কারফিউ’র পঞ্চম দিনে কেমন ছিল সিলেট নগর
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জুলাই ২০২৪, ১১:৪৭:২০ অপরাহ্ন

অনলাইন ডেস্ক : দেশব্যাপী চলমান কারফিউয়ের পঞ্চম দিনে সিলেটে স্বস্তি ফিরেছে। বুধবার (২৪ জুলাই) সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জেলা প্রশাসন কারফিউ শিথিল রাখায় নগরবাসীর মধ্যে অনেকটা কর্মচাঞ্চলতা লক্ষ করা গেছে।
তবে কারফিউ আংশিক শিথিলের পরও সিলেটে অচলাবস্থা এখনও পুরোপুরি কাটেনি। মানুষের মনে যে ভয় বাসা বেঁধেছে তা এখনও সরেনি। শহরে ব্যাংক ও অফিস-আদালত কেন্দ্রীক ব্যস্ততা বাড়লেও শহরের বাইরের লোকজন শহরে খুব একটা আসেননি। অজানা আতঙ্কে মানুষ খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হননি। অফিসিয়াল কাজে বের হওয়াদের মধ্যে তরুণদের চেয়ে বয়োজেষ্টদের সংখ্যা ছিল বেশি। যেসব পরিবারে কর্মক্ষম বয়োজেষ্ট লোকজন আছেন সেসব পরিবারের ব্যাংক-বিল বা অন্যান্য কাজে বয়োজেষ্টরাই বের হয়েছেন।
কারফিউ শিথিলের কারণে সব দোকানপাট খুলেছে, রাস্তায় ছিল প্রচুর যানবাহন। তবে দোকানে ক্রেতা ও বাহনে যাত্রীর সংখ্যা ছিল অনেক কম। শহরের বিভিন্ন রুটে সিএনজি অটোরিকশায় যাত্রী থাকলেও শহরের বাইরে গমন ও বাইরে থেকে শহরে আগমনের সিএনজিতে যাত্রী প্রায় ছিলনা বলে চালকরা জানান। ব্যবসায়ী ও চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে কয়েকদিনের আটকে থাকা কাজ শেষ করতেই মূলত বুধবার লোকজন ঘর থেকে বের হয়েছেন। এরমধ্যে আছে যাদের নগদ টাকা শেষ হয়ে গেছে তাদের ব্যাংক থেকে টাকা তোলা এবং যাদের বিয়েশাদীসহ কোনো আনুষ্ঠানিক কারণে কেনাকাটা বাকি তাদের সে-সব কেনাকাটা সারা, যাদের বিভিন্ন বিল-বকেয়া আছে তাদের সেই কাজ শেষ করা।
১৮ জুলাই বিকাল থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হামলা, ভাঙচুর ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ছিল পরের দুদিন পর্যন্ত। এ সময় নগরীর বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার এবং আখালিয়া এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় পুরো নগরীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল।
আজ বুধবার দুপুরে সিলেট নগরীর ব্যস্ততম বন্দরবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন মার্কেটে দোকানপাট খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। ক্রেতারাও জিনিসপত্র কেনার জন্য ভিড় করেছেন মুদি দোকান, মাছ-সবজি বাজার বিপণিবিতানসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। খাবার রেস্টুরেন্টগুলোতে ভিড় রয়েছে মানুষজনের।
লালদিঘীরপাড় এলাকার ব্যাংকগুলোতে ছিল গ্রাহকদের উপচেপড়া ভিড়। এ ছাড়া নগরীর মাদিনা মাকের্ট, পাঠানঠুলা, সুবিদবাজার, রিকাবিবাজার, চৌহাট্টা, জিন্দাবাজার ও ধোপাদিঘীরপার এলাকার সড়কে মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, রিকশা, পণ্যবাহী যান, ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করছে। সিলেট নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে।
সিলেট নগরীর দাড়িয়াপাড়ার বাসিন্দা মনির বলেন, “কয়েক দিন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। বাসায় প্রিপেইড মিটারে গ্যাস ছিল একেবারে সামান্য। এতে করে পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম। মঙ্গলবার রাতে ইন্টারনেট সেবা চালু হওয়ায় ও ব্যাংক খোলায় বুধবার ব্যাংকে গিয়ে গ্যাস রিচার্জ করায় এখন অনেকটা স্বস্তি বোধ করছি। আশা করছি, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি শিগগিরই স্বাভাবিক হবে।”
নগরীর জেলরোড এলাকায় কথা হয় রিকশাচালক মানিকের সঙ্গে। তার ভাষ্য, রিকশা নিয়ে বের হয়ে গত কয়েকদিন তেমন যাত্রী পাওয়া যায়নি। এখন রাস্তাঘাটে লোক বেশি থাকায় যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি বলেন, “কয়েকদিন রাস্তাঘাট নিরব ছিল; তাই যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে ভয়ও ছিল। আর যাত্রী কম থাকায় ভাড়াও তেমন হয়নি। হঠাৎ করে এই অবস্থার কারণে বউ-বাচ্চা নিয়ে টেনশনে ছিলাম। হাতে যা টাকা ছিল তা দিয়ে বাজার চালিয়েছি। আজকে রোজি দিয়ে রাতে বাসায় বাজার নিয়ে ফিরব।”
লালদিঘীরপাড়ের ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছেন নগরীর উপশহরের বাসিন্দা রশিদুল হক চৌধুরী। এ সময় তিনি বলেন, “কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় জরুরি অবস্থা জারি হওয়াতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস, আদালত, ব্যাংক বন্ধ ছিল কয়েকদিন। হাতে বেশি টাকা-পয়সা ছিল না; বিকাশ, ব্যাংকের বুথ থেকেও টাকা উঠানো যাচ্ছিল না। তাই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম হাট-বাজারের টাকার জন্য।
“আজ ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছি, এখন বাজার করে বাসায় যাবো। বাসার বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটারের জন্য অন্য ব্যাংক থেকে রিচার্জ করতে হবে। সবচেয়ে বেশি টেনশনে ছিলাম বিদ্যুৎ নিয়ে। কারণ, বিদ্যুতের ইউনিট শেষ হয়ে গেলে বাসার পানি উঠানো বন্ধ হয়ে যেত। আর এই গরমে ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে বিদ্যুৎ ছাড়া কিভাবে থাকা যাবে। আজকে কারফিউ শিথিল করায় খুব ভালো হয়েছে।”
বন্দরবাজারের মুদি দোকানি ইব্রাহিম হোসেন বলেন, “দেশের অন্য সব জায়গা থেকে সিলেটের অবস্থা বর্তমানে ভালো। আমরা গত কয়েকদিন ব্যবসা করতে পারিনি; আজকে ক্রেতারা ভিড় করছেন দোকানে। আশা করছি ভালো বেচাকেনা হবে।
“গত বৃহস্পতিবার বন্দরবাজার এলাকায় ঝামেলা শুরু হলে আতঙ্কে লোকজন এদিকে আসেননি। তারপর শুক্র ও শনিবার বন্দরবাজার এলাকায় দফায়-দফায় সংঘর্ষে আমাদের মনে ভয় কাজ করছিল দোকানপাট খুলতে পারব কিনা। গত কয়েকদিনে ব্যবসায়ীদের লস হয়েছে। দোকানের কাঁচামাল নষ্ট হয়েছে অনেকের।”
বুধবার বিকাল ৪টার দিকে সোবাহানীঘাট এলাকায় ভাসমান সবজি বিক্রেতা করিম মিয়া বলেন, “কয়েকদিন রাস্তাঘাট নিরব ছিল; মেইন সড়কে লোক বেশি ছিল না। আজকে রাস্তাঘাটে মানুষের ভিড় রয়েছে।”
তিনি বলেন, “পাঁচ-ছয়দিন পর কিছু বেচাকেনা হয়েছে। আমরা রোজ মাল কিনে বিক্রি করে সংসার চালাই; আন্দোলন করে আমাদের বিপদে না ফেলাই ভালো। কারণ আমরা না খেয়ে থাকলে কেউ খবর নেয় না।”
সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মাদ আবদুল কাদির বলেন, “চার দিনে সিলেট নগরীর ১৪টি অফিসে ৬৭ হাজার গ্রাহককে সেবা দেওয়া হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে ছয় কোটি ২০ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আমাদের এ কার্যক্রম চলবে।”
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন গভীর রাত পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছেন। গ্রাহকরাও বিদ্যুৎ বিভাগের কার্ড বিক্রয় করা প্রতিষ্ঠানে ভিড় জমিয়েছেন।”
বাস ছাড়লেও বন্ধ ট্রেন :
সিলেট জেলা বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ময়নুল ইসলাম জানান, কয়েকদিন সিলেট থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকার পর বুধবার সকাল থেকে দূরপাল্লার বাস ও যানবাহন চলাচল করেছে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক নুরুল ইসলাম বলেন, “ট্রেন চলাচল কবে থেকে চালু হবে, এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা আসেনি। বন্ধ সময়ের মধ্যে যারা ট্রেনের টিকিট কেটেছিলেন, সেই টিকিট ফেরত দেওয়ার নির্দেশনাও আসেনি। পরে এ বিষয়ে জানানো হবে।”
বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের অভিযোগ :
বিএনপির ৪০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের অভিযোগ করেছেন সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী। তিনি বলেন, “ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির কোনো যোগসূত্র নেই। তবু পুলিশ আমাদের নেতাকর্মীদের মামলায় আসামি করে গ্রেপ্তার ও হয়রানি করছে। অনেক নেতাকর্মীর বাসা-বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি করছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা নিজেদের বাসাবাড়িতে থাকতে পারছেন না।”
এ বিষয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মোহম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, “পুলিশ প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করছে না। ভাঙচুর-হামলা ও সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িতদের ভিডিও, ছবি দেখে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ ছাড়া গ্রেপ্তার হওয়াদের দেওয়া তথ্য ও গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।”
-সিলেটের ডাক, ফায়যুর রাহমান