প্রসঙ্গ : বিশ্বকাপে ‘ঘটন’-‘অঘটন’
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ ডিসেম্বর ২০২২, ৬:৫২:০৩ অপরাহ্ন

ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
দু’হাজার বাইশ সালের ফুটবলের বিশ্বকাপ শুরু হলো কাতারে। এই বিশ্বকাপের উন্মাদনা বিশ্বকে কতোটুকু কাঁপিয়ে তুললো জানি না কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে এর উত্তাপ রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। আবেগ উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে মারামারি হানাহানি সহ অমূল্য জীবনহানির ঘটনাও ঘটে চলছে। পত্র পত্রিকার খবরাখবর থেকে দেখা যায় এই বাংলাদেশের এক যুবক বিদ্যুতের খুঁটিতে আর্জেন্টিনার ফ্ল্যাগ টাঙ্গাতে গিয়ে আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। এ খবর আর্জেন্টিনার মেসির দল, সে দেশের জনগণ বা সরকার রাখেন কিনা জানি না কিন্তু সেই যুবকের মা বাবার বুকের যন্ত্রণার খবর কেউ রাখে না। কেন মায়ের বুক খালি হলো, কেন অসহায় পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ এ প্রশ্নের উত্তর মেলে না। সেই পরিবারের ভেতরে-বাইরে শুধুই হাহাকার। কিন্তু কেন? উত্তর মেলে না। মিথ্যে, অর্থহীন আবেগের কাছে শুধুই জীবনের পরাজয় বৈ অন্য কিছুই নয়। তার পর সৌদি আরবের কাছে এককালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন মেসির দলের পরাজয় আবারো কেড়ে নিলো গুটিকয় তাজা প্রাণ। এইসব অর্থহীন, যুক্তিহীন মৃত্যুগুলোর জন্য কাউকে তো দায়ী করা যায় না। না ব্রাজিল না আর্জেন্টিনার ফুটবলারদের। নিয়ন্ত্রণহীন আবেগই বোধ হয় এর জন্য দায়ী।
যাক গে সে কথা। ফুটবল জগতে সেই ম্যারাডোনার যুগ থেকে একটা বিষয় ভীষণভাবে প্রচার পেলো যে, ফুটবল মানেই বুঝি আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল। এর বাইরে অন্য দলগুলো যে ধর্তব্যের বাইরে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ফুটবল দলগুলো খেলতে হয় তাই তাই খেলছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কথা জানি না কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে হাসি-কান্না-আবেগ-উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা এই দু’টি দলকে ঘিরেই। সারা বিশ্বের অন্যান্যদলগুলোর খেলা কি একেবারেই হিসেবের বাইরে। কেন? বাকি দলগুলো তো বাচাই পর্ব উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করছে। তাহলে এ ধরনের অবহেলা কেন? আর অবহেলা, তাচ্ছিল্য নয়। বদলে গেছে পৃথিবী। বিশ্বকাপ বিজয়ী আর্জেন্টিনা হেরে গেলো অখ্যাত সৌদি দলের কাছে। জার্মানী বধ করলো জাপান। এমনটি তো ঘটতেই পারে। এতে এতো দুঃখ কেন? শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচার করা হলো আর্জেন্টিনা সৌদি আরবের কাছে হেরে যাওয়া নাকি ‘অঘটন’! যদি তাই হয় তাহলে তো জার্মানী জাপানের কাছে হেরে যাওয়াও ‘অঘটন’। প্রশ্ন হলো- সৌদি আরবের ফুটবল দলের বিজয় কেন ‘অঘটন’ হতে যাবে? জাপানের কাছে জার্মানীর পরাজয় অঘটন কেন হবে! সৌদি আরব বা জাপানের দলতো ফুটবল মাঠে বীরের মতো লড়াই করে বিজয়ী হয়েছে। আর্জেন্টিনা কি যুগ যুগ ধরে ফুটবলের মাঠে রাজত্ব করেই যাবে!
বিশ্ব আসরে বিশ্বকাপ জয়ের অধিকার কী অন্য কারো থাকতে নেই! যদি সে অধিকার সবারই থেকে থাকে তাহলে সৌদি আরব বা জাপান বা অন্য যেকোন দেশের ফুটবল দল যদি কৌশলি খেলা খেলে আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল বা অন্য কোন শক্তিশালী দলকে হারিয়ে বিশ্বকাপ ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয় তাহলে সেটাকে বিশ্ব মিডিয়া ‘অঘটন’ বলে উদীয়মান ফুটবলারদের ছোট করে বা তাদের বিজয়কে আকস্মিক কিছু বলে তাদের শক্তিকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ আছে বলে মনে করার কোন যুক্তি নেই। এটা অনেকটা পক্ষপাতিত্বেরই সামিল। বাংলাদেশের মেয়েরা সাম্প্রতিককালে সাফ গেইমস এ ভারত-পাকিস্তানসহ ‘সাফ’ এর সকল সদস্যকে হারিয়ে ‘সাফ’ চ্যাম্পিয়নের মুকুট মাথায় নিয়ে দেশে ফিরেছে। এ বিজয়কে কি কেউ ‘অঘটন’ বলতে পারে। আসলে এগুলো ঘটনা বা ঘটন; ‘অঘটন’ বলা কোন অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না। এটাকে সৎ সাংবাদিকতা বলা যায় কিনা সেটাও ভেবে দেখা প্রয়োজন।
এতো গেলো খেলার মাঠের ঘটন-অঘটন। বিশ্বের রাজনীতির মাঠেও এ সমস্ত ঘটনা কোন বিরল ঘটনা নয়। যদি বলি সাম্প্রতিককালের ব্রিটিশদের কথা; সেটা কিন্তু সারাবিশ্বে সারা জাগানো ঘটনা। আজকের লন্ডনের ঋষি সুনাকের কথা বলছি। সেই ব্রিটিশরা যখন ভারতের হর্তাকর্তা তখন চট্টগ্রাম ক্লাবে ব্রিটিশরাই আসা যাওয়া করতো অন্য কোন ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিলো। ক্লাবের ফটকে লিখা ছিলো ‘ডগস অ্যান্ড বেঙ্গলিজ আর নট অ্যালাউড’। আজ কি হলো? ব্রিটিশরা ভেবে দেখেছেন কি ঘটনা ঘটেছে লন্ডনে? সেই বেঙ্গলিজরা তো ভারতেই লোক। যে ভারতীয়দের ‘ডগস’ এর সাথে সমান বিবেচনা করেছেন সেই বেঙ্গলিজ অর্থাৎ ভারতীয় একজন ঋষি সুনাক তো ১০নং ডাইনিং স্ট্রিটের অধিবাসী। সেই ঋষি সুনাক বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার বাগময়না গ্রামের কুটি মিয়ার লন্ডনের রেস্টুরেন্টে অর্থাৎ বাঙ্গালি রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করতেন। অর্থাৎ কাজ করতেন বাঙালির রেস্টুরেন্টে। তিনি আজ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। এটাকে আমরা বা সাংবাদিক ভাইয়েরা কোন দৃষ্টিতে দেখবেন? এটা কি কোন রাজনৈতিক ‘অঘটন’? আমি বলি অবশ্যই না। ঘটন বা ঘটনা। কোন অবস্থাতেই কোন ‘অঘটন’ নয়। ঋষি সুনাক নিজের কর্মের মাধ্যমেই এ জায়গায় এসেছেন। শুধু ঋষি সুনাকই নন, অনেক বাংলাদেশের বাঙালি বাংলাদেশি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সম্মানিত সদস্য। এগুলোও বিশ্বে সারা জাগানো ঘটনা। ঘটন। ‘অঘটন’ নয়। ‘অঘটন’ নয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিস আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়াটা। এটাও যোগ্যতা আর কর্মের ফল।
একই চিন্তায় আমরা যদি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে কথা বলি তাহলে আমরা কি অতীত ইতিহাস পাই। এই ইতিহাস কারো অজানা থাকার কথা নয়। তবুও বলছি, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পৃথিবী বলতে গেলে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো।
স্বাধীনতাকামী সাড়ে সাত কোটি বাঙালির পাশে সেদিন দাঁড়িয়ে ছিলেন ভারত-রাশিয়া সহ গুটি কয়েক দেশ। অপরদিকে পাকিস্তানের পাশে এসে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক তথা বর্বর পাক সেনাবাহিনীকে সক্রিয়ভাবে অর্থ-অস্ত্র সহ সকল প্রকার সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এলো আমেরিকা, চীন সহ বিশ্বের অনেক শক্তিশালী দেশ। ওদের সমর্থনে ঋষ্টপুষ্ট হয়ে ভুট্টো-ইয়াহিয়া সরকার আর সেদেশের নিষ্ঠুর সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। কিন্তু বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা ঘরে বসে রইলো না। প্রতিরোধ গড়ে তুললো। ভারত-রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা নয় মাস যুদ্ধের পর ৯৩ হাজার পাকি সৈন্যকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করলো। কি লজ্জা! কি লজ্জা! কেউ যদি বলে বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকিদের গোহারা হারের বিষয়টি কোন ঘটনাই না, ‘অঘটন’ তখন চরম সত্য ঘটনাকেই কি অস্বীকার করা হলো না? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন বিশ্ব রাজনীতির মাঠে একটি বাস্তব ঘটনা। কোন অবস্থাতেই কোন ‘অঘটন’ নয়।
এমনি অবস্থায় বিশ্বকাপে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পরাজয় হলেই সেটা হবে ‘অঘটন’ আর ওরা জিতলেই হবে ‘ঘটনা’ এমন ভাবনা বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচারের আগে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আর একটু ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন আছে বলেই মনে করি। এ প্রসঙ্গে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লিখা একটি ভজন গানের দু’টি লাইন খুবই প্রাসঙ্গিক- চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়।’
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক ব্যাংকার।