বালাগঞ্জ ওসমানীনগর মুক্ত দিবস আজ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ৬:১৪:৪০ অপরাহ্ন

মো. জিল্লুর রহমান জিলু, বালাগঞ্জ (সিলেট) থেকে ॥ আজ বালাগঞ্জ মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি বঙ্গবীর জেনারেল এমএজি ওসমানীর পৈতিৃক ভূমি বৃহত্তর বালাগঞ্জ উপজেলা (বর্তমান ওসমানীনগর উপজেলাসহ) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়। আজ বালাগঞ্জবাসীর কাক্সিক্ষত বিজয়ের সেই গৌরবময় স্মরণীয় দিন, বালাগঞ্জ মুক্ত দিবস।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাতাছড়া থেকে ৪০জন মুক্তিযোদ্ধা বালাগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হন। বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল কামালের নেতৃত্বে এ বাহিনীর অন্য সহযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন মুছব্বির বেগ, শফিকুর রহমান, মনির উদ্দিন, ধীরেন্দ্র কুমার দে, নীহারেন্দু ধর, আব্দুল খালিক, জবেদ আলী, সিকন্দর আলী, আমান উদ্দিন, লাল মিয়া, মনির উদ্দিন আহমদ, মজির উদ্দিন আহমদ, মো. সমুজ আলী, আব্দুল বারী প্রমুখ।
এদের মধ্যে ২৬জন পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পথে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলা সদরে থেকে যান। বাকি ১৪জনের দলটি ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর অধিনায়ক আজিজুল কামালসহ ফেঞ্চুগঞ্জ থানার মাইজগাঁও এলাকার আব্দুল গণি মাস্টার ও বদরুল হক নিলুর বাড়িতে উঠেন। সেখান থেকে একই রাত ১২টার সময় রওয়ানা হয়ে রাত ২টায় ইলাশপুর রেল সেতুর নিকট অবস্থান গ্রহণ করেন। পরদিন ভোরে একদল পাক সেনা সিলেট থেকে ফেঞ্চুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ হয়।
সেখানে প্রায় আধা ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানি সৈন্যরা শেষ পর্যন্ত ২টি এসকেএস রাইফেল ও বেশ কিছু গোলা বারুদ ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা ইলাশপুর সেতু অতিক্রম করেন। এ সময় বড়লেখা থেকে ২৬ জনের দলটিও সেখানে এসে পৌঁছে যায়। এতে উভয় দলের মনোবল আরো বেড়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা ইলাশপুর সেতুর অবস্থান থেকে ৬ ডিসেম্বর ভোর রাতে রওয়ানা হয়ে সন্ধ্যা ৭টার সময় প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে বর্তমান বালাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাছে পৌঁছতে সক্ষম হন। এরপর সেখানে অবস্থান করে শুরু হয় তথ্য সংগ্রহের পালা। সংবাদ পাওয়া যায়, বালাগঞ্জ থানায় পাক হানাদার বাহিনী নেই, তবে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে একদল বাঙালি পুলিশ রয়েছে। সেদিন রাজশাহীর বদিউজ্জামান, বিয়ানীবাজার নিবাসী ডা. জাকারিয়া ও কাজীপুর নিবাসী আব্দুছ সুলতান বার্তা বাহকের কাজ করেন। ইতোমধ্যে রাত নেমে আসে। রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা থানা ভবনে অবস্থানকারী পুলিশ বাহিনীকে ঘেরাও করে ফেলেন।
৭ ডিসেম্বর সকালে বার্তা বাহক দুই জনকে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট আত্মসমর্পণের নির্দেশ পাঠানো হয়। পুলিশ বাহিনী তখন দুই ঘণ্টা সময় প্রার্থনা করে। কিন্তু অধিনায়ক আজিজুল কামাল ঘোষণা করেন বড়জোড় ১০মিনিট সময় দেওয়া যেতে পারে। অতঃপর সিদ্ধান্ত হয় পাক হানাদারের ওই দোসররা সকাল ৯টায় অস্ত্র সমর্পণ করবে। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক পুলিশ বাহিনী থানা ভবনের মালখানায় অস্ত্র জমা দেয় এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সকাল পৌনে ১০টায় মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কের নিকট চাবি হস্তান্তর করে।
সেদিন আত্মসমর্পণের পর উপজেলা সদরস্থ সাব-রেজিস্ট্রারি অফিস প্রাঙ্গণে মুক্তিকামী অসংখ্য মানুষের ভিড় জমে। অধিনায়ক আজিজুল কামাল হাতে স্টেনগান উঁচিয়ে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা শান্ত থাকুন, এখন সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, বালাগঞ্জের পুলিশবাহিনী এবং রাজাকাররা আমাদের কাছে সালেণ্ডার করেছে। আজ আমরা মুক্ত।
তারপর সকাল ১০টার সময় থানার সমুখস্থ প্রাঙ্গণে কুয়াশাঘন সকালে মাঠের এক পার্শ্বে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সারিবদ্ধভাবে লাইন করে অবস্থান গ্রহণ করেন। সবার হাতে অস্ত্র। অধিনায়ক আজিজুল কামাল দলের মুক্তিবাহিনীর ৪০জন মুক্তিযোদ্ধাকে উপস্থিত জনতার সামনে পরিচয় করিয়ে দেন। এসময় উৎসুক জনতা বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের অভিবাদন জানান। আর মাঠে জড়ো হওয়া সবাই চূড়ান্ত বিজয়ী হয়ে আনন্দ উল্লাসে ছড়িয়ে পড়েন বালাগঞ্জের গ্রাম থেকে গ্রামে।
বালাগঞ্জ মুক্ত দিবস নিয়ে দৈনিক সিলেটের ডাক-এর এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বিজয়ী দলের অন্যতম সদস্য দেওয়ান বাজারের জামালপুর নিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা মজির উদ্দিন আহমদ ও উজিয়ালপুর নিবাসী মো. সমুজ আলী বলেন, একাত্তরের সেই দিনের কথা জীবনে ভোলার নয়। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে আমরা জীবন বাঁজি রেখে যুদ্ধ করেছি। আমরা চাই, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি শান্তি, সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক।