমের সাথে ‘প্রকৃতিপ্রেম’ অপূর্ব সমন্বয়। মানবপ্রেম ও প্রকৃতি যেনো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রকৃতি বর্ণনার পাশাপাশি তাঁর গল্পগুলোতে উঠে এসেছে প্রণয়, প্রান্তিক মানুষের পাওয়া-না পাওয়ার বেদনা ও হাহাকার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সমাজের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, ও সর্বোপরি মানবতার জয়গান।
লক্ষ্যণীয় লেখকের প্রায় গল্পগুলোই গতানুগতিক ধারার গল্পের মতো মিলনাত্মক নয়। লেখক তাঁর গল্পগুলোতে দেখাতে চেয়েছেন জীবন বয়ে চলে জীবনের মতো। বাস্তবের জগতে মিলন অবশ্যম্ভাবী -এটা নাও হতে পারে। এখানেই লেখকের গল্পগুলোর একটা আলাদা বৈশিষ্ট ফুটে ওঠে। সব সময় যে চরমের সাথে পরমের মিল হতে হবে-সেটা বাস্তব জীবনে সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু তারপরও জীবন এগিয়ে যায়। এখানেই গল্পকারের সার্থকতা অন্যান্য গতানুগতিক লেখকদের থেকে। লেখক দেখাতে চেয়েছেন মানুষের জীবনটা উপন্যাস বা সিনেমার মতো সব সময় ‘তারপর তারা সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিলো’-এভাবে চলে না। মাঝে মাঝে হয়তো এভাবে ঘটে। আর মিলনের চেয়ে বিরহ বা দূরে চলে যাওয়াটাও যে এক ধরনের বাস্তবতা সেটা গল্পগুলোতে ফুটে উঠে।
‘হিম শিতল স্পর্শ’ গল্প গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে সিলেট প্রেসক্লাব ও আনোয়ার শাহাজাহান ফাউন্ডেশন গ্রন্থ প্রকাশ ইউকে এর যৌথ উদ্যোগে। মুদ্রণে ছিল দোআঁশ প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন্স, সিলেট। প্রচ্ছদ এঁকেছেন লুৎফুর রহমান তোফায়েল। একটা চমৎকার গ্রন্থ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্টরা সমাজমনস্কতার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। সংশ্লিষ্টদের অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতা এজন্য যে, তাঁরা উদ্যোগ না নিলে হয়তো আমরা এ গ্রন্থটি ছাপার অক্ষরে পড়তে পেতাম না। সিলেট প্রেসক্লাব ও আনোয়ার শাহাজাহান ফাউন্ডেশন গ্রন্থ প্রকাশ ইউকে যৌথভাবে গ্রন্থটি প্রকাশ করে পক্ষান্তরে বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের ইতিহাসে একটি নতুন পালক সংযোজন করলেন।এ গ্রন্থটিসহ আগামীতে প্রকাশিত সকল গ্রন্থ তারা জাতীয়ভাবে প্রচার ও প্রসার করবেন-এ কামনা করি। আশা করছি আগামীতেই সিলেট প্রেসক্লাব এভাবে সৃজনশীল লেখকদের খুঁজে খুঁজে পাঠকদের সামনে নিয়ে আসবে। আশা করি লেখক নিয়মিতভাবে কথা সাহিত্যের চর্চা অব্যাহত রাখবেন। আর লেখা অব্যাহত রাখলে একদিন তাঁর হাত দিয়ে হয়তো বেরিয়ে আসবে কোন এক ‘মাস্টারপিস’ গল্প বা উপন্যাস। সূদূর বিলাতে থেকে গল্পকার, কবি, গীতিকার, সিলেটের স্বনামখ্যাত সাংবাদিক আবদুস সবুর মাখন এর লেখা ‘হিম শিতল স্পর্শ’ গল্পগ্রন্থের দেশে-বিদেশে বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করি।

শেয়ার করুন

সাহিত্য এর আরও খবর
বাস্তবের জাদু জাদুর বাস্তবতা

বাস্তবের জাদু জাদুর বাস্তবতা

‘পদ্যসমীরণ’-এর ছন্দের দোলায়

‘পদ্যসমীরণ’-এর ছন্দের দোলায়

মকদ্দস আলম উদাসী ও তাঁর সাধন-ভজন

মকদ্দস আলম উদাসী ও তাঁর সাধন-ভজন

পঙক্তিতে জেগে ওঠে মাটির ঘ্রাণ

পঙক্তিতে জেগে ওঠে মাটির ঘ্রাণ

সর্বশেষ সংবাদ
হুমায়ূন রশীদ চত্ত্বরে ইয়ামাহার নতুন শো-রুম উদ্বোধন
হুমায়ূন রশীদ চত্ত্বরে ইয়ামাহার নতুন শো-রুম উদ্বোধন
গুচ্ছভর্তিতে আবেদন ১ এপ্রিল থেকে, পরীক্ষা শুরু ১৯ জুন
গুচ্ছভর্তিতে আবেদন ১ এপ্রিল থেকে, পরীক্ষা শুরু ১৯ জুন
করোনায় একদিনে ১৪ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৮৪৫
করোনায় একদিনে ১৪ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৮৪৫
শিবগঞ্জে অটোরিকশায় ছিনতাইয়ের চেষ্ঠা, গ্রেফতার ৩
শিবগঞ্জে অটোরিকশায় ছিনতাইয়ের চেষ্ঠা, গ্রেফতার ৩
সিলেটে ফুটপাতে মিললো বস্তাভর্তি জাতীয় পরিচয়পত্র
সিলেটে ফুটপাতে মিললো বস্তাভর্তি জাতীয় পরিচয়পত্র
খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ বাড়ছে আরও ৬ মাস
খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ বাড়ছে আরও ৬ মাস
দূর করুন ঘাড় ব্যথা
দূর করুন ঘাড় ব্যথা
পুড়ে গেলে প্রথমেই যে চিকিৎসা
পুড়ে গেলে প্রথমেই যে চিকিৎসা
লঙ্কায় যত ঝাল- তত উপকার
লঙ্কায় যত ঝাল- তত উপকার
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেন দরকার
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেন দরকার
স্মরণ: শিক্ষাবিদ জলধীর রঞ্জন চৌধুরী
স্মরণ: শিক্ষাবিদ জলধীর রঞ্জন চৌধুরী
রজব রমজানের প্রস্তুতি মাস
রজব রমজানের প্রস্তুতি মাস
আন্তর্জাতিক নারী দিবস
আন্তর্জাতিক নারী দিবস
<span style='color:#000;font-size:18px;'>আদর্শবান লোকদের বন্ধুর সংখ্যা কম থাকে। - ডগলাস জেরল্ড</span><br/> আন্তর্জাতিক নারী দিবস
আদর্শবান লোকদের বন্ধুর সংখ্যা কম থাকে। - ডগলাস জেরল্ড
আন্তর্জাতিক নারী দিবস
নারী উদ্যোক্তা সম্মেলন ও পণ্য প্রদর্শনী আজ উদ্বোধন করবেন মন্ত্রী ইমরান
নারী উদ্যোক্তা সম্মেলন ও পণ্য প্রদর্শনী আজ উদ্বোধন করবেন মন্ত্রী ইমরান

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২০

সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি : রাগীব আলী
সম্পাদক : আব্দুল হাই

কার্যালয় : মধুবন সুপার মার্কেট (৫ম তলা), বন্দরবাজার, সিলেট-৩১০০ ।
ফোন: পিএবিএক্স ৭১৪৬৩৪, ৭১৯৪৪৭, , ফ্যাক্স: ৭১৫৩০০
মোবাইল: ০১৭৯২ ২৫২২২৫ (বার্তা), ৭২২২২৭ (বিজ্ঞাপন), ০১৫৩৮ ৪১২১২১
ই-মেইল: sylheterdak@yahoo.com
বিজ্ঞাপন : sylheterdakadv@gmail.com

  • Contact Us
  • আমাদের পরিবার

Developed by: Web Design & IT Company in Bangladesh

Go to top