হ্যালোউইন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ মে ২০২২, ৫:২৭:০৮ অপরাহ্ন

প্রফেসর মো. আজিজুর রহমান লসকর
অক্টোবর আসতেই দেখতে পেলাম মন্ট্রিয়ালের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ঘরের সম্মুখে বা বাড়ির কাছের গাছে প্রধানত সাদা কাপড়ের সাহায্যে এলোমেলোভাবে তৈরী ভয়ংকর অবয়ব! বড় বড় চোখ। ভূতুড়ে দাঁত। মুখে পৈশাচিক হাসি। কোনটির অবয়ব খুবই সরল, হয়তো হাত দু’এক প্রস্থ ও দশ-বারো হাত লম্বা সাদা কাপড় উঁচু গাছ থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। শীর্ষে চোখ, মুখ ও দাঁতের ছবি এঁকে ভৌতিক চেহারা তৈরী করা হয়েছে। কেউ বিরাট আকারের মাকড়সার জাল বানিয়ে তাতে আটকে দিয়েছে একটি কংকাল।
এসব ভৌতিক আয়োজন আগামী ৩১ অক্টোবর হ্যালোউইন উৎসব উপলক্ষে। অনেকে এটাকে ভূত উৎসবও বলে থাকেন। হ্যালোউইনকে উপলক্ষ করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নানা রকমের দ্রব্য সামগ্রী বাজারে ছেড়েছে; বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের ব্যবহার উপযোগী খেলনা, অদ্ভুত রকমের মুখোশ ও পোষাক-পরিচ্ছদ; যা হ্যালোউইনের ব্যাপক প্রচারে সাহায্য করছে। ২০১৯-এ টরন্টোয় এক বাংলাদেশী রেস্তোরায় এ উপলক্ষে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ভূতুড়ে পরিবেশে বাংলাদেশী ছেলেমেয়েরা ভয়ংকর মুখোশ পরে ভূত, প্রেত ও কংকাল সেজে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে ভৌতিক আনন্দ দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। এভাবে টরন্টোর কিছু বাংলাদেশী মুসলমান হ্যালোউইনে বিশেষ অবদান রেখেছেন।
মন্ট্রিয়ালের বিভিন্ন দোকানে দেখলাম মিষ্টি কুমড়ার উপরের দিকে ছিদ্র করে ভিতরের সব কিছু বের করে খালি করা হয়েছে। কুমড়াটির একপাশে ছিদ্র করে দু’টি চোখ, একটি নাক ও একটি মুখ তৈরী করা হয়েছে। মুখের ভিতর দাঁতও দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যার আঁধারে মিষ্টি কুমড়ার ভিতর মোমবাতি জ্বালালে এর চোখ, মুখ ও নাক দিয়ে আলো টিকরে বাইরে আসবে। এ বস্তুটির বিশেষ নাম হচ্ছে জ্যাক-ও ল্যান্টার্ন (ঔধপশ-০-খধহঃবৎহ) এই ল্যান্টার্ন হাতে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মৃত আত্মাদের পথ চলতে সাহায্য করা হয়; উদ্দেশ্য তাদেরকে সন্তুষ্ট করা। বড় বড় গ্রসারি শপে বিরাট আকারের মিষ্টি কুমড়া দেখে অবাক হয়েছি। কোনটির ব্যাস প্রায় আড়াই বা তিন ফুট হয়ে থাকবে। এগুলো নিশ্চয় ম্যাক্সিকোতে আমদানীকৃত।
হ্যালোউইন উপলক্ষে গির্জায় বিশেষ অনুষ্ঠান ও প্রার্থনা হয়, কেউ কেউ উপবাস করেন। ক্যানাডা ও আমেরিকায় ভূত নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। এখানকার অধিক লোক ভূত বিশ্বাস করেন। মজার ব্যাপার হলো, কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, ভূতের পোষাক পরিহিতদের মধ্যেই সত্যিকার ভূতও রয়েছে। ছেলেমেয়েরা ভূতুড়ে পোষাক ও ভয়ংকর মুখোশ পরে দল বেঁধে সন্ধ্যার পর বেরিয়ে পড়ে। তারা বাসায় বাসায় গিয়ে দরোজায় কড়া নেড়ে বলে ‘ট্রিক-ওর ট্রিট (ঞৎরপশ-ড়ৎ-ঃৎবধঃ) যার অর্থ হচ্ছে আমাদের ট্রিট অর্থাৎ খাবার (চকোলেট) দাও, নইলে আমরা বিশেষ ট্রিক বা কৌশল গ্রহণ করব। কেউ অবশ্য ট্রিক করতে দেয় না। চকোলেট দিয়ে তাদের সন্তুষ্ট করে থাকে। ট্রিক-ওর ট্রিট হ্যালোউইনের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। তবে সবাই কেবল ট্রিক-ওর ট্রিক নিয়ে ব্যস্ত থাকে না। অনেকে চলে যায় কোন ভৌতিক স্থান দর্শনে। কেউ ভূতের সিনেমা দেখে হ্যালোউইন উদযাপন করে।
হ্যালোউইনের ইতিহাস অতি প্রাচীন। খ্রিস্টের জন্মেরও আগে প্রাচীন আয়ারল্যান্ডে, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলের অধিবাসীরা, যারা সেল্ট (ঈবষঃ) নামে ইতিহাসে পরিচিত, স্যামহেইনের (ঝধসযধরহ) আরাধনা করত। স্যামহেইনকে মনে করা হতো অন্ধকারের প্রভু, তাকে মৃতেরও প্রভু ধারণা করা হতো। পয়লা নভেম্বর ছিল সেল্টদের নববর্ষ। এ দিনটিকে তারা গ্রীষ্মকাল ও শস্য উত্তোলনের শেষ দিন এবং ঠান্ডা ও অন্ধকারের সূচনা বলে বিশ্বাস করত। এ সময়ের সাথে মানব মৃত্যুর যোগাযোগ রয়েছে বলেও তারা মনে করত। সেল্টদের আরো বিশ্বাস ছিল নববর্ষের আগের রাতে জীবিতদের জগত ও মৃতদের জগতের সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে যায়। তাদের বিশ্বাসে আরো ছিল ৩১ অক্টোবর রাতে মৃতের আত্মাগুলো পৃথিবীতে নেমে আসে। তাই রাতে তারা স্যামহেইনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। সন্ধ্যায় চুলার আগুন নিভিয়ে ফেলে তারা ঘরের বাইরে বিশাল আগুনের ব্যবস্থা করত। আগুনের চারপাশে গ্রামের লোকেরা জড়ো হতো এবং উৎসর্গ রূপে শস্য ও পশু আগুনে ছোড়ে দিত। অনুষ্ঠান উপলক্ষে তারা বিশেষ পোষাক পরিধান করত” পশু চামড়া নির্মিত পোষাকের শীর্ষে পশুর মস্তকও শোভা পেত। এসব আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিল ভৌতিক সত্তার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আত্মরক্ষা।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে পোপ গ্রিগরি-৩ ঘোষণা দেন ১লা নভেম্বর, সন্ন্যাসীদের জন্য মর্যাদার দিন, সন্ন্যাসী দিবস (অষষ ঝধরহঃং উধু)। অতঃপর সন্ন্যাসী দিবসের সাথে যুক্ত হয় দীর্ঘ কাল যাবৎ পালিত স্যামহেইন দিবসের অনুষ্ঠান সমূহ। ১লা নভেম্বরের পূর্ববর্তী সন্ধ্যা অর্থাৎ ৩১ অক্টোবরের সন্ধ্যার নাম হয় ‘অষষ ঐধষষড়ংি ঊাব’ পরবর্তীকালে তা ঐধষষড়বিবহ-এ পরিণত হয়। কালের পরিবর্তনে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে হ্যালোউইনের অনুষ্ঠানমালায় যুক্ত হয়েছে ‘ঞৎরপশ-ড়ৎ-ঞৎবধঃ’ মিষ্টি কুমড়ার ‘ঔধপশ-০-খধহঃবৎহ’ আনুষ্ঠানিক সম্মেলন, হ্যাট-কোট ইত্যাদি মার্জিত পোষাকের ব্যবহার এবং বিশেষ খাদ্য (ঞৎবধঃং) গ্রহণ ইত্যাদি। তবে বাইবেলে এ অনুষ্ঠানের কোন নির্দেশ নেই। যেসাসও তা পালনের নির্দেশ দিয়ে যাননি। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের অন্যান্য অনুষ্ঠানের ন্যায় এটাও উদ্ভাবিত।