সিলেট অঞ্চলে ঢল অব্যাহত, দুর্ভোগ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জুন ২০২৪, ৬:২৮:০৬ অপরাহ্ন
অনলাইন ডেস্ক : বৃষ্টির প্রকোপ থামলেও বরাক নদী ও মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা বিভিন্ন ‘ছড়া’ খাল, ঝর্ণাসহ অসংখ্য ছোট নদী দিয়ে সীমান্তে ঢল অব্যাহত রয়েছে।
ফলে সুরমা, কুশিয়ারাসহ বিভিন্ন অববাহিকায় বন্যার পানি তেমন কমেনি। বন্যা আক্রান্ত মানুষের দুর্ভোগ অব্যাহত রয়েছে। বৃষ্টি না থাকায় শহরবাসীর মনে কিছুটা স্বস্তি এলেও বন্যাকবলিত সিলেট অঞ্চলের সাড়ে ১৩ লাখ মানুষ এখনো অস্বস্তিতে রয়েছেন। বন্যার পানিতে দুর্ভোগ নিয়েই তারা সময় কাটাচ্ছেন।
সিলেট শহরে অর্ধলক্ষ মানুষ এখনো পানিবন্দি। জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, সিলেট জেলায় ১ হাজার ৩০০ গ্রাম প্লাবিত হয়। এতে ৭ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। ৬২৭টি আশ্রয় কেন্দ্রে ১৭ হাজার ২৮৫ জন বাসভাসি আশ্রয় নিয়েছে। নগরীর ৮০টি কেন্দ্রে দুর্গতরা আশ্রয় নিয়েছেন। কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও ফেঞ্চুগঞ্জ বন্যা পরিস্থিতি খুবই খারাপ।
এদিকে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শনে গতকাল সকালে দুই দিনের সফরে আসেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। তিনি সিলেট নগর ও সুনামগঞ্জকে আগাম বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে সুরমা নদী ড্রেজিং করার কথা বলেছেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, কিশোরগঞ্জের মিটামইন সড়ক দিয়ে পানি পারাপারের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করছে সরকার। তিনি বলেন, দেশের ৯টি স্থানে ড্রেজিং স্টেশন তৈরি করা হচ্ছে। নদী ভাঙন, পলিমাটি অপসারণে নিয়মিত নদী খনন করা হবে।
দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে দেখা যায়, মানুষের ঘর-দুয়ার, বাড়ির আঙিনায় পানি থইথই করছে। শহরের অনেক স্থানেই জলাবদ্ধতা রয়েছে। উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে রাস্তাঘাট পানি নিচে। গবাদি পশু নিয়ে মানুষ বিপাকে। কেউ কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিলেও অনেকেই বাড়ি ফেলে আসতে চাননি। তারা পানির মধ্যেই বসবাস করছেন।
কুশিয়ারা অববাহিকায় ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের মধ্যে উপজেলার নিম্নাঞ্চল, নদীপাড় এলাকা ও হাকালুকি হাওর ঘেঁষা এলাকার অবস্থা বেশি খারাপ।
কানাইঘাটের সার্বিক পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। সুরমা ও লোভা নদী বিপদসীমার ওপরে। সুরমা ডাইকের ১৮টি ভাঙন দিয়ে প্রবল স্রোতে লোকালয়ে প্রবেশ করছে পানি। ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার অধিকাংশ রাস্তাঘাট তলিয়ে রয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে সুরমার পানি ১৪ সেন্টিমিটার কমে বিকালে বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলার ৮৮ ইউনিয়নের ৮ লাখ লোক ভোগান্তিতে পড়েছে। পৌর এলাকার অনেক স্থান থেকে পানি নেমেছে। আবার অনেক স্থানে পানি রয়েছে। আবার অনেক বাসিন্দা হোটেলেও আশ্রয় নিয়েছেন। বৃহস্পতিবার বিকালে সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের মঈনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রী জাহিদ ফারুক বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন।
মৌলভীবাজার জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কমলগঞ্জে ধলাই নদীর তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে বিস্তির্ণ এলাকা। কমলগঞ্জে ধলাই নদীর সদর ইউনিয়নের চৈতন্যগঞ্জ এলাকায়, রহিমপুর ইউনিয়নের চৈত্রঘাট ও মুন্সীবাজার ইউনিয়নের খুশালপুর গ্রামে ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন দিয়ে পানি প্রবেশ করে ৪০টি গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি ডুবে গেছে।
সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের পশ্চিম শ্যামেরকোনা এলাকায় গতকাল বন্যার পানিতে ডুবে দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত হূদয় আহমদ সদর উপজেলার পশ্চিম শ্যামেরকোনা গ্রামের জমির আলীর ছেলে ও সাদি মিয়া একই গ্রামের ফসল মিয়ার ছেলে। বড়লেখায় বন্যার পানিতে ডুবে গতকাল আয়শা বেগম (১২) নামে এক ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে।
মনু ও ধলাই নদীর বাঁধের ১৯টি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে কুলাউড়া পৌরসভার তিনটি ওয়ার্ড। এছাড়াও বন্যার পানি প্রবেশ করেছে কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কুলাউড়া উপজেলা পরিষদ ও জুড়ী উপজেলা পরিষদে। বন্যাকবলিত এলাকার অধিকাংশ গ্রামীণ রাস্তা তলিয়ে গেছে। আঞ্চলিক সড়কের অনেক স্থানে পানি উঠেছে। বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি রয়েছে সাত উপজেলার প্রায় ৩ লাখ মানুষ। জেলার ৪০ ইউনিয়নের ৪৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
হবিগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি শেরপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু স্থানে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। পানি আরো বৃদ্ধি পেলে কুশিয়ারা নদী ঘেঁষা বিবিয়ানা বিদ্যুত্ পাওয়ার প্ল্যান্ট ও বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে পানি প্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর-আউশকান্দি আঞ্চলিক মহাসড়ক ডুবে দ্রুতগতিতে পানি প্রবেশ করছে কসবা গ্রাম, কসবা বাজারসহ কয়েকটি গ্রামে। পানি দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ভয়াবহ রূপ আকার ধারণ করছে বন্যা। মানবেতর জীবন যাপন করছে সাধারণ মানুষ। দিশেহারা অসহায় মানুষজন ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ইনাতগঞ্জের মোস্তফাপুর পাঠানহাটি গ্রামের পাকা সড়ক, দীঘলবাক গ্রামের পাকাসড়কসহ ১৫-২০টি পাকা সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ইনাতগঞ্জে অবস্থিত এশিয়া মহাদেশের অন্যতম গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা ও পারকুলে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী ঘেঁষা বিবিয়ানা ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনকেন্দ্রে। বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে দুই-তিন হাত নিচে বর্তমান পানি রয়েছে। তবে দ্রুতহারে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্যাসক্ষেত্রে পানি প্রবেশের আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।