নৈতিকতা ও আমাদের সমাজ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ ডিসেম্বর ২০২২, ৯:৫৪:১৪ অপরাহ্ন
![নৈতিকতা ও আমাদের সমাজ নৈতিকতা ও আমাদের সমাজ](https://sylheterdak.com.bd/wp-content/uploads/2022/08/dak-po-sompadokio2-4.jpg)
মো. লোকমান হেকিম
আমাদের দেশে প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও অস্বাভাবিক সব ঘটনা ঘটছে। কোথাও কেউ যেন আর নিরাপদ নয়। যে ঘরকে আমরা সবচেয়ে নিরাপদ ভাবি, সেখানেও নির্মম খুনের শিকার হচ্ছেন অনেকে। শুধু তা-ই নয়, সন্তান-সন্ততিসহ হত্যার ঘটনাও ঘটছে। ফলে সমকালে পরিবার কিংবা সমাজে কেউই আর নিরাপদ বোধ করছেন না। পুরো দেশটাই যেন হয়ে উঠছে বিপদসঙ্কুল আর নিরাপত্তাহীন। এ ক্ষেত্রে দায়ী সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় আর আইনশৃঙ্খলার অবনতি। আমাদের সামগ্রিক মূল্যবোধের যে অবক্ষয় ঘটেছে; সে চিহ্ন স্পষ্ট। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ধর্ষণের মতো পাশবিক ঘটনা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি লক্ষণীয়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ধর্ষণ নিয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই ভালো। স্বামীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নববধূকে কিংবা কন্যাশিশুকেও দলবেঁধে ধর্ষণ করছে নরপশুরা।
দুঃখ ও দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এই ভয়াবহ প্রবণতা না কমে বরং বাড়ছে। প্রশ্ন হলো, কেন এমন হচ্ছে? ধারণা করা অমূলক নয় যে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার সাথে এই পরিস্থিতির উদ্ভবের একটি সংযোগ থাকতে পারে। কিন্তু সমাজের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং তা বজায় রাখার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত তারা নিজেদের দায়িত্ব পালনে উদাসীন। অথবা গোষ্ঠীস্বার্থে মৌনতা অবলম্বন করাকেই শ্রেয় মনে করছেন তারা; যা তাদেরকে নিষ্ক্রিয় থাকতে বাধ্য করছে। এমনটি হয়ে থাকলে তা গোটা জাতির সবার জন্য অমঙ্গল বয়ে আনতে বাধ্য। তাই একজন ভালো মানুষ হতে হলে শিষ্টাচার বা ভদ্রতার গুণটি অত্যন্ত জরুরি। এ গুণ অর্জন করে যে কেউ নিজেকে উন্নত এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে। মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারে সহজে। ছাত্রজীবন, চাকরিজীবন সব ক্ষেত্রে সফলতা বয়ে আনতে পারে। মানুষ স্বভাবতই বিনয়, নম্রতা ও শালীনতা পছন্দ করে। পাশাপাশি ঔদ্ধত্য কিংবা দাম্ভিকতা কেউ পছন্দ করে না। শিষ্টাচার অর্জন করার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয় না। দরকার সদিচ্ছা আর সাধনা। এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শিষ্টাচার শিক্ষার সূচনা হয় মূলত পরিবার থেকে। শিশুদেরকে যদি পারিবারিকভাবে সুশিক্ষা দেওয়া হয় তবে সে শিশু হয়ে ওঠে আদর্শবান ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী। পারিবারিক কলহ বিবাদের মধ্যে বেড়ে ওঠা বা রূঢ় আচরণ দেখে অভ্যস্ত শিশুদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তার পক্ষে বিনয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম। নৈতিকতা বলতে সেই গুণকে বুঝায়, যা মানুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখে এবং ন্যায় কাজে নিয়োজিত রাখে। জীবনের সব ক্ষেত্রে মনুষ্যত্ব ও নীতি-আদর্শ শিক্ষাকে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
নৈতিকতা মানুষকে উত্তম চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলে এবং সমাজে অনেক সম্মানী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে সমাজে নৈতিকতার শিক্ষা না থাকলে শান্তি থাকে না। ফলে সমাজে দুর্নীতি, সন্ত্রাসী, চুরি-ডাকাতি, প্রতারণা, মাদকদ্রব্য বা নেশা করা, ইভটিজিং ইত্যাদি ঘৃণিত কাজ বৃদ্ধি পেতে থাকে। শুধু তাই নয়, মানুষের মধ্যে দয়া, মায়া ও ভালোবাসা থেকে শুরু করে সদগুণাবলীর চর্চা থাকে না। ফলে মানুষ পরস্পরকে অবিশ্বাস ও সন্দেহ পোষণ করে এবং সমাজে নানা অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির সৃষ্টি হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নৈতিকতা নেই বললেই চলে। আর সেটা তরুণদের দেখে বেশি উপলব্ধি করা যায়। বর্তমান সমাজে বেশি উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছে তরুণরাই। তারা বড়দের দেখলে সাধারণত করে না কোনো সম্মান। আজকের তরুণরাই দেশের বা জাতির ভবিষ্যৎ। তারা যদি নৈতিকতা শক্তির অপব্যবহার করে তাহলে ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত থাকবে কে? বর্তমান তরুণ-তরুণীরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে শুধু নৈতিকতার শিক্ষা না থাকার কারণে। ফলে তারা শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে বিপথগ্রস্ত এবং হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। এমন কাজ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে হাজারো তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। হতাশ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে অনেকেই। ইভটিজিংয়ের মতো ঘৃণিত কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না অনেকের। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে শহরের বিভিন্ন অলি-গলিতে ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে তরুণীরা। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে তারা। এমন ঘৃণিত কাজ পুরুষদের জন্য কলঙ্ক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তাই ছোট থেকে সন্তানদের নৈতিকতায় শিক্ষায় শিক্ষিত করুন। শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, উত্তম চরিত্র গঠনে এবং একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে নৈতিকতার চর্চা করা সবার জন্য জরুরি। তাই পিতা-মাতার কাছে সন্তান হলো সবথেকে মূল্যবান। সন্তানের স্বার্থে জীবন বিপন্ন করতেও পিতা-মাতারা দ্বিধাবোধ করেন না। পিতা-মাতা তাদের জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সন্তানের জন্য সকল ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি থাকেন। এভাবে পরম মমতায় একটু একটু করে বেড়ে ওঠে সন্তানরা। সন্তান যত বড় হতে থাকে তাদের ঘিরে বাবা-মায়ের স্বপ্নও তত বড় হতে থাকে। একটা সময় পরে সন্তান স্বাবলম্বী হয়ে যায় এবং সমাজে তার প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করে। ফলে বাবা-মায়ের খুশি আর আত্মতৃপ্তির কোনো শেষ থাকে না। কিন্তু দেখা যায়, বাবা-মায়ের এই অপরিসীম আদর-স্নেহের প্রতিদানে প্রতিষ্ঠিত সন্তানের এক অংশ বাবা-মায়ের শেষ জীবনে বৃদ্ধাশ্রম উপহার দেয়। যে বাবা-মায়ের জীবনটাই চলে যায় সন্তানকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে, বৃদ্ধ বয়সে সন্তান সেই বাবা-মায়ের থেকে মুক্তি পেতে চায়। ফলে বৃদ্ধাশ্রম হয় তাদের ঠিকানা। এর জন্য কি শুধু সন্তান দায়ী? সমাজ হয়তো শুধু সন্তানকেই দায়ী করবে। কিন্তু একটু গভীর দৃষ্টিতে দেখলে বোঝা যায়, সন্তানের আগে পিতা- মাতাও কম দায়ী নন। পিতা-মাতারা আদর স্নেহের পাশাপাশি যদি সন্তানকে যথার্থ নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতেন, মানুষের প্রতি মানুষের অধিকার ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করতেন, ধর্মীয় জ্ঞান ও বিধি-বিধান সম্পর্কে সন্তানকে অবহিত করতেন তাহলে হয়তো তাদের এই পরিস্থিতির শিকার হতে হতো না। তাই সময় থাকতে পিতা-মাতাদের সচেতন হওয়া উচিত।
লেখক : কলামিস্ট।