শিক্ষার মান উন্নয়নে করণীয়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১০ মার্চ ২০২১, ৩:৫৬:১৩ অপরাহ্ন

মো. ইউসুফ আলী
একটি দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হলো শিক্ষা। শিক্ষাই হলো মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। জনসংখ্যা হলো দেশের মূল্যবান সম্পদ। জনসংখ্যার উপরই নির্ভর করে একটি দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। তাই জনসংখ্যার সংখ্যাগত দিকের চেয়ে গুণগত দিকটি অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। জনসংখ্যাকে যদি দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করা যায় তাহলে জনসংখ্যা আশির্বাদস্বরূপ। দক্ষ জনশক্তি তৈরীতে মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প নেই। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও মানসম্মত শিক্ষা অধরাই থেকে গেল। তার উপর আবার করোনা ছোবলে শিক্ষায় বিপর্যয় ঘটছে। দেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষিতের হার বাড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। স্বাধীনতার পর প্রথম শিক্ষা কমিশন থেকে শুরু করে ২০১০ সাল পর্যন্ত যতটা শিক্ষা কমিশন গঠন করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে প্রত্যেক শিক্ষানীতিতেই মানসম্মত শিক্ষার জন্য করণীয় সমূহ বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। দু’একটা শিক্ষানীতির কিছু অংশ বিচ্ছিন্নভাবে বাস্তবায়ন করা হলেও মানসম্মত শিক্ষার জন্য সভা সেমিনার করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। শিক্ষার পরিমাণগত উন্নয়ন ব্যাপক হলেও গুণগত অবনমন হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৯৬ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রীদের উপবৃত্তি চালু পর্যায়ক্রমে তা উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত চালুর ফলে নারী শিক্ষায় অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। ২০১০ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূলে বই বিতরণের ফলে শিশুদের বিদ্যালয়গামী হার বৃদ্ধি পেয়েছে পক্ষান্তরে ঝরে পড়ার হার কমেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত ও শিক্ষার্থী পরিমাণগত যে উন্নয়ন হয়েছে এর সুফল পেতে হলে শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়ন অত্যাবশ্যক। গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে বহুতল ভবন নির্মাণের মাধ্যমে শ্রেণি কক্ষের সমস্যার সমাধান হয়েছে। তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলে প্রতিষ্ঠানে বসেই যাবতীয় অফিসিয়াল কাজকর্ম সম্পন্ন করা যাচ্ছে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে মানসম্মত শিক্ষার ভূমিকাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষায় সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলে ২০৪১ সালের আগেই উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে পারলে ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারা যাবে। মানসম্মত শিক্ষার সমস্যা ও সমাধানে যে সব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন
১। আমরা সবাই জানি ও বলি শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। মেরুদন্ড মজবুত না হলে একজন মানুষ যেমন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না তেমনি কোয়ালিটি সম্পন্ন শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। মানসম্মত শিক্ষার জন্য মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করার মতো সুযোগ সুবিধা নেই। শিক্ষকতা পেশায় মেধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের আকৃষ্ট করতে প্রথমতঃ সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুযোগ সুবিধা সমান করতে হবে অথবা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগের পৃথক শিক্ষা কমিশন গঠন অথবা পিএসসির মাধ্যমে বিসিএস এর আদলে নিয়োগের ব্যবস্থা করা। লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভায় উত্তীর্ণদের থেকে মেধাক্রম অনুসারে কলেজে বিসিএস ক্যাডার হিসাবে নিয়োগ প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে নন ক্যাডার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া। প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও একই রকম যোগ্যতা ও সুযোগ সুবিধা বাস্তবায়ন করতে হবে।
২। মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে অন্যতম অন্তরায় হলো শিক্ষকদের বিষয় জ্ঞানের হীনতা। নিজে যদি না জানি তাহলে অন্যকে কিভাবে শেখাব? শিক্ষকের বিষয় জ্ঞানের দৈন্যতার কারণে পাঠদান স্বার্থক ও সফল হয় না। শিক্ষকদের বুনিয়াদি ও বিষয় জ্ঞানের পারদর্শী করতে না পারলে মানসম্মত শিক্ষা কখনও সম্ভব নয়। এ জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার দুর্বল ব্যবস্থার জন্য শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব প্রশিক্ষণের পরে শিক্ষকবৃন্দ উচ্চতর স্কেল প্রাপ্য হন তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া নির্দিষ্ট সময় পর পর সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩। শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে, প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষা প্রশাসনের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের নৈতিক স্খলনের জন্য শিক্ষকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারেন না।
৪। শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৪০ সম্ভব না হলেও ১:৬০ অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও আছে যেখানে এক দু’জন শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন ১০ থেকে ১৩ জন। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক ১ জন। এতে অর্থের অপচয়ও হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষার প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী সংখ্যার ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব অনুসারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা।
৫। শিক্ষার অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে শিক্ষায় অধিক বিনিয়োগ। শিক্ষা মানব সম্পদ উন্নয়নের অপরিহার্য উপাদান হলেও শিক্ষায় অর্থায়ন হতাশাব্যঞ্জক। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে কম। শিক্ষার মান উন্নয়নের শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৭ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।
৬। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পাঠ্য বইয়ের সংখ্যা ও সিলেবাসের পরিধি বেশি হওয়ায় শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। এর ফলে বেশি শেখাতে গিয়ে কমও শেখানো যাচ্ছে না। পাঠ্য বইয়ের সংখ্যা ও সিলেবাসের পরিধি কমালে শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহ বাড়বে।
৭। উন্নত দেশের বিদ্যালয়গুলোতে মধ্যাহ্ন টিফিন বা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে মধ্যাহ্ন টিফিনের ব্যবস্থা নেই। এতে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় টিফিন পিরিয়ডের পরের ক্লাসগুলোতে মনোযোগী হতে পারে না। টিফিন প্রোগ্রাম চালু করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এ প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন সম্ভব।
লেখক : শিক্ষক।