প্রতিবন্ধী ও শোকাহতের এসএসসি পাশ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ৭:৪৩:১৬ অপরাহ্ন

রফিকুর রহমান লজু
এবারের অর্থাৎ ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার চমক হলো জিপিএ-৫ এর সংখ্যা বেড়েছে। তবে পাশের হার গত বছরের চেয়ে কমেছে। এ বছর গড় পাশের হার ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আগের বছর এ হার ছিল ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় এবার পাশের হার কমেছে ৬.১৪ শতাংশ। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মণি জানিয়েছেন, চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ৮৬ হাজার ২৬২ জন। এ বছরে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন শিক্ষার্থী। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন। ৯ বোর্ডে পাশের হার ৮৮.১০ শতাংশ। পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১৯ লাখ ৯৪ হাজার পরীক্ষার্থী।
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সিলেট শিক্ষা বোর্ডে পাশের হার সারাদেশের মধ্যে সর্বনিম্ন ৭৮.৮২ শতাংশ। পরীক্ষার আগে আগে সিলেট বিভাগে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। বন্যার পানির তোড়ে ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি ছাত্র ছাত্রীদের বই, খাতা, নোট প্রভৃতি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এর প্রভাব পড়েছে পরীক্ষার ফলাফলে।
সিলেট শিক্ষা বোর্ডের অধীন চারটি জেলার মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফলাফল করেছে সিলেট জেলা। সিলেটের পাশের হার হলো ৮১.৯৫ শতাংশ। সেই সাথে সুনামগঞ্জে ৭৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ, হবিগঞ্জে ৭৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ ও মৌলভীবাজারে ৭৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ ফল করেছে। ফলাফলে ‘এ’ পেয়েছে ২৩ হাজার ৯৭০ জনে, ‘এ’ মাইনাস পেয়েছেন ৯ হাজার ১৪০ জনে, বি গ্রেড পেয়েছে ২০ হাজার ৮৬৩ জনে, ‘সি’ গ্রেড পেয়েছে ১৮ হাজার ৭১৪ জনে এবং ‘ডি’ গ্রেড পেয়েছে ৬৯৬ জনে।
সিলেট বিভাগে এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে চমক ছিল মৌলভীবাজারের চা শ্রমিকের অন্ধ সন্তান হরিবল বোনার্জী জিপিএ-৫ পেয়ে পাশ করেছে। সে শ্রীমঙ্গলের হুগলি ছড়া চা বাগানের বিশখা বোনার্জী ও অনিল বোনার্জীর ছেলে।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হরিবল বোনার্জী ব্র্যাক স্কুলে প্রাথমিক লেখাপড়া করেছে। পরে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে চলতি বছর। হরিবল বোনার্জী আরো পড়ালেখা করে ভবিষ্যতে সমাজকর্মী ও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
বাবার লাশ রেখে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫
একেবারে অন্তিম সময়ে সুমাইয়া আক্তার সুইটি ও মাহিদুল হোসেন খান মিরাজ এর এসএসসি পরীক্ষায় বসা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। দু’জনেরই পিতা মারা গেলে তারা অসহায় হয়ে পড়েন। পরীক্ষা দিতে না পারলে একটা বছর গচ্ছা যাবে। এদিকে লাশ কবরস্থ করতে গেলে সময় লাগবে, পরীক্ষা দিতে পারবে না। তাই তারা মনকে আরও শক্ত করে, পাষাণের চেয়েও পাষাণ হয়ে পরীক্ষা দিতে যায়। সুমাইয়ার বাবা আবুল কাশেম বাংলা ২য় পত্রের পরীক্ষার আগের রাত মারা যান। সুমাইয়া পিতার লাশ রেখে দিয়ে পরীক্ষা দেয়।
মাহিদুল হোসেন খান মিরাজ-এর পিতা অংক পরীক্ষার আগের রাত মারা যান। মিরাজ লাশ রেখে দিয়ে পরীক্ষা দেয়। সুমাইয়া ও মিরাজ দুজনেই জিপিএ-৫ পেয়ে বিরল মেধার পরিচয় দিয়েছে।
পা দিয়ে লিখে দাখিল পাশ
পরীক্ষার হলে বসে পরীক্ষা দিতে হাত, পা, হাতের আঙ্গুলের ভূমিকা প্রায় সমান সমান। কোনো একটা না হলে অসুবিধা। এরকম পঙ্গু বা খোঁড়ারও পড়ালেখা করার ইচ্ছা থাকতে পারে। কিন্তু ইচ্ছা হলেই তো হবে না। সে জন্য হাত থাকতে হবে, পা থাকতে হবে, চলাচলে শক্তি সামর্থ থাকতে হবে। কিন্তু দুই হাত নেই। ডান পা নেই। অন্য পা অস্বাভাবিক এবং ছোট। তার কি হবে, তার অদম্য ইচ্ছা থাকতে হবে। এই অদম্য ইচ্ছা দিয়েই পঙ্গুত্বকে জয় করেছে। প্রতিবন্ধী রাসেল মৃধা দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে কলম রেখে খাতায় লিখেছে এবং দাখিল পরীক্ষা পাশ করেছে। সে জিপিএ ৩.৮৮ পেয়েছে।
রাসেল মৃধা সিংড়া উপজেলার শোলাকুড়া ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসা থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। সে দিনমজুর আবদুর রহিম মৃধার পুত্র। রাসেলের মা-বাবা খেয়ে না খেয়ে ছেলের পড়ার খরচ যুগিয়েছেন। তাদের দাবি লেখাপড়া শেষে তাকে যেনো একটি সরকারি চাকরি দেওয়া হয়।
৬৭ বছর বয়সে এসএসসি পাশ
পড়ালেখায় বয়স কোনো বাঁধা নয়। যে কোনো বয়সে পড়ালেখা করা যায়। আগ্রহ ও উদ্যম থাকলেই হয়। আবুল কালাম আজাদ জীবনের মধ্যম স্তরে পৌঁছে ৬৭ বছর বয়সে এসএসসি পাশ করেছেন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বকশীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রাবাজ রশিদা বেগম হাইস্কুল থেকে চলতি বছর পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি এবং জিপিএ ২.৯৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি একজন কবি। নিয়মিত কবিতা লিখেন বলে এলাকায় তিনি ‘কবি কালাম’ নামে পরিচিত। কালাম আজাদ ১৯৭৬ সালে ১০ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ওই বছর তাদের ঘরে আগুন লেগে সবকিছু ছাই হয়ে যায়। বইপত্রও শেষ হয়ে যায়। তখন আর্থিক কারণে পড়ালেখা শিকায় ওঠে। জীবিকার তাগিদে তিনি ঢাকায় ডক ইয়ার্ডে চাকরি নেন। কবি কালাম ৮ হাজার গান, কবিতা, ছড়া ও উপন্যাস লিখেছেন। এগুলো হারিয়ে যাওয়া থেকে, উই পোকার কবল থেকে রক্ষার জন্য বই আকারে বাঁধাই করে রেখেছেন। কোনো প্রকাশক বা কোনো সাহিত্য প্রেমিক দয়াবান তাঁর বইগুলো প্রকাশে কোনো শুভ মুহূর্তে এগিয়ে আসবেন, এই আশায় তিনি উজ্জীবিত হয়ে আছেন।
একসঙ্গে মা-ছেলে এসএসসি পাশ
পরিবারে ও এলাকায় আনন্দ
পেশায় ভ্যানচালক হলেও আবদুর রহিম শিক্ষা দরদি। তার একটা সুন্দর মন আছে। টানাটানির সংসার থেকে খরচ বাঁচিয়ে তিনি তার ছেলে ও ছেলের মাকে পড়ালেখার খরচ যুগিয়েছেন। পড়ালেখায় উৎসাহ যুগিয়েছেন। এ বছর পরীক্ষা দিয়ে মা মুনজুয়ারা খাতুন ও ছেলে মো. মেহেদী হাসান একসঙ্গে এসএসসি পাশ করেছেন। মা জিপিএ ৪.৯৩ ও ছেলে ৪.৮১ পেয়েছেন।
বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে গিয়ে মুনজুয়ারা খাতুনের পড়া আর আগায়নি। তার বিয়ের চার বছরের মাথায় একটি ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। ছেলেকে পড়ালেখা করাতে গিয়ে তার আবার পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মে। পাবনা জেলার সুলতানপুর গ্রামে তার বাড়ি। মুনজুয়ারা খাতুনের জেদ তিনি যেভাবেই হোক পরীক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করবেন। যথারীতি সংসার করেও তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। ভ্যানচালক আবদুর রহিমের পরিবার এখন এলাকায় একটি সম্মানিত পরিবার হিসেবে পরিচিত।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, কলামিস্ট।