জয়যাত্রার অভিযানে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ৭:৪৫:১৮ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী
সমাজে, রাষ্ট্রশাসনে মানুষের হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপের কদর্যরূপ ইতিহাস বহুকাল থেকে প্রত্যক্ষ করে আসছে মানুষ। ইতিহাস ঘাটাঘাটি করলে দেখা যায়, শ্রেণীবিভক্ত সমাজ আসার পর থেকে অর্থ প্রতিপত্তি ও প্রতাপের লালসায় ক্ষমতার সন্ধানে মানুষের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতার যেন অন্ত নেই। চিন্তাশীল মনীষীরা তাই বলেছেন, পৃথিবীর সমস্ত উৎপীড়ন, অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার আর শোষণের মূলে বোধহয় মানুষের লোভ, ধন তৃষ্ণাই দায়ী।
মানবতার কবি হুইটম্যান লিখেছেন, `Mad passion for getting rich which engrosses all the thoughts and time of men’ অতিরিক্ত ধনতৃষ্ণাই মানুষকে মনুষ্যত্বের পথ থেকে-বিচ্যুত করে, তাকে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার শত্রু করে তোলে। এই পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর, যা কিছু পবিত্র তাকে ধ্বংস করে। এরাই তিলে তিলে মানুষকে হত্যা করে নিজেদের অর্থাগমের সোপান নির্মাণ করে। এই কদর্য ধনতৃষ্ণার কারণেই আজ বাতাসে বারুদের গন্ধ, হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী, মনুষ্যত্ব বিপন্ন। নৃতত্ত্ববিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, যুদ্ধ মানুষের বিবর্তনে তখনই এসেছে যখন সে সভ্যতার স্তরে পদার্পন করেছে এবং যখন সে শস্য এবং অন্যান্য সম্পদকে পুঁজি করতে আরম্ভ করেছে। এই নতুন বিষয়কি ব্যবস্থার কর্তৃত্ব কায়েম করতে অস্ত্রবলের প্রয়োজন হয়েছে এবং এই ব্যবস্থার প্রসার ঘটানোর মানসিকতা থেকেই মানুষে মানুষে হানাহানি ও যুদ্ধের জন্ম। মানবসমাজে হিংসায় আস্থা এবং যুদ্ধে আস্থা এসেছে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উৎপত্তি এবং শ্রেণি বিভক্ত সমাজ আসার পর। মহাকাব্যের যুগ থেকে শুরু করে আধুনিককাল পর্যন্ত ছোট বড় সমস্ত যুদ্ধের কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সম্পদকে কুক্ষিগত করা ও রাজ্যবিস্তারের আকাঙ্খা থেকে যুদ্ধগুলো সংঘটিত হয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শ্রেণীবিভক্ত সমাজ আরম্ভ হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থার সমাজনীতি এমন ভাবে রচনা করা হয়েছে যাতে নিম্ন শ্রেণীর ভিত্তিহীন বা সামান্যবিত্ত লোকদের ইতর শ্রেণীর সমান বলে গণ্য করা হয়েছে। আদিকাল সমাজে দাসদের জীবন ছিল গৃহপালিত পশুর মতো। বাজারে গরু-মহিষের মতো দাস কেনাবেচা চলত। আদিকালে সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিশিষ্ট রূপ ছিল, এক মানুষ কর্তৃক অপর মানুষের মালিকানা। মালিকের চাবুকের সামনে দাসদের দিনরাত হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হতো। দাসদের অমানুষিক পরিশ্রম থেকে সৃষ্টি হতো দাসমালিকদের বিপুল সম্পদ।
ইউরোপে প্রথম সভ্য সমাজের বিকাশ ও বিস্তারের মূলে ছিল দাসদের পরিশ্রম এবং সেই পরিশ্রমের ফল আত্মসাৎ করেই প্রাচীন ইউরোপের মালিক শ্রেণী তাদের সুবিখ্যাত সভ্যতা গড়ে তোলে। অথচ যাদের পরিশ্রমে সমাজে খাওয়া-পরার সামগ্রী এবং সভ্যতা গড়ে উঠল সেই দাসরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল। মধ্যযুগীয় সামন্ত সমাজেও সর্বত্র চালু ছিল বেগার খাটানোর প্রথা। বেগার প্রথা ছিল দাস প্রথারই রকম ফের। সে যুগের বিত্তহীন ও মধ্য্যবিত্ত আয়ের লোকদের রাজা, জমিদারদের জন্য বেগার খাটতে হতো। বিনা পারিশ্রমিকে এই বাধ্যতামূলক পরিশ্রমের ফলে গরীব লোকদের জীবনে দুঃখ-দুর্দশার অন্ত ছিল না। প্রাচীন মিশরের বিশাল পিরামিডগুলো এই বেগার পরিশ্রমের নিদর্শন। সম্রাট হুফু ত্রিশ বছর ধরে হাজার হাজার প্রজাকে বেগার খাটিয়ে সবচেয়ে বড় পিরামিডটি নির্মাণ করিয়েছিলেন, নিজের উপযুক্ত স্মৃতিসৌধ হিসাবে। পিরামিড নির্মাণের বড় বড় পাথরের ¯তূপগুলো ঘাড়ে করে কিংবা টেনে টেনে আনতে হতো বেগারদের। কাজে অবহেলা হলে শাস্তি ছিল চাবুক, নয়তো পিটিয়ে আধমরা করা হত। কত বেগার শ্রমিক যে পাথরের নীচে চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বেগার শ্রমিক ও ভূমিদাসদের পরিশ্রমের ফল আত্মসাৎ করেই রাজা, জমিদাররা প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠেন সে প্রাচীন যুগ থেকেই।
মধ্যযুগের বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটল রাষ্ট্র সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, রাষ্ট্র বিধাতার সৃষ্টি। এর কাজ হল নিরপেক্ষতা, ন্যায়বিচার ও আইনানুগ শাসন। বিধাতার সৃষ্টিতে অনেক মানুষ জন্মায় দাসত্ব করার জন্য। অ্যারিস্টটলের এই অবিদ্যাপ্রসূত মন্তব্যটি কত অমানবিক, কত নির্মম। মধ্যযুগে ধর্মরক্ষার নামে যেসব যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছিল তার আসল উদ্দেশ্য ছিল পররাজ্য দখল ও সম্পদ লুণ্ঠন। প্রথম পুঁজির সঞ্চয় হয়েছিল এভাবেই হিংসা ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে। এই অপহরণকারী মানসিকতা থেকেই পুঁজিতন্ত্রের জন্ম। ধনতান্ত্রিক যুগে মানুষ গোলামি থেকে মুক্ত হল বটে কিন্তু শোষনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেল। ধনবানেরা যে সমাজে প্রধান সেখানে এ ঘটনা অনিবার্য। একজন ইতালীর দার্শনীকের উক্তি, “পরের মর্ম ছিন্ন না করলে, খুবই কষ্টকর কর্ম না করলে, মাছ মারা হয় যেমন নিষ্ঠুরভাবে তেমনই নির্মম না হলে বিপূল সম্পত্তি অর্জন করা যায় না।” কার্ল মার্কস তাঁর মূলধন (ঈধঢ়রঃধষ) গ্রন্থের প্রথম খন্ডে ঐতিহাসিক পরিচ্ছেদগুলোতে এর সংক্ষিপ্ত র্বণনা দিয়ে বলেছেন, ‘যদি ফরাসি লেখক ওজিয়ে-র ভাষায় বলা যায় যে টাকা যখন আবির্ভূত হয় তখন তার গায়ে জন্মকালে রক্ত চিহ্নের মতো একটা নোংরা দাগ থাকে, তাহলে বলতে হয় যে মূলধন (ঈধঢ়রঃধষ), পুঁজির যখন আবির্ভাব ঘটে তখন তার প্রতি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের প্রতিটি রোমকূপ থেকে রক্ত আর ক্লেদ ঝরতে থাকে।’ মার্কসের ভাষায় ধনবানদের আবির্ভাব ঘটেছিল এইভাবে। আমরা যারা আধুনিক সভ্যতার চাকচিক্য দেখে বড়াই করি, সে সভ্যতার পাঁজরে পাঁজরে জমাট বেঁধে আছে লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষের অশ্রু, ঘাম আর রক্ত। অনেকেরই মনে পড়তে পারে বছর ত্রিশেক আগে ঢাকায় আন্তর্জাতিক এক কবি সম্মেলনে বিখ্যাত কবি স্টিফেন স্পেন্ডার এসেছিলেন। সাংবাদিকরা তাঁর কাছে জানতে চান এশিয়া অঞ্চলের দারিদ্র দেখে তিনি কী ভাবছেন। তিনি অম্লান বদনে জবাব দিলেন যে, দারিদ্র খুবই দুঃখকর সন্দেহ নেই, কিন্তু দারিদ্র দূরীকরণে লেগে থাকতে হলে মানুষের সভ্যতাকেই গড়ে তোলা যেত না। স্পেন্ডারের এই মন্তব্য কত নির্মম, কত অমানবিক। আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রলোভন কত প্রতারণামূলক। অর্থের দাসত্ব করাই এদের জীবনের ব্রত।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সভ্যতার পিলসুজ’-এ লিখেছিলেন, “চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাত লোক থাকে, তাদেরই সংখ্যা বেশী, তারাই বাহন অথচ দেশের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। সবচেয়ে কম খেয়ে, কম পরে, কম শিখে বাকি সকলের পরিচর্যা করে। সকলের থেকে বেশি তাদের পরিশ্রম, সকলের থেকে সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে- উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।” মৃত্যুর এক বছর আগে মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় বিচলিত রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘সভ্যনামিক পাতালে জমেছে, লুঠের ধন’। রবীন্দ্রনাথের সভ্যতার পিলসুজের চিত্রকল্প যা হয়তো স্পেন্ডারেরা তো কবির ধ্যান-ধারনাতে স্থান পায় না আর এই উন্নাসিক ঔদাসিন্যের মধ্যে যে অপরিসীম নিষ্ঠুরতা লুকিয়ে রয়েছে তা চিন্তাতেই আসে না। দুঃখের কোন দেশ বিদেশ নেই। সোভিয়েত কবি সিমোনভ-এর একটা সুন্দর কথা মনে পড়ে। তিনি লিখেছেন, ঞযবৎব রং হড় ধষরবহ মৎরবভ, ঙঁৎ ংবঢ়ধৎধঃব ংড়ৎৎড়ংি পড়সঢ়ৎরংব ধ ংরহমষব যড়ঢ়ব – আমরা আলাদা আলাদা কষ্ট পাচ্ছি, কিন্তু এই কষ্টকে মিলিয়ে জমছে সবারই একমাত্র আশা, সে আশা হল যে নতুন জীবন আসবেই, মানুষ এই নরকবাসে স্বীকৃত হবে না।’ কবি লিখেছেন-
মানুষ বড় একলা/ তুমি তার পাশে দাঁড়াও/ মানুষ বড় কাঁদছে/ তুমি তার পাশে দাঁড়াও/ মানুষ বড় অসহায়/ তুমি তার পাশে দাঁড়াও/
পরাশক্তি বর্তমান বিশ্বে নয়া পুঁজিশাহী বিশ্বায়নী রূপ নিয়ে যে নিষ্ঠুরতা নিয়ে আসছে তার পরিণাম বড়ো ভয়ঙ্কর, মানবতা বিপন্ন। নতুন প্রজন্মের এক অখ্যাত কবি রাজেশ গড় লিখেছেন, ‘বড় কষ্ট হয়, বড় কষ্ট হয়/ বেঁচে আছি গেঁড়ি-গুগলির মতো নিশ্চুপ/ ভিতরে ভিতরে প্রাণ নয়/ অনিবার্য ক্ষয় নড়াচড়া করে/ তবুও হিংস্র দাঁত এসে, দেখে দিতে চায়/ গেঁড়ি-গুগলিগুলো ফের হয়ে উঠছে না তো মানুষ।’
সভ্যতার সঙ্কট’-এ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে।’
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।